নদীগর্ভে জমে আছে শতাধিক জাহাজ, সঙ্কটে হুগলি জলপথ
মা মনসার কোপে চাঁদ সদাগরের সপ্তডিঙা ডুবে গিয়েছিল। কপালকুণ্ডলায় রসুলপুর নদীতে ডুবেছিল নবকুমারের বজরা। সে সব অনেক কাল আগের কথা। হালে ডুবল এম ভি বিঙ্গো। কলকাতা-হলদিয়া-সাগরদ্বীপের মধ্যে এ রকম প্রায় ১১৫টি জাহাজের ধ্বংসাবশেষ বা রেক জমে রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। কলকাতা বন্দরের নথিপত্র ঘেঁটেই এই হিসেব মিলেছে।
১৮৭০ সালে কলকাতা পোর্ট কমিশন তৈরি হয়। তখন থেকেই হুগলি জলপথ সংক্রান্ত রেকর্ড রাখা শুরু করে তারা। তখনও বেশ কিছু পুরনো জাহাজডুবির ঘটনা তারা নথিভুক্ত করতে পেরেছিল। বন্দর সূত্রের খবর, সাগরের স্যান্ডহেড থেকে কলকাতা পর্যন্ত ২১২ কিলোমিটার লম্বা জলপথে ১১৫টি জাহাজের খোল নদীতে ডুবে রয়েছে। এর মধ্যে তিনশো বছরের পুরনো কাঠের তৈরি সওদাগরি ময়ূরপঙ্খী নৌকোও আছে। তেমনই রয়েছে এম বি ধনলক্ষ্মী বা এমভি ট্যালেন্টের মতো বড় জাহাজও। তার উপরে ক্রমান্বয়ে জমছে বালি-পলি। কলকাতা-হুগলি পাইলট গিল্ডের সভাপতি ক্যাপ্টেন পি সহায় বলছেন, “বিশ্বে এমন ঝুঁকিপূর্ণ নদীপথ আর দু’টি নেই। ২১২ কিলোমিটার হাইওয়েতে যদি শতাধিক ভাঙা গাড়ি পড়ে থাকে আর এঁকেবেঁকে চলতে হয়, তা হলে কেমন হবে?” বন্দরের কর্তাদের বক্তব্য, দ্রুত ওই সব রেক তোলার ব্যবস্থা করা না হলে ভবিষ্যতে সমূহ বিপদ।
ভারতে কলকাতা এবং হলদিয়াই কেবলমাত্র নদীবন্দর, যাতে জাহাজ চলে। বাকি সবই সমুদ্রবন্দর। হুগলি নদীর নাব্যতা কমায় এমনিই বড় জাহাজ ঢোকা ক্রমশ কমছে। পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতি ঘুরে না দাঁড়ানোয় বন্দরগুলি গুরুত্ব হারাচ্ছে। তার উপরে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে এই ঝুঁকিপূর্ণ নদীপথ।
এমনিতেই সাগর থেকে কোনও জাহাজ কলকাতা বা হলদিয়ায় আসার সময়ে বন্দরের নিজস্ব পাইলটের দিকনির্দেশ নিয়েই আসে। দেশি-বিদেশি কোনও জাহাজকেই পাইলট ছাড়া সরাসরি বন্দরে আসার অনুমতি দেওয়া হয় না বলে জানাচ্ছেন বন্দর-কর্তারা। এক বন্দর-কর্তার কথায়, “হুগলি নদীর মধ্যে রয়েছে অজস্র রেক আর বালির স্তূপ। বন্দরের পাইলটরাই একমাত্র এ সব পেরিয়ে জাহাজপথটি চিনতে পারেন।” এখন পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে শতাধিক রেক না সরালেই নয়। সম্প্রতি এম ভি বিঙ্গো নামে চিনের জাহাজটি হলদিয়ায় ডুবে যাওয়ার পরে বিষয়টা নতুন করে মাথা তুলেছে। এক বন্দর কর্তার কথায়, “এখনই যদি জলপথে ডুবে থাকা শতাধিক জাহাজ সরানোর ব্যবস্থা না হয়, দুর্ঘটনার ভয়ে কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরে জাহাজ আসা আরও কমে যাবে।”
