|
|
|
|
অখ্যাত উন্নাও যেন সোনার কেল্লা,
স্বপ্নাদেশ নিয়েই শুরু খনন অভিযান |
অনমিত্র সেনগুপ্ত • উন্নাও (উত্তরপ্রদেশ) |
ওই ওই! ওই তো চকচক করছে!! ওখান থেকেই তো ঠং করে আওয়াজ এল!!
ঘড়ির কাঁটায় বেলা এগারোটা বেজে কুড়ি। ঠিক কুড়ি মিনিট আগেই শুরু হয়েছে স্বাধীন ভারতে সবচেয়ে বড় যখের ধন অভিযান। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের গল্প নয় রীতিমতো আটঘাট বেঁধে সরকারি নির্দেশে, সরকারি খরচে প্রাচীন কেল্লার মাটি খুঁড়ে সোনা খুঁজতে নামা।
বইয়ের পাতায় বা সিনেমার পর্দায় পৃথিবীর তাবৎ গুপ্তধন-কাহিনি মানেই গা-ছমছম, গোপন অপারেশন। তার এমন ‘লাইভ’ সংস্করণ দেখার অভিজ্ঞতা হয় কই? গাঁ-গেরাম ঝেঁটিয়ে তাই জড়ো হয়েছে জনতা। কোলে-কাঁখে সন্তান নিয়ে ঘোমটা টানা গৃহবধূরাও হাজির! হাজির তাবৎ সংবাদমাধ্যম! রাস্তার দু’ধারে বসে গিয়েছে নানা মুখরোচক খাবারের দোকান।
উত্তরপ্রদেশের উন্নাও এলাকার ডৌড়িয়া খেড়া গ্রামে রাজা রামরাও বক্স সিংহের এই দুর্গ চত্বরে এত দিন কে ক’বার এসেছে, জানা নেই। গঙ্গার ধারে জঙ্গল ঢাকা ভগ্ন চত্বরটা ভূতের আড্ডা বলে পরিচিত ছিল। রাতারাতি আজ সেটাই যেন সাক্ষাৎ সোনার কেল্লা। শাবল-গাঁইতি নিয়ে শুরু হয়েছে স্বর্ণ-মন্থন। কোনও জালিয়াত মন্দার বোস নয়, খোদ আর্কিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার (এএসআই) উদ্যোগ। আধুনিক ভারতের ‘গোল্ড রাশ’। সবই স্বপ্নের খেলা!
স্বপন-বুড়োর নাম শোভন সরকার। বাঙালি নন, জাঠ। সাধু-সন্ন্যাসী মানুষ। বহু শিষ্য-ভক্ত ইত্যাদি রয়েছে। মাস তিনেক আগে এই সাধুকেই নাকি স্বপ্ন দিয়েছেন স্বয়ং রাজা রামরাও বক্স সিংহ। সাধুর দাবি, ‘রাও সাহেব’ তাঁর দুর্গ চত্বরে একটি নির্দিষ্ট জায়গা উল্লেখ করে খুঁড়তে বলেছেন। সেখান থেকে মিলবে হাজার টন সোনা! রাজাবাবুর ইচ্ছে, ওই সোনা দেশের কাজে লাগুক! |
|
স্বপ্নাদ্য মাদুলির জন্য হত্যে দিতে দেখা যায় অনেককেই। কিন্তু হাজার টন সোনা মানে তার বাজারদর হবে ৩ লক্ষ কোটি টাকা। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে গচ্ছিত সোনার প্রায় তিন গুণ। অর্থনীতির এই সঙ্কট-মুহূর্তে এমন স্বপ্নকে স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেওয়ার সাধ্যি কার? অতএব কোমর বেঁধে কোদাল, গাঁইতি, ঝুড়ি, খুরপি হাতে নেমে পড়েছে এএসআই-এর ১২ জনের টিম।
স্রেফ স্বপ্নাদেশের ভিত্তিতে এত বড় প্রত্ন-অভিযান? এই ২০১৩ সালে? এএসআই আজ তার প্রেস বিবৃতিতে সরাসরি স্বপ্নাদেশের কথা বলেনি। তারা বলছে, ‘রিপোর্টে’র ভিত্তিতে এএসআই-এর লখনউ সার্কেলকে জায়গাটার প্রাথমিক সমীক্ষা করতে বলা হয়েছিল। তার মধ্যে জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া ৮ অক্টোবর খনি মন্ত্রকের কাছে তাদের একটি সমীক্ষা রিপোর্ট জমা দিয়েছে। তাতে ৬২-৬৫ ফুট নীচে মাটির তলায় ধাতব বস্তুর ইঙ্গিত মিলেছে বলে দাবি করা হয়েছে। তার পরেই খননের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এএসআই।
