বাস কমায় যাত্রী দুর্ভোগ বাড়ছে
পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতায় বন্ধ হয়ে
গিয়েছে বহু লাভজনক রুট
গৌরবের ঐতিহ্য আজ অতীত।
নব্বইয়ের দশকে গ্রামীণ যাত্রী পরিষেবায় সাফল্যের জন্য জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কৃত হয়েছিল উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থা (এনবিএসটিসি)। ৪৪০টি রুটে চলত উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার বাস। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ২২০টি। প্রায় অর্ধেকই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অসম-বিহার-ঝাড়খণ্ডের মতো জায়গায় এখন আর বাস চালানো হয় না। কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর, মালদহ, দক্ষিণ দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিঙের প্রত্যন্ত এলাকায় যোগাযোগের জন্য যে সমস্ত বাস চালানো হত তাও এনবিএসটিসি কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ। যেমন কোচবিহার থেকে দিনহাটা, এই রুটে অফিসের সময়ে ১০ মিনিট অন্তর বাস পরিষেবা ছিল। কোচবিহার থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত ৩০ মিনিট অন্তর বাস চলেছে। নানা রুটে নন স্টপ বাস পরিষেবা ছিল। এর ফলে ক্রমশ ভোগান্তি বেড়ে চলেছে উত্তরবঙ্গের যাত্রীদের।
এনবিএসটিসির কোচবিহার ডিপো। ছবি তুলেছেন হিমাংশুরঞ্জন দেব।
যা অবশ্য কার্যত স্বীকার করেছেন এনবিএসটিসির চেয়ারম্যান তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব। তিনি বলেছেন, “বাম আমলে সংস্থার বেশির ভাগ বাস কেনা হয়েছে। সবই প্রায় বেহাল। ২৪ কোটি টাকা কর্মীদের বেতন দিতে খরচ করা হয়। তার ওপর টানা ১১ বছর কোনও নতুন বাস কেনা হয়নি। নতুন সরকার দায়িত্বে আসার পরে মাত্র ৩৫টি বাস কেনা হয়েছে। আরও ৭৫টি বাস আনার চেষ্টা হচ্ছে। শীঘ্রই কোন রুট কেন বন্ধ রয়েছে সে সব পর্যালোচনা করে পদক্ষেপ করা হবে। রুটের সংখ্যা বাড়বে।” নিগমের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর জয়দেব ঠাকুর দাবি করেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনও রুটে বাস চলাচল বন্ধ হয়নি। কয়েক মাসে আগে দায়িত্বপ্রাপ্ত এমডির বক্তব্য, “আগে কি হয়েছে জানি না। ইদানীং কোনও রুট বন্ধ হয়নি। তবে ডালখোলা-মালদহ-কোচবিহার-শিলিগুড়ির কিছু এলাকার কিছু রাস্তা বেহাল হয়ে পড়ায় মাঝেমধ্যে নির্দিষ্ট ট্রিপ বাতিল করতে হচ্ছে।”
সংস্থার কর্মী সংগঠনের অনেকেই কিন্তু অন্য কথা বলছেন। তাঁরা জানান, ১৯৪৫ সালে কোচবিহার মহারাজাদের উদ্যোগে তিনটি বাস নিয়ে সংস্থার যাত্রা শুরু হয়। পরে উত্তরবঙ্গের ছয় জেলার পাশাপাশি দক্ষিণবঙ্গের কিছু এলাকা মিলিয়ে মোট ৪৪০ টি রুটে বাস চালানো শুরু হয়। নব্বইয়ের দশকে গ্রামীণ যাত্রী পরিষেবায় সংস্থার ভূমিকা মাথায় রেখে এনবিএসটিসিকে জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হয়। এর পর থেকেই বাসের সংখ্যা কমতে থাকে। বন্ধ হতে থাকে নানা রুট।