রেক তোলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না কেন? তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী জাহাজ মন্ত্রক এবং বন্দর-কর্তাদের গা-ছাড়া মনোভাবের দিকে আঙুল তুলছেন। “কেন্দ্র এবং বন্দর কর্তৃপক্ষ, উভয়েই উদাসীন। ডুবে থাকা জাহাজগুলি তুললে নদীপথ নিরাপদ হত। পুরনো জাহাজ নিলাম করা যেত। কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি।” কলকাতা বন্দরের চেয়ারম্যান রাজপাল সিং কাহালোঁ টাকার অভাবের কথা বলছেন। “পুরনো রেক বড় সমস্যা ঠিকই। কিন্তু তা সরানো চাট্টিখানি কথা নয়, সে টাকাও আমাদের নেই।”
অথচ ভারতের বন্দর আইনে বলা আছে, কোনও জাহাজডুবির পরে যদি সেই কাঠামো ভবিষ্যতে জাহাজ চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে, তা হলে ওই জাহাজের মালিক এবং বিমা সংস্থাই জাহাজটি জল থেকে তুলে দেবে। এ দেশের ১১টি বড় বন্দর এবং বিদেশের বন্দরগুলিতে নিয়ম খাতায়কলমে এটাই। ইতালির টাসকান দ্বীপের কাছে ডুবে যাওয়া বিশাল যাত্রীজাহাজ কোস্টা কনকর্ডিয়ার রেক তোলার কাজ যেমন শুরু হবে আগামী গ্রীষ্মে। কিন্তু কলকাতা বন্দর সূত্রে খবর বিদেশি জাহাজের মালিক বা অনামী বিমা সংস্থা এক বার জাহাজডুবির পর নাবিকদের ফিরিয়ে নিতে পারলে আর জাহাজ তোলার আগ্রহ দেখায় না।
ঘটনাচক্রে কলকাতা বন্দরে এক সময় অনামী বিমা সংস্থার জাহাজের আনাগোনাই ছিল বেশি। ২০০৫ সালে ভিয়েতনামের দু’টি জাহাজ সিগাটিকা বিরু এবং ফরচুন কেরিয়ার হুগলি নদীতে ডুবেছিল। তারা আজও স্যান্ডহেডে ডুবেই রয়েছে। মালিক বা বিমা সংস্থার পাত্তা মেলেনি। তবে বন্দর কর্তারা জানাচ্ছেন, জাহাজ মন্ত্রকের কাছে এ নিয়ে হইচইয়ের পর অবস্থা কিছুটা বদলেছে। এখন নামী বিমা সংস্থার সঙ্গে নথিভুক্ত না থাকলে কলকাতা বা হলদিয়ায় জাহাজ ঢোকানো হচ্ছে না।
হালে ডুবে যাওয়া এম ভি বিঙ্গো তেমনই একটি জাহাজ। কাহালোঁ জানান, বিঙ্গোর মালিককে জাহাজ তোলার জন্য বলা হয়েছে। জাহাজের বিমা সংস্থাও তাতে নীতিগত ভাবে রাজি হয়েছে। বন্দর সূত্রের খবর, চাপ বজায় রাখতে ১৮ জন নাবিকের ১৪ জন দেশে ফিরতে পারলেও জাহাজ না-তোলা ইস্তক বাকি ৪ জনকে ছাড়া হবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
