|
|
|
|
বাতাসেরই বিষকণায় ক্যানসার, দূষণ-শীর্ষ কলকাতা এখন ত্রাস
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
বাতাসেই বিষ কলকাতার! সে কারণেও ফুসফুসের ক্যানসারের অন্যতম আঁতুড়ঘর এই শহর। দীর্ঘদিন ধরেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু-র নতুন ঘোষণায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে এ কথা। তাদের বক্তব্য, বাতাসের দূষণও ক্যানসারের অন্যতম প্রধান কারণ। হু-র এই হুঁশিয়ারিতে এ বার কি হুঁশ ফিরবে কল্লোলিনীর?
সেজেগুজে সুন্দরী হবে, নজর কাড়বে বিশ্বের এ স্বপ্ন দেখতেই পারে কলকাতা। কিন্তু বায়ুদূষণের সঙ্গে ক্যানসারের যোগাযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরে বিজ্ঞানী থেকে পরিবেশবিদ, সকলেই এক সুরে বলছেন, আগে নির্মল হোক কলকাতার হৃদয়। স্বচ্ছ হোক তার ফুসফুস। কারণ এই মুহূর্তে সেটাই সব চেয়ে বেশি জরুরি। বায়ু দূষণে দীর্ঘদিন ধরেই দেশের এক নম্বর জায়গাটিতে ঘাঁটি গেড়ে রয়েছে কলকাতা।
জেনেশুনে যাঁরা বিষাক্ত ধোঁয়া নেন ফুসফুসে, তাঁদের জন্য উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় ধূমপানবিরোধী প্রচার এ রাজ্যে কম হয়, এমনটা নয়। তবু ফুসফুসের ক্যানসারে কলকাতাবাসীই আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। এত দিন এটাই ছিল আক্ষেপ। কিন্তু এখন এটা স্পষ্ট, ধূমপান যাঁরা করেন না, তাঁদেরও প্রতিটি প্রশ্বাসে ঢুকে পড়ছে এমন সব কণা যা ক্যানসার ঘটায়। বিজ্ঞানীদের ভাষায় কার্সিনোজেন।
হু-র এই রিপোর্ট গভীর দুশ্চিন্তায় ফেলেছে কলকাতাকে। এই শহর ইতিমধ্যেই গোটা দেশে ফুসফুসের ক্যানসারের অন্যতম প্রধান আঁতুড়ঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের গবেষণাতেও স্পষ্ট, ফুসফুসের ক্যানসারে কলকাতা দেশের অন্য মেট্রো শহরগুলোকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। দিল্লিতে প্রতি লক্ষ জনসংখ্যায় ১৩ জনের ফুসফুসে ক্যানসার দেখা গেলে, কলকাতায় এই ক্যানসারে ভোগেন ১৮ জনের বেশি।
ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে ক্যানসারের এই বিপদ তুলনায় অনেক বেশি। হু-র তরফে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল, ২০২০ সালের মধ্যে ভারতে প্রতি পরিবারে এক জন ক্যানসার রোগী থাকবেন। চিকিৎসকদের মতে, সচেতনতার খামতিতে এ দেশে দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রেই ক্যানসার ধরা পড়ে, রোগ অনেক দূর ছড়িয়ে পড়ার পরে। যেমন পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক রোগীর ক্যানসার ধরা পড়ে। শেষ পর্যায়ে আসায় তাঁদের ৪০ শতাংশকেই এক বছরের বেশি বাঁচানো যায় না। হু-র রিপোর্টে ক্যানসার ও বায়ুদূষণের প্রত্যক্ষ সংযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরে বাতাসে লুকিয়ে থাকা খলনায়কটিকে চিনতে সমস্যা হচ্ছে না চিকিৎসকদের।
হু-র ক্যানসার সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার (আইএআরসি) ঘোষণা করেছে, ফুসফুসে ক্যানসারের মোক্ষম উপাদান (গ্রুপ ওয়ান কার্সিনোজেন) হিসেবে দূষিত বায়ু রয়েছে প্রথম সারিতেই। এবং তা ধূমপানের মতোই মারাত্মক। মূত্রাশয়ে ক্যানসারের ঝুঁকিও যথেষ্ট এই দূষণে।
আইএআরসি-র এক সম্মেলনে জড়ো হয়েছিলেন দুনিয়ার তাবড় বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদরা। বায়ুদূষণের বিভিন্ন উপাদান নিয়ে এর আগেও পরীক্ষা করেছিল আইএআরসি। কিন্তু এ বারই প্রথম বায়ুদূষণকে সরাসরি ক্যানসারবাহী দুশমন সাব্যস্ত করেছে তারা। হু-র তরফে একটি বিবৃতিতে আইএআরসি-র মোনোগ্রাফ শাখার প্রধান কার্ট স্ট্রেফ বলেন, “দূষিত বায়ুতে শ্বাস-প্রশ্বাস ক্যানসারে মৃত্যুর একটা বড় কারণ।” তথ্য বলছে, ২০১০ সালে বিশ্বের ২ লক্ষ ২৩ হাজার মৃত্যুর পিছনেই রয়েছে বায়ুদুষণজনিত ক্যানসারের থাবা।
