|
|
|
|
ডাইনি-অপবাদে প্রায়শ্চিত্ত, হাজির পুলিশও
রাজীবাক্ষ রক্ষিত • গুয়াহাটি |
ব্রহ্মপুত্রের তীরে সার দিয়ে বসে ৩৫ জন নারী-পুরুষ। সকলেই কান ধরে রয়েছেন। পিছনে দাঁড়িয়ে লাল মেখলা পরা স্বঘোষিত ‘লক্ষ্মীদেবী’! তাঁর কথায় একের পর এক আচার পালন করে প্রায়শ্চিত্ত করছেন কান ধরা ‘ডাইনি’-রা। আর উল্লাসে ফেটে পড়ছে গ্রাম।
মাজুলির শিকারি গ্রামের ঘটনা। সেখানে হাজির ডাইনি প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই চালানো দুই ব্যক্তিত্বও। রয়েছে পুলিশ। কিন্তু এ হেন অযৌক্তিক অনুষ্ঠানে তাঁরাও বাধা দেননি। বরং মনে করছেন, গণপ্রহার কিংবা পুড়িয়ে না মেরে প্রায়শ্চিত্ত করে রেহাই, অল্পের উপর দিয়ে ওঁরা রক্ষা পেলেন!
মাজুলির প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে ডাইনি অপবাদে হত্যার ঘটনা বহুবার ঘটেছে। গ্রামের ওঝা কাউকে ডাইনি বলে চিহ্নিত করে দিলেই তাকে বলি দিয়ে ব্রহ্মপুত্রে ফেলে দেওয়াই রেওয়াজ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশের কাছে খবরই পৌঁছয় না। এমনই এক প্রত্যন্ত গ্রাম শিকারি। গড়মুড় থেকে যার দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। পুলিশ সূত্রে খবর, পয়লা অক্টোবর লখিমপুরের ঢকুয়াখানার এক মহিলা গ্রামে এসে জানান, এখানকার বেশ কিছু পরিবারে তন্ত্রসাধনা হয়। তিনি তিনটি পরিবারকে চিহ্নিত করে যান। জানান, পুনেশ্বর পাংগিং নামে গ্রামের এক কিশোরের মধ্যে ‘লক্ষ্মীর বসত’। সে বাকিদের চিহ্নিত করতে পারবে। এর পরেই, পাংগিং ব্রহ্মপুত্রের পারে মন্দির গড়ে। নিজেকে লক্ষ্মীদেবী বলে ঘোষণা করে ব্রহ্মপুত্রের তীরে লাল নিশান উড়িয়ে দেয়। ঘোষণা করে, গ্রামের ৫১ জন ব্যক্তি ডাইনি বিদ্যা চর্চা চালাচ্ছে। সেই পাপে ব্রহ্মপুত্র সরে যাবে। এমন ঘোষণায় গ্রামে আতঙ্ক ছড়ায়। ওই স্বঘোষিত লক্ষ্মীর নির্দেশে শুরু হয় ডাইনি-সন্ধান অভিযান। একে একে তিন বছরের এক শিশু-সহ ৩৫ জনকে চিহ্নিতও করা হয়। অসমে ডাইনি প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই চালানো বীরুবালা রাভা ও একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সচিব দিব্যজ্যোতি শইকিয়া এই খবর পেয়ে মাজুলি রওনা দেন।
শইকিয়ারা জানান, ডাইনি হিসেবে চিহ্নিত হওয়া ৩৫ জনের অনেকে পাংগিং-এর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। বাকিদের জোর করে টেনে আনা হয়। এদের চার জন নিজেদের তন্ত্রসাধক বলে মেনেও নেয়। এক জন স্বীকারও করে, তন্ত্রসাধনার জন্য সে একাধিক হত্যা করেছে। সোমবার সকলকে প্রায়শ্চিত্তের জন্য স্নান করানো হয়। গ্রামবাসীরা তাঁদের মারধর শুরু করেন। চরম শাস্তির প্রস্তুতিও শুরু হয়।
এক দল গ্রামবাসী ও পুলিশকে নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দুই প্রতিনিধি কোনও মতে সকলকে নিরস্ত করেন। এর পর নিজেরা গ্রামে থেকে শুরু করেন ডাইনি প্রথার বিরুদ্ধে প্রচার। তাতে খানিকটা কাজ হলেও, ‘ডাইনি’-দের বিনা প্রায়শ্চিত্তে ঘরে ফেরাতে রাজি ছিলেন না গ্রামবাসীরা। শেষ অবধি পুলিশ, সমাজকর্মী ও গ্রামবাসীদের বৈঠকে ঠিক হয়, কাউকে হত্যা করা হবে না। গত কাল লক্ষ্মীর সাজে সজ্জিত পাংগিং, ‘ডাইনি’ হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের দু’ভাগে ভাগ করে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে শুদ্ধিকরণ করায়। কান ধরে মাথা দিয়ে সকলকে হাঁড়ি ভাঙতে হয়। সোম ও বৃহস্পতিবারে মাংস খাওয়া মানা হয়। আরও বেশ কিছু রীতিনীতির পরে সমাজে ফেরেন ৩৫ জন গ্রামবাসী।
রাজ্যের ডাইনি প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই চালাবার জন্য শইকিয়ার সংগঠন বিশেষ আইনের দাবি জানিয়েছে। শইকিয়া জানান, অসম সরকারের তরফে এ নিয়ে বিল আনার পরিকল্পনা রয়েছে। বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশনের আগে তাঁরা স্পিকারের কাছে এই নিয়ে বিশদ প্রস্তাব পেশ করবেন। তিনি বলেন, “রাজস্থান, বিহার, ঝাড়খণ্ডে ডাইনি অপবাদে হত্যা রুখতে পৃথক আইন রয়েছে।” |
|
|
|
|
|