কুঅভ্যাস কি নিজবক্ষে ‘ঐতিহ্য’ লেবেল সাঁটিয়া জাতে উঠিতে পারে? না পারিলে নদীতে প্রতিমা বিসর্জন হয় কেন? পরিবেশ সম্পর্কে কিছুমাত্র উদ্বেগ থাকিলে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার বহু পূর্বেই নদী-জলাশয়গুলিতে প্রতিমা নিরঞ্জন নিষিদ্ধ করিত। এ বৎসর নদীঘাটে বিসর্জিত প্রতিমা অপসারণে কিছু পুর-তৎপরতা দেখা গিয়াছে বটে। ক্রেন দিয়া নদী হইতে প্রতিমার কাঠামো তোলা হইতেছে। ইহাতে নদী বাঁচাইবার চাইতে সরকারি কর্তাদের পিঠ বাঁচাইবার চেষ্টা চোখে পড়ে বেশি। জলে প্রতিমা ফেলিলে দূষণ হইবেই। তাহার পর জল পরিষ্কার করিবার ধুম দেখাইয়া কী হইবে? পরিবেশ রক্ষা করিতে হইলে নদী, পুকুর, নয়ানজুলি, প্রভৃতি কোনও জলাধারেই যাহাতে কোনও প্রতিমা বিসর্জন না হয়, সেই নির্দেশ জারি করা প্রয়োজন। কেন নির্দেশ জারি হয় নাই? তাহার সম্ভাব্য কারণ, এখনও কোনও ব্যক্তি আদালত হইতে নদীবক্ষে বিসর্জন নিষিদ্ধ করিবার নির্দেশ আদায় করেন নাই। তাহা হইলেই সরকার বাধ্য বালিকার মতো ‘কী করিব, আদালতের আদেশ,’ বলিয়া বিসর্জন বারণ করিবে। দায় এড়াইবার এই চেষ্টা প্রশাসকের পরিচয় নহে। আদালত ভর্ৎসনা করা পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে হইবে কেন? জনস্বার্থে কাজ করিতে হইলে জনপ্রিয়তা হারাইবার ভয় করিলে চলে না। বাদ্য বাজাইয়া, আতসবাজি ফাটাইয়া ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন বন্ধ হইলে অনেকেই ক্ষুণ্ণ হইবেন। তাহারা হয়তো সংখ্যাগুরু। কিন্তু সরকারের কর্তব্যটি গুরুতর। পরিবেশ রক্ষার প্রধান ভূমিকা সরকারের। সে কর্তব্যে অবহেলা করিলে চলিবে না।
প্রাচীন কুঅভ্যাস ত্যাগ করিয়া নূতন সুঅভ্যাস তৈরি করাই দুর্গোৎসবের অঙ্গ হইতে পারে। সেই নূতন অভ্যাস কোনও বস্তু সৃষ্টির সময়ে তাহার বিনাশ বিষয়ে চিন্তা। যাহা বর্জনের পর পরিবেশ নষ্ট করিবে, তাহা গ্রহণ করাই চলিবে না। দুর্গাপ্রতিমাটিও এমন উপাদান দিয়া গড়িতে হইবে, যেগুলি জীবাণুবিয়োজ্য, অর্থাৎ যেগুলি পচিয়া সহজেই প্রকৃতিতে মিশিয়া যায়। মন্ডপসজ্জার সকল উপকরণ ‘সুবর্জ্য’ হইবে। পরিবেশচিন্তার এই সুঅভ্যাস নগরজীবনের সর্বত্র প্রসারিত হওয়া প্রয়োজন। বিমানবন্দরগুলিতে ইদানীং বর্জ্য ফেলিবার আলাদা-আলাদা আধার রাখা হয়, যাহাতে প্লাস্টিক, রকমারি ধাতু, কাচ ও খাদ্যসামগ্রীর মতো বিভিন্ন বর্জ্য স্বতন্ত্র ভাবে নিক্ষেপ করা হয়। ইহাতে বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করিয়া তোলা সহজ। নাগরিকও সচেতন হয়। বর্জ্য লইয়া চিন্তার অর্থ, পরিবেশ লইয়া চিন্তা। প্রতিটি রেল-স্টেশনে, মেট্রো স্টেশনে, জনস্থানে বর্জ্য ফেলিবার এমন পৃথক-পৃথক আধার রাখা উচিত। বিদ্যালয়গুলিতে রাখিলে ছাত্রদের পরিবেশবোধ তৈরি হইবে।
সেই সঙ্গে শহরে-গ্রামে নিয়মিত জমা বর্জ্যের অপসারণ এবং পুনর্ব্যবহারের প্রক্রিয়াও চালু রাখিতে হইবে। যে শহরে পথের জমা জঞ্জালই সাফ করিতে পুরসভা হিমসিম খায়, সেখানে এতটা প্রত্যাশা করা যায় কি না, সে প্রশ্ন থাকিবে। কিন্তু চেষ্টা করিতেই হইবে, এবং তাহার নেতৃত্ব দিতে হইবে জননেতাদের। আজকাল শহরের বড় বড় পূজাগুলির সহিত নানা রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংযোগ রীতিমতো বিজ্ঞাপিত হয়। শিল্প-সংস্কৃতির জগতের উজ্জ্বল তারকারাও কোনও কোনও পূজাকে ‘আপন’ করিয়াছেন। এই দাদা-দিদিরা যদি তাঁহাদের পূজাগুলিকে আগাগোড়া পরিবেশবান্ধব করিতে পারেন, এবং পূজার অন্তেও প্রতিমার জলসমাধি না করিয়া কোনও পরিবেশসম্মত, নান্দনিক উপায়ে দেবী-বিদায় করিতে পারেন, তাহা সঙ্গত, সুন্দর হইবে। অথবা তাঁহারা এমন উপকরণে মূর্তি গড়াইতে পারেন, যাহা বিসর্জনের প্রয়োজন নাই। প্রতি বৎসর এক মূর্তির আরাধনা করা হইবে, অথবা ভাস্কর্য বলিয়া তাহা অন্যত্র প্রদর্শিত হইবে। যে কোনও নূতন উদ্যোগ এ ভাবেই শুরু হয়। |