পুস্তক পরিচয় ১...
রাজানুগত্য ও সত্যাগ্রহের জটিল
নৈতিক সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা কোথায়
গাঁধী বিফোর ইন্ডিয়া, রামচন্দ্র গুহ। অ্যালেন লেন, ৮৯৯.০০।
র্তমানের কোনও না কোনও তাগিদ ছাড়া তো অতীতের কোনও নির্মিতিই সম্ভব নয়। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর মতো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের আর একটি নতুন জীবনী লেখার ক্ষেত্রে এই কথাটা আরও খেয়াল রাখতে হয়, শঙ্কা নিরসনের জন্য লেখকের তরফে তাগিদের কথাটা গোড়াতেই বলে ফেলা ভাল, ইচ্ছা হলে কেউ বইটা পড়বেন বা পড়বেন না। কপিবুক ক্রিকেট খেলার এই নিয়ম মেনেই ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ তাঁর গাঁধীজীবনী লেখার কৈফিয়ত জানিয়ে দিয়েছেন, পরে যাতে বখেড়া না বাধে। হাল আমলের ভারতে রাজনীতিতে গাঁধীর চিন্তা ও অভ্যাস প্রান্তবাসী, ফি বছরে ২ অক্টোবর রাজ্যপালের তদারকিতে চরকা কাটার মতো কিছু অনুষ্ঠান সরকারি ভাবে করা হয়, কিছু কিছু সামাজিক আন্দোলনে গাঁধীগিরির জিগির তোলা হয়, টাকায় গাঁধীর মুখ নতুন কায়দায় ছাপা হয়, জাল করাকে ঠেকাতে হবে। এ হেন পরিস্থিতিতে ১৯৯৮-এ আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত অধ্যাপকরূপে পরিবেশ রক্ষা ও চর্চার ইতিহাস পড়ানোর পরিবর্তে খানিকটা জোর করেই রামচন্দ্র গুহ গাঁধীর জীবনকৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে একটি পাঠক্রম পড়াতে শুরু করেছিলেন। পাঠক্রমে যোগ দেয় নানান দেশের বিচিত্র অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কিছু ছাত্রছাত্রী, সবাই অল্পবয়েসি। গাঁধীর সঙ্গে নিয়ত কথোপকথনে তারা আগ্রহী, তাদের নিজেদের জীবন-অভিজ্ঞতাকে তারা গাঁধীর জীবন ও রচনার সাহায্যে ঝালিয়ে নিতে চায়। স্বদেশের গাঁধীচর্চা সম্পর্কে রামচন্দ্র ওয়াকিবহাল। কিন্তু বিদেশের অভিজ্ঞতায় তিনি বুঝতে পারেন যে স্বদেশের বিরাগ, ঔদাসীন্য বা গোষ্ঠী-আগ্রহকে ছাপিয়ে গাঁধী একজন ‘নির্ভেজাল বিশ্ব ব্যক্তিত্ব’, রুজভেল্ট, দ্য গল বা চার্চিলের মতো শুধু ‘জাতীয় নায়ক’ নন। ওই বিশ্বজনীন ব্যক্তিত্বের কৃতি, ঐতিহ্য ও আবেদনের জীবনবৃত্ত রচনা করাই তাঁর প্রকল্প। সেই প্রকল্পের প্রথম খণ্ডটি আফ্রিকানিবাসী গাঁধী কথা।
আপাতদৃষ্টিতে এই জীবনী প্রকল্পটি নতুন ঠেকবে না। রামচন্দ্রও সেটা জানেন। দেশ ও কালের পরিসরে মোহনদাসের জীবনসফরের দৌড় বড় কম লম্বা নয়, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারতের নানা প্রান্তকে সেটা ছুঁয়েছিল। সফরের নামফলকগুলিও রকমারি, আওড়ালেই বোঝা যায়, যেমন মনুয়া থেকে মোহন, মোহন থেকে মোহনদাস, মোহনদাস থেকে লন্ডনফেরত ব্যারিস্টার মিস্টার গাঁধী। এই মিস্টার গাঁধী আফ্রিকায় গিয়ে হয়ে পড়েন একাধারে গাঁধী ভাই, ফিনিক্স আশ্রমের বাপুজি ও