রাজনৈতিক শিবির থেকে অবশ্য একটা অন্য মতও শোনা যাচ্ছে। অনেকেই বলছেন, কেন্দ্রে কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতরের প্রতিমন্ত্রী চরণদাস মোহান্ত নাকি সাধু শোভনের শিষ্য। সেই জন্যই এএসআই তড়িঘড়ি মাঠে নেমেছে। তবে লখনউ সার্কেলের প্রধান পি কে মিশ্র দাবি করছেন, “আমরা কোনও রাজনৈতিক চাপের মুখে কাজ করছি না। এটা কুষাণ যুগের একটি প্রত্নস্থল। এর আগেও এখানে দফায় দফায় খনন হয়েছে।”
কিন্তু এ সব যুক্তি-তর্ক এখন কে শুনবে? গোটা এলাকা এই মুহূর্তে বিশ্বাস করছে যে, মাটির তলায় সোনা মিলবে। নানা পুরা কাহিনি, জনশ্রুতি হাওয়ায় উড়ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, রাজা রাওয়ের পূর্বসূরিরা ছিলেন বক্সার এলাকার অরগল রাজাদের তালুকদার। পরে তাঁরা নিজেরা রাজা হয়ে বসেন, অরগলদের অনেক সোনাও তাঁদের হাতে আসে। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে নানা সাহেবের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন রাজা রাও। বছর দুয়েক বেনারসে আত্মগোপন করে থাকার পরে ধরা পড়েন। তাঁর ফাঁসি হয়। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় রাওয়ের কেল্লা। সাধু শোভনের স্থানীয় শিষ্য, ওম দাবি করছেন, রাজার সম্পত্তি তখন থেকেই ওই ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়ে আছে।
এত দিন সেই সম্পদের খোঁজ পায়নি কেউ? জনশ্রুতির কাছে এ প্রশ্নেরও উত্তর আছে। কী রকম? রবি ঠাকুরের ‘সম্পত্তি-সমর্পণ’ গল্পে নিজের নাতিকে যক্ষ বানিয়েছিলেন দাদু। আর এখানে রাজা নিজেই নাকি যক্ষ হয়ে বিশাল সম্পত্তি আগলে রেখেছেন। সে সোনা কেউ ছুঁতে পারে না। সে জন্যই নাকি কেউ কেউ মন্দিরের মাঠে বা আশপাশে সোনা কুড়িয়ে পেয়েও তা আত্মসাৎ করার সাহস দেখায়নি। স্থানীয় বাসিন্দা বিপুল জিলিপি হাতে গম্ভীর গলায় বললেন, “যারাই সোনা ভোগ করতে গিয়েছে, তাদের পরিবারকে নানা ধরনের অনর্থ পোয়াতে হয়েছে।”
আজ সেই অভিশপ্ত জায়গা জুড়ে যেন লক্ষ্মীপুজোতেই ধনতেরাসের মেজাজ। বিপুলের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকেই ভেসে এল ধাতব আওয়াজটি। উল্লাসে লাফিয়ে উঠলেন বিপুল। ‘এই বুঝি পাওয়া গেল!’ এএসআই কিন্তু বারবার বলে দিয়েছে, “এত তাড়াতাড়ি কিছু পাওয়া যাবে না। কম করে দু’হপ্তা সময় লাগবে!” কিন্তু ডৌড়িয়া খেড়ার মন তা মানতে চায় না! সে খালি বারবার চমকে চমকে ওঠে। আজই উদ্ধার হবে সোনা এই বিশ্বাসে ভর করেই তো ভোর থেকে কেল্লা প্রাঙ্গণে ভিড় জমিয়েছে মানুষ। বেলা গড়াতেই ভিড় বাড়ার বহরে প্রমাদ গুনেছে পুলিশ। খননস্থলের কাছাকাছি যাওয়া বারণ হয়ে যায়। তবু পুলিশি লাঠি উপেক্ষা করে ভিড় আছড়ে পড়ে কখনও কেল্লার আশপাশে কখনও বা শিবমন্দিরের চাতালে। কেউ কেউ গঙ্গার পাড় ধরে ঘন জঙ্গলেও উঁকি মারার চেষ্টা করেন। যদি দেখা মেলে!
একা ডৌড়িয়া খেড়া-ই বা কেন! সোনা মিলবে ধরে নিয়েই তো সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে ফেলেছেন আইনজীবী এম এল শর্মা। তাঁর দাবি, গোটা খননপ্রক্রিয়া সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে করা হোক। কেন? তাঁর আশঙ্কা, ১৯৭৪ জয়পুরেও বহুমূল্য সম্পত্তি উদ্ধার করেছিল সরকার। এ বারও যদি তাই হয়?
