একবিংশ শতকের ইউরোপ যদি বিংশ শতকের ইউরোপের মুখোমুখি দাঁড়াইত, তাহাকে কী বলিত? বলিত: অতি বাড় বাড়িয়ো না, ইত্যাদি। সে দিনের সেই মহাপ্রতাপান্বিত মহাদেশের আজ বড় করুণ অবস্থা, অবিশ্রান্ত ঝড়ের ঘায়ে তাহার অবয়ব ক্রমশই ন্যুব্জ হইতে ন্যুব্জতর দেখাইতেছে। বাস্তবিক, স্মরণযোগ্য কালের মধ্যে এত করুণ, বিপর্যস্ত, হতাশ্বাস তাহাকে দেখায় নাই। সমীক্ষা বলিতেছে, ২০০৮ হইতে ২০১৩ সালের মধ্যে ইউরোপের জন্মহার বছরে গড়ে সাড়ে তিন শতাংশ কমিয়াছে, অর্থাৎ ইউরোপীয়রা দুর্দশার মুখোমুখি দাঁড়াইয়া শিশুজন্মের বিষয়ে সতর্ক হইয়া পড়িতেছেন। আরও একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, এই মুহূর্তে সেখানে যত লোক চাকরিবাকরি করেন ও যত লোক চাকরি হারাইয়া বা না পাইয়া সরকারি পেনশনভোগী হইয়া বসিয়া আছেন, তাঁহাদের অনুপাত ৪:১, চল্লিশ বছরের মধ্যে অনুপাত ২:১ হইবে। সংখ্যাতত্ত্বের পাশাপাশি চর্মচক্ষুর দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাও আছে। ইউরোপে যে কোনও স্থানে উপলব্ধি করা সম্ভব, গত কয়েক বৎসরের অভূতপূর্ব আর্থিক মন্দায় যে শিল্পের উপর সেখানকার দেশগুলি অতীব নির্ভরশীল হইয়া পড়িয়াছে, সেই পর্যটনশিল্পও কী ভাবে দাঁড়াইয়া আছে প্রধানত এশীয় জনস্রোতের উপর। সামাজিক আচারবিচারও ইহার ফলে পাল্টাইতেছে। বড় ধরনের আর্থ-সামাজিক ওলটপালটে সেই চিরচেনা মহাদেশ এখন উদ্ভ্রান্ত।
মহাদেশব্যাপী বিপুল সংকটের হাল ধরিতে হইলে ইউরোপীয় দেশগুলির সর্বাগ্রে প্রয়োজন জার্মানিকে। সম্ভবত পুনর্নির্বাচিত জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলই এখন মহাদেশের সর্বাধিক বিতর্কিত কিন্তু নির্ভরযোগ্য নেতা। ডুবন্ত দেশগুলির প্রতিটিই অপেক্ষা করিতেছে, মার্কেল আসিয়া হাত ধরিয়া তুলিবেন। কী ভাবে তুলিবেন? ইউরোপের প্রতিটি দেশের ব্যাঙ্ককেই একটি সংস্কার-পদ্ধতির মধ্য দিয়া যাইতে হইবে। দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলি, স্পেন ও ইতালি-সহ, যে ঋণ-সংকটের মধ্য দিয়া যাইতেছে, তাহাতে মার্কেল একটি ব্যাঙ্ক ইউনিয়নের মাধ্যমে বোঝাপড়া না করিলে সমস্যার সমাধান হইবে না, ইহাই সাধারণ বক্তব্য। ই ইউ নেতারা একটি নূতন ইউরো-ব্যাঙ্ক গোষ্ঠী তৈরির দিকে আগাইয়াছেন, যাহার কেন্দ্রে রহিয়াছে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক (ই সি বি)। মুশকিল হইল, অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণে জার্মানির বিশেষ আপত্তি। তাহারা বরং চাহে একটি আলগা ব্যবস্থা যেখানে প্রতিটি দেশের ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে জাতীয় দায় স্পষ্ট থাকিবে।
বৃহৎ অর্থনৈতিক সমস্যা মানেই বৃহৎ রাজনৈতিক সমস্যা। ইতালিতে দেখা গিয়াছে, কী ভাবে প্রধানমন্ত্রী এনরিকো লেত্তা-র সহিত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সিলভিয়ো বের্লুস্কোনি-র শুম্ভনিশুম্ভ সংঘাত লাগিল, শরিকি মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্যের পদত্যাগে পার্লামেন্ট সম্পূর্ণ অচল হইয়া পড়িল। গ্রিস বা পোর্তুগালের মতো দেশ বহু দিন যাবৎ স্থিতিশীল সরকার হারাইয়াছে। যত অর্থ-সহায়তাই জার্মানির মতো দেশের কাছ হইতে তাহারা পাইয়া থাকুক না কেন, সংকটের তুলনায় কোনও অঙ্কই যথেষ্ট নহে। স্পেনের অবস্থাও তথৈবচ। ইহার শেষ কোথায়, অন্তত শেষের পথটি কোন অভিমুখে, তাহা এখনও স্পষ্ট নহে। ইতিমধ্যে হয়তো আরও একটি মন্দার ঢেউ আসিয়া পড়িবে, কিংবা আরও একটি রাজনৈতিক সংকট। এ বড় সুখের সময় নহে, ইউরোপ, তোমার বর্তমান তোমার অতীত গৌরবের রেশ, পুরাতনের কায়াহীন ছায়া আঁকড়াইয়া কোনও মতে আত্মরক্ষা করিতেছে। |