কিন্তু বাকি রেকগুলোর কী হবে? ১৯৯৮-এ বিড়লাপুরের কাছে হুগলি চ্যানেলের মধ্যিখানে গ্রিন ওপাল নামে একটি জাহাজ ডুবেছিল। দু’বছর পর সেটি তোলা হয়। কিন্তু ১৯৯৭-এ ডোবা এম ভি ট্যালেন্ট বা এম ভি প্ল্যানেট আজও ডুবে রয়েছে। জাহাজ দু’টি অনেক দিন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তার পরে এক দিন তখনকার সিনিয়র পাইলট মাথুরের একটি জাহাজ ডুবে থাকা ট্যালেন্ট-এর মাস্তুলে ঠোক্কর খায়। তখনই জানা যায়, এম ভি ট্যালেন্টের অবস্থান। বয়া দিয়ে ঘিরে ফেলা হয় সেটি। সেই বয়া এখনও রয়েছে। কিন্তু রেক তোলা হয়নি।
মেরিন বিভাগের কর্তারা জানাচ্ছেন ১১৫টি জাহাজের মধ্যে অন্তত ৩০-৩৫টি রয়েছে স্রেফ সাগরের স্যান্ডহেডেই। যেগুলির অধিকাংশই ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে গিয়েছে। এ ছাড়া গাদিয়াড়া-গেঁওখালি-নূরপুর এলাকায় রূপনারায়ণ, হলদি আর হুগলি নদীর সংযোগস্থলও (জাহাজি মহলে যা হুগলি পয়েন্ট বলে খ্যাত) জাহাজডুবির কারণে কুখ্যাত। এখানে অন্তত ১৫টি জাহাজ ডুবে রয়েছে। বন্দর-কর্তাদের মতে, তিন নদীর সঙ্গমে বালির চোরা স্তূপ রয়েছে। এক সময়ে এর নাম ছিল মকরাপট্টি বালির স্তূপ। প্রায় দেড়শো বছর আগে ‘জেমস অ্যান্ড মারে’ নামের একটি বিশালাকার জাহাজ এই বালির স্তূপে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়। তার পর থেকে এই অঞ্চলের নাম হয়ে গিয়েছে ‘জেমস অ্যান্ড মারে স্যান্ড’। তার উপরে বন্দর-কর্তারা জানাচ্ছেন, সাগর থেকে কলকাতা আসার সময়ে গেঁওখালির কাছে প্রায় নব্বই ডিগ্রি বাঁক নিতে হয়। সেখানেও অনেক জাহাজ ডোবে। সর্বশেষ ২০১০ সালে কলকাতার দিক থেকে আসা ‘টাইগার রিভার’ হুগলি পয়েন্টে ‘গ্রিন ভ্যালি’ নামের একটি জাহাজকে ধাক্কা মেরেছিল। বড় কাছি নিয়ে এসে সে যাত্রা জাহাজ দু’টিকে আলাদা করা হয়। বন্দর চেয়ারম্যান বলছেন, “হুগলি পাইলটদের বিশ্বজোড়া নাম এই কারণেই। তাঁরাই একমাত্র সাগর থেকে সব বাধা কাটিয়ে জাহাজ বন্দরে আনতে সক্ষম।”
কিন্তু সেই পাইলটরাই এখন বারংবার বলছেন, রেক তোলা না হলে বড় বিপদ। অথচ সেই উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না বলেই অভিযোগ। উত্তর অতলান্তিকে ১২ হাজার ফুট নীচে টাইটানিক ডুবে রয়েছে ১০০ বছর ধরে। সিনেমার সাফল্যের পর রীতিমতো পর্যটক সমাগম হত সমুদ্রগর্ভে টাইটানিকের রেক দেখার জন্য। পাইলটদের মতে, হুগলি নদীপথে সে বিলাসিতা সাজে না। নদীপথ অবিলম্বে রেক-মুক্ত না করলে জাহাজের সলিলসমাধি ঠেকানো যাবে না!

স্যান্ডহেডে জাহাজডুবি
জাহাজের নাম সাল
এমভি ধনলক্ষ্মী ১৯৭৯
এমভি চাওফং ১৯৮১
এমভি ট্যালেন্ট ১৯৯৭
এমভি প্ল্যানেট ১৯৯৭
এমভি লুকনাম ২০০১
এমভি সেগাটিকা বিরু ২০০৫
এমভি ফরচুন কেরিয়ার ২০০৫



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.