এই স্বর্ণোন্মাদনার পাশাপাশি দেশবাসীর একটা বড় অংশকে অবশ্য তাড়া করছে আর একটা প্রশ্ন। যদি সোনা মেলেও, তাতেই কি প্রমাণিত হবে স্বপ্নাদেশের অকাট্যতা? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত মনোবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক দীপেশচন্দ্র নাথ বললেন, “অবচেতন মনের বিভিন্ন অবদমিত ইচ্ছারই রূপান্তর হয় স্বপ্নে। এই সাধুর ক্ষেত্রেও সে রকম কিছু হয়ে থাকতে পারে। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী যদি মিলে যায়, তা হলে তা শুধুই চান্স কোয়েন্সিডেন্স বা আকস্মিক যোগাযোগের পর্যায়ে পড়বে।” দীপেশবাবুর আরও ধারণা, শুধুমাত্র সাধুর স্বপ্নাদেশকে ভিত্তি করেই এত বড় খননকাজের সিদ্ধান্ত এএসআই নিয়েছে বলে মনে হয় না। পাশাপাশি এটাও ঠিক, “আমাদের দেশ এখনও পূর্ণ ভাবে বিজ্ঞানে আস্থা রাখে না। হতে পারে কোথাও সাধুর প্রতি অবচেতন বা সচেতন বিশ্বাস থেকেই এই সিদ্ধান্ত।”
সাধু নিজে কী বলছেন?
‘মুড়ো হয় বুড়ো গাছ
হাত গোন ভাত পাঁচ’ বা ‘তেঁতুল-বটের কোলে
দক্ষিণে যাও চলে’
গোছের কোনও ধাঁধা কি বাতলেছেন তিনি? আজ ভোর পাঁচটায় খননস্থলে এসেছিলেন। পুজোপাঠ সেরে অন্তরালে চলে গিয়েছেন। গোটা দেশ ‘হা সোনা যো সোনা’ করে হাঁপাচ্ছে, সাধু স্পিকটি নট!
শুধু শিষ্য ওম নিবাত নিষ্কম্প “গুরুজি যখন বলেছেন তখন ওইখানে ঠিক সোনা পাওয়া যাবে। আপনারা মিলিয়ে নেবেন।”
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। চকচক করলেই সোনা হয় কি না, সেটাই শুধু দেখা বাকি।
|
সোনার খোঁজকে ব্যঙ্গ মোদীর |
সাধুর স্বপ্নাদেশের উপরে ভিত্তি করে সোনার সন্ধানে খনন নিয়ে ইউপিএ সরকারকে ব্যঙ্গ করলেন নরেন্দ্র মোদী। চেন্নাইয়ের এক জনসভায় বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর দাবি, উত্তরপ্রদেশে এই খননকার্য নিয়ে সারা পৃথিবী হাসাহাসি করছে। শোভন সরকার নামে এক সাধুর স্বপ্নাদেশের উপরে ভিত্তি করে উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ে একটি দুর্গে আজ খনন শুরু করেছে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ। সাধুর স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী, ওই দুর্গে ১ হাজার টন সোনা পোঁতা আছে। চেন্নাইয়ের জনসভায় আজ মোদী বলেছেন, “কেউ স্বপ্ন দেখল আর খোঁড়াখঁড়ি শুরু হল। সারা বিশ্ব আমাদের দেখে হাসছে।” মোদীর মতে, বিদেশের ব্যাঙ্কে ভারতীয় ‘চোর আর লুটেরা’দের লুকিয়ে রাখা সম্পদের পরিমাণ ১ হাজার টন সোনার চেয়ে অনেক বেশি। সেই সম্পদ ফিরিয়ে আনলে মাটি খুঁড়ে সোনা খোঁজার প্রয়োজন হত না। মোদীর মতে, দেশে পরিবর্তনের ঘূর্ণিঝড় চলছে। তাই ঘূর্ণিঝড় পিলিন তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। তাঁর কথায়, “উত্তর ভারতের কেউ ভাবতেই পারেন না তামিলনাড়ুতেও পরিবর্তনের ঢেউ উঠেছে। তাই তিরুচিরাপল্লিতে আমার সভায় অত ভিড় হয়েছিল।” তামিলনাড়ুতে বিজেপির বিশেষ প্রভাব নেই। তবে অনেকের ধারণা, জয়ললিতার সঙ্গে নির্বাচন-পরবর্তী জোটের কথা ভাবছেন বিজেপি নেতৃত্ব। মোদীর মতে, মানুষ এখন কংগ্রেসমুক্ত ভারতের স্বপ্ন দেখছে। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবেই। |
|
|
|
|
|