|
|
|
|
উদাসীনতায় ঠোক্কর খেয়েই ভোঁতা দূষণ-যুদ্ধের হাতিয়ার
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
বাম জমানায় শহরের রাস্তায় দেদার চলত ‘কাটা তেলের’ অটোরিকশা। পেট্রোল-কেরোসিনের মিশ্রণে তৈরি ওই জ্বালানির দূষণ শহরের বাতাসকে দিন দিন আরও বিষাক্ত করে তুলছিল। বিজ্ঞানী-পরিবেশবিদদের হাজারো আপত্তিতেও প্রশাসন তখন নড়ে-চড়ে বসেনি। শেষমেশ আদালতের নির্দেশে অটোয় কাটা তেল বন্ধ হয়। তার জায়গায় চালু হয় এলপিজি অটো। আশা জেগেছিল, এ বার দূষণের মাত্রাতেও লাগাম পড়বে।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে শাসনক্ষমতায় পালাবদলের পরে অটোরিকশার ‘জ্বালানি-সংস্কার’ থমকে গিয়েছে। এলপিজি-অটোর মতো গায়ে সবুজ রং মেখে এখনও বহু জায়গায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কাটা তেলের অটো। উপরন্তু গাঁয়ে-গঞ্জে হইহই করে চলছে মোটরচালিত ভ্যান-রিকশা (ভ্যানো), যা দেখে প্রমাদ গুনছেন বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদেরা। তাঁদের মতে, ‘ভ্যানো’র ইঞ্জিন প্রভূত দূষণ ছড়ায়। ভ্যানোর প্রতিপত্তি বাড়লে গ্রামাঞ্চলেও দূষণের মাত্রা লাগাম ছাড়াবে।
সব মিলিয়ে এ রাজ্যে পরিবেশ-সচেতনতার ছবিটা একই রকম বিবর্ণ। বিশেষজ্ঞদের একাংশদের আক্ষেপ, রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা অর্জনের তাগিদেই দূষণ রোধের অধিকাংশ উদ্যোগ চাপা পড়ে যায়। তা ছাড়া, বহু ক্ষেত্রে দূষণ ঠেকাতে গিয়ে ভোটব্যাঙ্ককে চটাতে চান না রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এ ক্ষেত্রে ডান-বামে ভেদ নেই! সে কারণে কাটা তেলের অটোর মতোই খোদ শহরের বুকে রমরমিয়ে চলে দূষণ ছড়ানো বহু কারখানা। আর তার খেসারত দিতে দিতে কলকাতা হয়ে উঠেছে দেশের বায়ু-দূষণের ‘রাজধানী।’ এখনও প্রশাসনের হুঁশ না-ফিরলে বায়ু-দূষণের কারণে ফুসফুসের ক্যানসার বা হাঁপানির মতো অসুখ পশ্চিমবঙ্গে মহামারীর চেহারা নিতে পারে বলে আশঙ্কা ওঁদের। |
|
রাজপথে দূষণ। শুক্রবার সুমন বল্লভের তোলা ছবি। |
বস্তুত কলকাতার বায়ু-দূষণের মূল উৎসই ছিল পুরনো গাড়ির ধোঁয়া। ২০০৬-এর এক সমীক্ষায় জানা গিয়েছিল, মহানগরে যত গাড়ি চলে, তার অন্তত ৫৪% পনেরো বছরের পুরনো। সেগুলো থেকে নির্গত ধোঁয়াকে দূষণের ‘আড়ত’ বলা যেতে পারে। পরিবেশবিদদের অনেকে তখন মন্তব্য করেছিলেন, ‘কলকাতা হল গাড়ির বৃদ্ধাশ্রম’! তাঁরা জানিয়েছিলেন, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে যেখানে ৬০ মাইক্রোগ্রামের বেশি ভাসমান ধূলিকণা (পার্টিকুলেট ম্যাটার) থাকা বিপজ্জনক, সেখানে কলকাতায় তার মাত্রা ১০০ মাইক্রোগ্রামের উপরে!