অতীতে আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাতেও দেখা গিয়েছিল, ১৩২টি দেশের মধ্যে ভারতের শহরগুলোর বায়ু সব থেকে দূষিত। পরিবেশবিদদের দাবি, দূষণের ফলেই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাংশে আকাশের রং পাল্টে গিয়েছে। তীব্রতা হারিয়েছে শীতের কামড়। কমেছে তার মেয়াদও।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, সামগ্রিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গের আকাশও এখন দূষণজনিত ‘ব্রাউন ক্লাউড’-এর আস্তরণে চাপা পড়ে গিয়েছে। সায়েন্টিফিক অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর পরিসংখ্যান বলছে, বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্ম ধূলিকণার ভাঁড়ার উপচে পড়ছে কলকাতায়। দিল্লি ও মুম্বইয়ের তুলনায় কলকাতায় এই বিষের পরিমাণ দ্বিগুণ। অর্থাৎ, কলকাতায় সাধারণ নাগরিকেরা প্রতি মুহূর্তে যে বায়ুতে শ্বাস নিচ্ছেন, তার মাধ্যমেই মারণ রোগ তিলে-তিলে বাসা বাঁধছে শরীরে। ক্যানসার চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের মতে, ধূমপান ও জিনগত কারণ ছাড়া, বায়ুদূষণই ভারতের মতো দেশে ক্যানসারের সব থেকে বড় কারণ।
কলকাতায় এই দূষণের নেপথ্যে যানবাহনের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় সরকারের পেটেন্টপ্রাপ্ত পরিবেশ-প্রযুক্তিবিদ সোমেন্দ্রমোহন ঘোষ। কলকাতার পরিবেশের ছবিটা তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর বক্তব্য, এ শহর প্রথম বিশ্বের শহরগুলোর কার্যত উল্টো পথে হাঁটছে। ইউরোপে ডিজেলের গাড়ি গুটিকয়েক। এ শহরে অর্ধেক গাড়িই চলে সস্তার ডিজেলে। যাকে এক কথায় ক্যানসারের বাহক বলা যায়। নাইট্রোজেন অক্সাইড, বেঞ্জিন, কার্বন-মনোক্সাইড ও শ্বাসবাহিত ধূলিকণার রমরমিয়ে চাষ কলকাতার ডিজেল-পোড়া বাতাসে। দেড় দশকের পুরনো গাড়ির প্রতি কলকাতার মমত্বও বিপদের আর এক বড় কারণ।
কাউকে না চটানোর রাজনীতি আর যানবাহন ও পরিবেশের প্রতি অবহেলায় ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। ফুসফুসের রোগবিশেষজ্ঞ পার্থসারথি ভট্টাচার্যের দাবি, শুধু ক্যানসার নয় এ দেশের মেট্রো শহরে ফুসফুসের উপরে ঝড়ঝাপটা বেড়েই চলেছে। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির পথে মোক্ষম কাঁটা বায়ুদূষণ। ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় সেই সঙ্গে মনে করাচ্ছেন, শিল্পজনিত দূষণ, কলকারখানার ধোঁয়া বা পাড়াগাঁয়ে উনুনের ধোঁয়ার দূষণের বিপদের দিকগুলোও। সুবীরবাবুর বক্তব্য, হু-র ঘোষণার পরে এ বার হয়তো সাধারণ মানুষকে সঙ্কটটা বোঝাতে কিছুটা সুবিধা হবে।
হু-র রিপোর্টের ফলে এ দেশের ক্যানসার সচেতনতা কর্মসূচিগুলির খোলনলচে পাল্টানো যে কতটা জরুরি, সেটাও এখন স্পষ্ট। ক্যানসার ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া-র পশ্চিমবঙ্গ শাখার প্রধান সুতপা বিশ্বাস যেমন মানছেন, পয়লা নম্বর শত্রু হিসেবে ধূমপানকে নিয়েই এত দিন তাঁদের বেশি মাথাব্যথা ছিল। এ বার গুরুত্বের অভিমুখ বিস্তৃত করে বায়ুদুষণের উপরেও জোর দিতে হবে। চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা জয়দীপ বিশ্বাসও কলকাতার ‘ভয়াবহ পরিস্থিতি’ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাঁর মতে, “বাতাসে বিষ ছড়ানো রুখতে নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা ছড়ানো ছাড়া অন্য রাস্তা নেই।” রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীও এ দিন বলেন, “বায়ুদূষণের বিপদটা অজানা ছিল না। কিন্তু হু-র ঘোষণায় দুশ্চিন্তা আরও বাড়ল।” সমস্যার মোকাবিলায় রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর অচিরেই দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে বলে জানিয়েছেন তিনি। |
|
|
|
|
|