সত্যাগ্রহী গিরমিটিয়াদের কর্মবীর গাঁধী। রূপান্তর চলতেই থাকে, দেখা পাই গাঁধী মহারাজ ও মহাত্মার, লোকচৈতন্যে ফুটে ওঠেন গানহী বাওয়া ও রাষ্ট্র-চৈতন্যের ভাষায় ধ্বনিত হয় জাতির জনকের জয়ধ্বনি। এই নামফলকগুলি সময় সময় পরিপূরক, আবার সময় সময় পরস্পরবিরোধী। গাঁধীর জীবনে সব কিছুই খোলামেলা, কোনও লুকোছাপা নেই। পরন্তু নিজের সফরের বিশদ টীকাকার তিনি নিজেই, তাঁর রচনাবলির একশোটি ঢাউস খণ্ড সেই সব টীকাটিপ্পনীতে পূর্ণ। একটা সফর-ক্রমও তিনি নিজের মতো করে ছকে দিয়েছেন। কোনও ঐতিহাসিক সঙ্গতি বা একটানি কার্যকারণ সম্পর্ক তাঁর জীবন সফরে সব সময় প্রত্যাশিত নয়। তাঁর মতে, নিরন্তর সত্য অন্বেষণ বা প্রয়োগই তাঁর আত্মজীবন, সত্য উপলব্ধির জায়মান রূপই তাঁর আপন কথা। গাঁধী-নির্দেশিত জীবনসাধনার সামগ্রিক ঐক্য সন্ধানে গাঁধী শিষ্যরাও পিছিয়ে নেই। তেন্ডুলকর, প্যারেলালের অনুবর্তী নারায়ণ দেশাই চার খণ্ডে গুজরাতি ভাষায় বিশাল গাঁধীজীবনী লিখেছেন, সম্প্রতি তা ইংরেজিতে অনূদিতও হয়েছে, নামকরণেই মেজাজটি স্বপ্রকাশ, ‘আমার জীবনই আমার বাণী’। এই জীবনীর প্রথম খণ্ডটির মূল উপজীব্য তো গাঁধীর আফ্রিকা নিবাস। ১৯৫৭ সালেই গুজরাতিতে চন্দুভাই দালাল একাধিক খণ্ডে দক্ষিণ আফ্রিকায় গাঁধীজীবনের বিবরণ লিখেছিলেন, পরে দিনপঞ্জি ধরে গাঁধীর জীবনভর কর্মকাণ্ডের অনুপুঙ্খ সংকলন করেছেন, সেখানেও আফ্রিকার ‘গাঁধী ভাই’ স্বমাহাত্ম্যে উজ্জ্বল। তাই আজকে গাঁধীজীবনী রচনা করতে বসলেই গাঁধী ছাড়া আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলতে হয়, অনেকের রাগ-বিরাগ-অভিমানের কথা জানতে হয়।
সেই সব কথোপকথন শোনা ও শোনানোর উদ্দেশ্যে সহজলভ্য গাঁধী-কৃত ভাষ্য, টীকা ও রচনাবলি এবং গাঁধী-অনুগামীদের লেখা মহৎ জীবনী ও বিশদ তথ্যপঞ্জি সংকলনের বাইরে রামচন্দ্র নতুন কিছু আকরের অনুসন্ধান করেছেন।
, তিনি গাঁধী-পরিকর, গাঁধী-পক্ষীয় এবং বিপক্ষীয় নানা ব্যক্তির অপ্রকাশিত নিজস্ব রচনাসংগ্রহ দেশবিদেশে খুঁজেছেন। সেই তালিকায় ইজরায়েলের হাইফা-তে রক্ষিত গাঁধী-পরিকর স্থপতি হারমান কালেনবাখ-এর ব্যক্তিগত নথি ও চিঠিপত্রের আর্কাইভসটি নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য; সম্প্রতি ভারতের জাতীয় লেখ্যাগারে এই আকরপুঞ্জটি স্থানান্তরিত হয়েছে।
, গাঁধী ভবন, সবরমতী আশ্রম ও অন্যান্য নানা গাঁধী সংগ্রহালয়ে তৎকালীন নানা মতাবলম্বী পত্রপত্রিকার কর্তিকা-সংগ্রহ তিনি ব্যবহার করেছেন। গণপরিসরে গাঁধীর ঘটনাবহুল জীবনের তাৎকালিক প্রতিক্রিয়া আরও ভাল ভাবে বোঝার পক্ষে সেই কর্তিকা-সংগ্রহগুলি উপযোগী।
, পুরনো কলোনিগুলির নানা মহাফেজখানা ও বিশেষত প্রিটোরিয়ার আর্কাইভস-এ তিনি সরকারি নথিপত্র তন্নতন্ন করে খুঁজেছেন। গাঁধীর আন্দোলনে প্রতিপক্ষদের উদ্বেগ ও অন্তর্দ্বন্দ্বের আন্দাজ আরও স্পষ্ট করা সম্ভব হয়েছে। এই গোত্রের অনুসন্ধানের ফলে এতাবৎকাল অপ্রকাশিত, গাঁধীর লেখা একাধিক চিঠি ও নির্দেশনামার হদিশও রামচন্দ্র তাঁর লেখায় দিয়েছেন।

মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। দক্ষিণ আফ্রিকা, ১৯১৪।
এই সব আর্কাইভস থেকে পাওয়া তথ্যপুঞ্জকে ঝরঝরে গদ্যে তিনটি স্তরে নানা অধ্যায়ে রামচন্দ্র বিন্যস্ত করেছেন। পারিবারিক জীবন, সত্য সাধনা ও সামাজিক সংস্কার এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ত্রৈমাত্রিক সূত্রে তাঁর গাঁধীজীবনীর বুনোটটি তৈরি। এই ত্রিকাণ্ডের সূত্রে নানা ধরনের মানুষ গাঁধীর জীবনে এসেছেন, গাঁধীর আকর্ষণ ও বিকর্ষণে তাঁদের শান্ত নিস্তরঙ্গ জীবনও নানা ভাবে মথিত হয়েছে, তাঁদের নিজস্ব চিঠি, মন্তব্য ও কাজে গাঁধী জীবনী যেন ভিন্ন ভাবে প্রতিফলিত ও প্রতিসরিত হয়েছে। এই প্রতিফলন ও প্রতিসরণকে রামচন্দ্র যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছেন, এইটিই তাঁর লেখা গাঁধী জীবনীর বড় জোর। পূর্বসূরি নারায়ণ দেশাই তাঁর গাঁধীজীবনীতে একটা অধ্যায় জুড়ে আফ্রিকায় গাঁধী-পরিকরদের তথ্যসমৃদ্ধ পরিচয় কথা লিখেছেন, সেই বিবরণে সবাই গাঁধীর ছায়াসঙ্গী মাত্র। পক্ষান্তরে রামচন্দ্র গুহের কলমে গাঁধী-পরিকররা নিজ ব্যক্তিত্বে সমুজ্জ্বল। তাঁদের নিজস্ব মন্তব্য ও কাজে গাঁধী-জীবন ও কৃতি তাৎকালিক পটে নানা বিভঙ্গে প্রোথিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে আফ্রিকায় সত্যাগ্রহের সময় ভারতের নানা জায়গায় জানা ও অজানা লোকদের উদ্যোগে সংগঠিত নানা সমাবেশের চিত্তাকর্ষক বর্ণনা রামচন্দ্রের লেখায় পড়ি। তখন রবীন্দ্রনাথ নিজে একশো টাকা আন্দোলনের তহবিলে পাঠিয়ে সঙ্কোচভরে জানিয়েছিলেন যে বাঙালিরা দক্ষিণ আফ্রিকায় সত্যাগ্রহে বড় একটা আগ্রহী নয়। রামচন্দ্র আরও মনে করিয়ে দিয়েছেন যে গাঁধীর জীবনে পেশায় জহুরি ও ডাক্তার প্রাণজীবন মেটা-র ভূমিকার কথা, হিন্দ স্বরাজ-এ গাঁধীর কথিত পরিপ্রশ্নকারী খুব সম্ভবত তিনিই, প্রশ্ন না করে কোনও কিছু মানতে তিনি গররাজি ছিলেন। আবার ব্যক্তিগত চিঠিপত্রে ১৯০৯ থেকেই তিনি গাঁধীকে ‘মহাত্মা’ বলে উল্লেখ করতেন। এই খবরও পাই যে ঐতিহাসিক মেহরোত্রা গাঁধীর ‘আজীবন অনন্য মিত্র’ প্রাণজীবনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখা প্রায় শেষ করেছেন। এনুগা রেড্ডিও আফ্রিকায় গাঁধীর একনিষ্ঠ সহযোগী থাম্বি নাইডু ও তাঁর স্ত্রী শহিদ বালিয়াম্মার চরিতকথা রচনা করেছেন। এঁদের দেওয়া নানা তথ্য রামচন্দ্র তাঁর কথনে ব্যবহার করেছেন, কেননা গাঁধীর জীবন আখ্যানে তো বারবার অনেক সাধারণ লোকও বিশেষ ক্ষণে মহাকালের রথের সারথি হয়েছিলেন।