আর এই বিপদের জন্য তাঁরা অনেকাংশে দায়ী করেছিলেন পুরনো গাড়ির রমরমাকে। তদানীন্তন বাম সরকার অবশ্য তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। শেষে ২০০৭-এ পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থ-মামলা করলে আদালত নির্দেশ দেয়, পনেরো বছরের পুরনো সব গাড়ি বসিয়ে দিতে হবে। নির্দেশ পালনের প্রক্রিয়া শুরু হলেও এ পর্যন্ত কত গাড়ি বাতিল করা হয়েছে, তার হিসেব সরকার দিতে পারেনি বলে সুভাষবাবুর অভিযোগ।
সব মিলিয়ে বিপদ মোকাবিলায় সরকারি তরফে গয়ংগচ্ছ মনোভাবটাই স্পষ্ট। হু’র সাম্প্রতিক রিপোর্টের পরেও প্রশাসন সচেতন না-হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলেই আশঙ্কা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তথা পরিবেশ-বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ পুলক লাহিড়ী বলছেন, “আগে জানা ছিল, বায়ু-দূষণের কিছু কিছু উপাদান ক্যানসারের জন্য দায়ী। হু’র গবেষণায় জানা গেল, বায়ু-দূষণ সার্বিক ভাবেই ক্যানসারের কারণ।” বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদেরা মনে করছেন, এই মুহূর্তে সরকারের উচিত যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বায়ু-দূষণ প্রতিরোধের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া। কী ভাবে?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক তথা পরিবেশ ইঞ্জিনিয়ারিং বিশেষজ্ঞ অনুপম দেব সরকার জানাচ্ছেন গাড়ির ধোঁয়ায় থাকা ‘বেঞ্জো এ পাইরিন’ বাতাসকে দূষিত করে। এটি ক্যানসারের অন্যতম প্রধান কারণ। “জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে গাড়ি বাড়ছে। বাড়ছে দূষণ। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা না-কমালে তাই উপায় নেই। সেই সঙ্গে বাতিল করতে হবে পুরনো গাড়ি। এ জন্য সরকারের আরও অনেক বেশি সক্রিয় হওয়া দরকার।” অভিমত অনুপমবাবুর। তাঁর বক্তব্য, অটো ছাড়াও অন্যান্য পরিবহণে এলপিজি ব্যবহার হলে দূষণ কমানো যাবে। |
|
এখানেই উঠছে প্রশাসনিক সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার প্রশ্ন। পরিবহণ দফতরের এক কর্তা যেমন জানান, বেশ কিছু দিন আগে কলকাতা ট্রাম কোম্পানি (সিটিসি) তাদের আড়াইশো বাসে ডিজেলের সঙ্গে ২০% হারে জৈব জ্বালানি (বায়ো ডিজেল) ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। তাতে বাসের কার্বন নির্গমনের হার ৩০% পর্যন্ত কমেছে বলে সিটিসি দাবি করেছিল। কিন্তু সেটা বেশি দিন চলেনি। কেন? সরকারি কর্তাদের কাছে জবাব নেই। আবার নগরায়ণ দফতর-সূত্রের খবর, বছরখানেক আগে রাস্তা সারানোর জন্য পরিবেশ-বান্ধব পদ্ধতি গ্রহণের কথা ভাবা হয়েছিল। সেই মতো দিল্লির একটি সংস্থাকে ডেকে আনা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি।
এমন নানা ঘটনার প্রেক্ষাপটে দূষণ রোধে সরকারি ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। এক পরিবেশবিদের আক্ষেপ, “সরকার ঘটা করে দূষণ-বিরোধী প্রচার করে। অথচ সরকারি রাস্তা তৈরির সময়ই খোলা পাত্রে পিচ গলানো হয়!” বছর কয়েক আগে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে রাস্তার কাজে দূষণ ছড়ানোর অভিযোগে পূর্ত দফতরকে জরিমানা করেছিল দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। সাম্প্রতিক কালে অবশ্য তেমন নজির নেই।
পাশাপাশি রয়েছে নজরদারিতে ঢিলেমির অভিযোগ। পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য ল’ অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, অবৈধ ইটভাটা-চালকল-স্পঞ্জ আয়রনের কারখানার দাপটে বায়ু-দূষণের ঢেউ ইদানীং গ্রামেও থাবা বসাচ্ছে। “এই জাতীয় কারখানার বায়ু-দূষণ শুধু স্বাস্থ্যের নয়, চাষেরও ক্ষতি করে” বলছেন বিশ্বজিৎবাবু। যাদবপুরের মেক্যনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক রণজিৎ চক্রবর্তীও বলেন, “দূষণ-যুদ্ধে শহরের সঙ্গে গ্রামকেও সামিল না-করলে কোনও লাভ নেই।” প্রসঙ্গত, ২০০৪-২০০৫ সালে আমের ফলন বাঁচাতে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় মার্চ থেকে মে পর্যন্ত ইটভাটা বন্ধ করে দিয়েছিল পর্ষদ। তার পরে আর এমন কোনও ব্যবস্থা হয়নি। অভিযোগ, স্পঞ্জ আয়রন কারখানা বা বেআইনি খাদানের দূষণ-কারবারের দিকে প্রশাসনের নজরদারি বিশেষ নেই। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্গত ধোঁয়াও বাতাসে প্রচুর কার্বন কণা মিশিয়ে দিচ্ছে।
কর্তাদের কী বক্তব্য?
পর্ষদের চেয়ারম্যান বিনয় দত্তের দাবি, “শিল্প-কারখানাগুলোয় নিয়মিত নজরদারি চালানো হয়।” কিন্তু বিশ্বজিৎবাবুর মন্তব্য, “চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এখানে পরিবেশ দূষণ রোধের সবচেয়ে বড় বাধা রাজনৈতিক-প্রশাসনিক সদিচ্ছার অভাব।”
তা হলে কি পরিবেশ বাঁচাতে প্রতি বারই আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে?
এমনটাই মনে করছেন প্রাক্তন বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। “এ পর্যন্ত দূষণ রোধের বেশির ভাগ কাজই হয়েছে আদালতের হস্তক্ষেপে” বলছেন তিনি। |
|
|
|
|
|