২০১১ সালে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরেও গোড়ার দিকে ৩০০টি রুটে বাস চলেছে। এখন তা আরও কমে ২২০টি রুটে নেমেছে। এনবিএসটিসি ড্রাইভার্স অ্যান্ড তৃণমূল শ্রমিক কর্মচারি ইউনিয়নের কার্যকরি সভাপতি আব্দুর রহমান বলেন, “৪৪০ টি রুট পরিষেবার জন্য চিহ্নিত হয়েছিল অনেক আগে। বাম আমলে কোনদিন সমস্ত রুটে বাস চলেনি। দশ বছর আগে সাড়ে তিনশো রুট চালু ছিল। নয়া সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময়ে তিন শতাধিক রুট চালু ছিল। আমলাদের একাংশের ষড়যন্ত্রে এখন তা কমে বড় জোর ২৪০টি হয়েছে।”
ইনটাকের ওয়ার্কাস ইউনিয়নের কোচবিহার ডিভিশনের সম্পাদক সুজিত সরকারের অভিযোগ, বাম ও ডান কোনও সরকারই সমস্ত রুট ও পর্যাপ্ত বাস চালানোর কথা ভাবেনি। তাই দূরপাল্লা ও লোকাল মিলিয়ে চিহ্নিত রুটের প্রায় অর্ধেক বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নিগমের সিটু অনুমোদিত এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সম্পাদক জগতজ্যোতি দত্ত অবশ্য বলেছেন, “নব্বইয়ের দশকে সংস্থার সচল বাসের সংখ্যা ছিল ৯৯৭টি। এখন তা কমে চারশোর কিছু বেশি দাঁড়িয়েছে। বহু লাভজনক রুট বন্ধ। অথচ সংস্থাকে ঘুরে দাঁড় করানোর কথা বারেবারেই ঘোষমা করা হচ্ছে। বাস্তবে লাভজনক রুটে গাড়ি চালানোর সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে না বলে উদ্বেগে রয়েছেন কর্মীরা। ভুগছেন যাত্রীরা।”
নিত্যযাত্রীদের অভিজ্ঞতা কেমন?
এনবিএসটিসি
• ২ এপ্রিল ১৯৪৫ মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের আমলে তিনটি বাস নিয়ে পরিষেবার সূচনা
• নাম ছিল কোচবিহার স্টেট ট্রান্সপোর্ট
• সচল বাস ৪১০
• মেরামতযোগ্য অচল বাস ৬৩
• নতুন সরকার আসার পর বাস কেনা হয়েছে ৩৫টি
• মোট রুটের সংখ্যা ৪৪০
• বন্ধ রুট ২০০
• এক দশকে সচল রুট বন্ধ হয়েছে ১৫০টি
• কর্মী ৩ হাজারের বেশি।
• বেতন দিতে গড় খরচ ৮ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা
• তেল যন্ত্রাংশ সহ আনুষঙ্গিক খরচ ৫ কোটি
• রাজ্য ভর্তুকি বাবদ দেয় প্রায় ৬ কোটি
• টিকিট বিক্রিতে সাম্প্রতিক আয় ৫ কোটি টাকা
• এক বছরের বেশি টাকা না মেলায় বকেয়া ১৬ কোটি
• অবসরপ্রাপ্তের সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি
• পেনশন খাতে প্রায় ১৪ কোটি।
ডিপোর হাল
ইসলামপুর
গ্যারেজে পাম্প আছে তেল নেই। গাড়ি ঠিক করার পরিকাঠামোও নেই। ৭টি রুটে ১০টি গাড়ি চলে। বেহাল রাস্তার কারণে রায়গঞ্জ যাওয়ার বাসটি রায়গঞ্জের পরিবর্তে পুর্ণিয়া মোড় ও কোচবিহার যাওয়ার বাসটি শিলিগুড়ি পর্যন্ত চলে। মোট ১৭টি বাস। ৭টি অকেজো।
রায়গঞ্জ
২২টি লাভজনক রুটে বাস বন্ধ। আয় কমছে। মোট কর্মী ৩০০। চালক ও কনডাক্টারের ৫০টি পদ ফাঁকা। ৩০টি বাস বিকল হয়ে রয়েছে। তিন বছর আগে গড়ে মাসে আয় ৩ লক্ষ টাকার উপরে থাকলেও তা কমে সওয়া দুলক্ষ টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে।
আর্থিক সঙ্কটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী যন্ত্রাংশ কেনা সম্ভব হচ্ছে না। আগের বাম সরকারের গাফিলতিতে এমন বেহাল দশা। আমাদের সরকার বিকল বাস সারাবে।
তিলক চৌধুরী, পরিচালন সমিতির সদস্য ও তৃণমূল নেতা

এনবিএসটিসি আমাদের সময় ভালই চলেছে। লোকসান হলেও রুট বন্ধ হয়নি। পরিচালন ক্ষেত্রে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে মরিয়া তৃণমূল। এখনও কেন পূর্ণ সময়ের চেয়ারম্যান নিয়োগ করতে পারল না রাজ্য সরকার?