তাৎকালিকতা খোঁজার সূত্রই রামচন্দ্র হিন্দ স্বরাজ-এর এক আদি ভারতীয় পাঠক শামসউদ্দিন কাদরি-র প্রতিক্রিয়া পুরোপুরি উদ্ধৃত করেছেন, তৎকালীন বম্বে সরকারের এই নগণ্য আমলার প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই হিন্দ স্বরাজ বইটি বেরোনো মাত্র ভারতে নিষিদ্ধ হয়, গাঁধীও এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য আবেদন জানান। গাঁধীর আবেদনপত্রটিও রামচন্দ্র এই প্রথম লোকগোচরে এনেছেন। কাদরি গাঁধীকে ‘পাগলাটে’ (crazy) বলেছেন, আর গাঁধী সরকারকে জানিয়েছিলেন যে প্রশাসনকে সাহায্য করার জন্যই হিন্দ স্বরাজ লেখা, মূলত সরকারের বিরুদ্ধে ‘পশুবল’ নিরস্ত করাই বইটির উদ্দেশ্য। তাৎকালিকতার এই দুটো স্বরই আজও গাঁধী আলোচকদের পিছু ছাড়েনি, আভাসে ইঙ্গিতে থেকেই গেছে, টনি ব্লেয়ার আর ঐতিহাসিক পেরি অ্যান্ডারসন-এর সাম্প্রতিক মন্তব্যগুলি তার প্রমাণ।
অবশ্যই বইতে রামচন্দ্র গুহের কিছু নিজস্ব মন্তব্য পাঠকের মনে অস্বস্তি সৃষ্টি করে। কস্তুরবা-গাঁধীর পত্রালাপ প্রসঙ্গে রামচন্দ্র টীকা দিয়েছেন যে হিন্দু ধর্ম ও প্রথার নিরঙ্কুশ বিধান হল যে স্বামীর মৃত্যুর আগে কখনওই স্ত্রীর মৃত্যু হওয়া উচিত নয়, সেটা নাকি ‘অকর্তব্য’! (পৃ ৩০৮)। তাঁর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সামাজিক দৃষ্টান্ত রূপে অবিবাহিত ভীষ্মের ব্রহ্মচর্যই বিবাহিত গাঁধীর ব্রহ্মচর্যের আদর্শ বলে বিবেচিত হয়েছে, গাঁধী সেই দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বলে মনে হয়। (পৃ ১৯৭)। অথচ মহাভারতীয় ঐতিহ্যে ভীষ্মের ব্রহ্মচর্য কোনও গৃহস্থের আদর্শ নয়, কুলধর্ম পালনে সেটা নানা ঝামেলার সৃষ্টি করেছিল। লোকবিশ্বাসেও ‘ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা’ ব্রহ্মচর্যের আদর্শের দ্যোতক নয়, বরং অনমনীয়, একগুঁয়ে মনোভাবের পরিচায়ক। রামচন্দ্র গুহের লেখায় উপমান ও উপমেয়কে খাপে খাপে বসাবার চেষ্টা আছে, একাধিক বার প্রাণজীবনকে এঙ্গেলস-সদৃশ বলা হয়েছে, মার্কস-এর এঙ্গেলস-এর মতোই তিনি একাধারে গাঁধীর শিষ্য ও পোষ্টা। অথচ সৌভাগ্যক্রমে এঙ্গেলস-এর একাধিক জীবনী লেখা হয়, এই পোড়া দেশে প্রাণজীবন প্রায় অজ্ঞাত থাকেন। এমনিতে সঙ্গত আক্ষেপ, তবে এঙ্গেলস নিজগুণেই দুরন্ত ঐতিহাসিক, তাত্ত্বিক ও সম্পাদক, অনেকগুলি চিরায়ত গ্রন্থের একক রচক। আর যাই হোক, প্রাণজীবন নিজে সে রকম গ্রন্থকার ছিলেন না, সত্যাগ্রহের উপর পুস্তিকা লিখেছিলেন।
এহ বাহ্য। ভূমিকায় রামচন্দ্র গুহ জানিয়েছেন যে গাঁধীর আফ্রিকা জীবন কেবল ভারতীয় গাঁধীর কর্মকাণ্ডের নিছক প্রস্তুতিপর্ব নয়, বরং তার স্বতন্ত্র মর্যাদা আছে। গাঁধীর এই পর্বের কর্মকাণ্ডকে তিনি মাঝে মাঝেই ‘Diasporic Nationalism’ বা গেড়ে বসা অভিবাসী জাতীয়তাবাদ বলে আখ্যা দিয়েছেন, এটি বিশ্বমুখী। নিছক এই ধরনের আলগা অভিধায় অবশ্যই গাঁধীর চিন্তন ও কর্মের স্বরূপ নির্ণয় হয় না, কারণ আজকের বিশ্বে ইজরায়েলি জিয়োনিজম বা সিংহলে জঙ্গি তামিল অভিবাসী জাতীয়তাবাদের চরিত্র রামচন্দ্র ভাল ভাবেই জানেন। তাঁর লেখা গাঁধীজীবনী পাঠে এই ধারণা হয় যে বিশ শতকের প্রারম্ভে বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যের প্রেক্ষিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনটি সত্তার অবস্থিতি স্পষ্ট ছিল। বর্ণবিদ্বেষী প্রভুমন্য আফ্রিকানিবাসী ওলন্দাজ বা বুয়রদের আধিপত্যবাদ, ভারতীয় অভিবাসী তথা এশীয়দের অধিকারসচেতনতা ও নিঃসহায় দেশজ আদিবাসী জুলুদের নিছক টিঁকে থাকার লড়াই ত্রিসত্তার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত। নিঃসন্দেহে অভিবাসীদের অধিকারসচেতনতা ও মর্যাদার সংগ্রামে গাঁধী পথপ্রদর্শক, তাঁর সংগ্রামের ব্যাপ্তি ও গভীরতা দেখবার মতো, আফ্রিকাবাসী চিনারাও ওই আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। সচ্ছল গুজরাতি বানিয়াদের বৃত্ত ছাড়িয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল গরিব-গুর্বো তামিল পরিবারে, খনিশ্রমিক ও সাধারণ মহিলারা ওই আন্দোলনে শামিল হন। এই আড়াআড়ি ও খাড়াখাড়ি সংহতির বাইরে এটি লক্ষণীয় যে গাঁধী সত্যাগ্রহীরা দেশজ জুলুদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন, তাঁদের ভাষাই তাঁরা জানতেন না। ১৯০৬ সালে নিঃসহায় জুলুদের দায়ে পড়ে করা আধাখ্যাঁচড়া বিদ্রোহে গাঁধী পরিচালিত ভারতীয় সেবাদল তাদের সব মানবিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতা সত্ত্বেও বুয়র বাহিনীর সহযোগীর পরিচয়েই কাজ করেছিল। এই সময়পর্বের নৈরাজ্যবাদী ও আধুনিক সভ্যতার কঠোর সমালোচক গাঁধীর কাছে প্রজাধর্মের অবশ্য পালনীয় শর্ত সরকারের প্রতি আনুগত্য। শাসকের বিপদকালে রাজ-আনুগত্যে খামতি ঘটলে প্রজার সত্যনাশ হবে, আর সত্যনাশী প্রজার পক্ষে সত্যাগ্রহ করা সম্ভব নয়। আফ্রিকার পর্বে ও তার পরেও গাঁধীচৈতন্যে প্রজাধর্ম ও রাজ-আনুগত্যের ধারণা বার বার অনুঘটকের কাজ করেছে। রাজধর্ম ও প্রজাধর্মের সম্পর্কের টানাপড়েনে লোকবিশ্বাসে মহাত্মার কাছে প্রত্যাশা ও সত্যান্বেষী গাঁধীর নিজের চিন্তনের ব্যবধান মাঝে মাঝে দুস্তর হয়েছে, গাঁধীর আচরণে আফ্রিকার কিছু পাঠান সহকর্মী ক্ষণকালের জন্যও চরম ভাবে বিক্ষুব্ধ হন। প্রতিটি সময়ক্ষণে এই ব্যবধান নানা ছেদ ও প্রতিচ্ছেদে দীর্ণ হয়েছে। ভক্তি ও আনুগত্য এবং সত্যাগ্রহের জটিল নৈতিক সম্পর্ককে সমস্যায়িত না করলে ঐতিহাসিক তাৎকালিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে আফ্রিকায় মহাত্মা গাঁধীর জীবন-অভিজ্ঞতা বা সত্যাগ্রহ তথা অভিবাসী জাতীয়তাবাদের একালিক বিশ্বজনীন তাৎপর্য বোঝা সম্ভব নয়। এই সুলিখিত তথ্যসমৃদ্ধ গাঁধীজীবনীতে সেই ধরনের কোনও কথোপকথন বা প্রযত্নই রামচন্দ্র করেননি, হয়তো বা পরের খণ্ডে আলোচনা করার জন্য মুলতুবি রেখেছেন। প্রতীক্ষায় রইলাম।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.