অপূর্ব পাল, জেলা বামফ্রন্টের সচিব।
ফাইল-বন্দি উদ্যোগ
১. ৬০৭ জন কর্মীর স্বেচ্ছাবসরের আবেদন কার্যকর করে পাওনা মেটানো।
২. পরিত্যক্ত জমি ব্যবহার করে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা।
৩. ডিপোর ফাঁকা জায়গায় পেট্রোল পাম্প, এটিএম বসানো।
৪. নানা নয়ছয়ের তদন্তের আশ্বাস।
তুফানগঞ্জ-কোচবিহার নিত্যযাত্রী সংগঠনের সভাপতি প্রতীক রায় বসুনীয়া বলেন, “আমাদের রুটে নন স্টপ বাস চালানো হচ্ছিল। দারুণ চলছিল। হঠাৎ তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কমেছে সাধারণ বাসের সংখ্যাও। যে সব বাস চলছে তাও মাঝপথে বিকল হয়ে পড়ছে। সংস্থার কর্তাদের বহুবার বলেও লাভ হয়নি।”
দিনহাটা মহকুমা ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক রাণা গোস্বামীও বাস রুট বন্ধ হওয়ায় ক্ষুব্ধ। তিনি এই প্রসঙ্গে বলেন, “চৌধুরীহাট-আদাবাড়ি-কুর্শাহাটের মত গ্রামীণ রুটে পরিষেবা অনিয়মিত। শালমারার বাস বন্ধ। নেই কোচবিহার-দিনহাটা রুটে ১০ মিনিট অন্তর বাস পরিষেবা। এ ছাড়া ভোগান্তি বেড়েছে নাটাবাড়ি-দেওচড়াই-চ্যাংরাবান্ধার রুটের যাত্রীদেরও। কারণ বাস চলছে না। সরকারি বাস পরিষেবা বন্ধ ধুবুরি-বঙ্গাইগাঁও-শিলাপাথার-নগাঁও, তেজপুর-গুয়াহাটি,পটনা-রাঁচি-কলকাতার মত দূরপাল্লার বহু রুটেই কমে গিয়েছে বাস।
শুধু নিত্যযাত্রীদের পরিষেবা নয়, সময়ের সঙ্গে নিগমের আধুনিকীকরণ হয়নি বলেও ক্ষোভ রয়েছে। বহু ভিন রাজ্যের সরকারি পরিবহণ সংস্থারই নিজস্ব ওয়েবসাইট রয়েছে। সেখান থেকে অনলাইনেও বাসের টিকিট বুক করা যায়। উত্তরবঙ্গে যেহেতু দেশ-বিদেশের বহু পর্যটকদের আনাগোনা রয়েছে তাই এনবিএসটিসি-রও এ ধরনের পরিষেবা চালু করা উচিত বলে মনে করেন বাসিন্দাদের একাংশ। নিগমের চেয়ারম্যান গৌতমবাবু বলেন, “নিগমের পরবর্তী মিটিংগুলিতে এ নিয়ে আলোচনা করা হবে।”





First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.