২০০৭-এর ৩০ জুন। কাটোয়ার রেল রিক্রিয়েশন মাঠে বর্ধমান-কাটোয়া রেললাইনের গেজ পরিবর্তনের শিলান্যাস করে যান তৎকালীন রেলমন্ত্রী। তার পরে কেটে গিয়েছে ছ’বছরেরও বেশি সময়। কিন্তু বর্ধমান থেকে বলগনা পর্যন্ত ব্রডগেজ হয়ে থমকে গিয়েছে। বাকি পথ, অর্থাৎ বলগনা থেকে কাটোয়া পর্যন্ত ন্যারোগেজ লাইন কবে ব্রডগেজ হবে, তা জানা নেই কারও।
কাটোয়ায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির প্রস্তাবের পরেই রাজ্যের বিগত বাম সরকারের সঙ্গে রেল মন্ত্রকের চুক্তি হয়, রাজ্য সরকারের বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম বর্ধমান-কাটোয়া রেলপথের অর্ধেক খরচ বহন করবে। সেই মতো বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম ১০ কোটি টাকা দেয় রেল কর্তৃপক্ষকে। পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন বর্ধমান-বলগনা ২৬ কিলোমিটার পথের গেজ পরিবর্তনের কাজ শুরু হয়। বর্তমানে ওই রেলপথ দিয়ে একজোড়া ট্রেন চলাচল করছে। আর কাটোয়া থেকে বলগনা বাকি ২৭ কিলোমিটার পর্যন্ত দু’জোড়া ন্যারোগেজ ট্রেন চলছে।
বর্তমানে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির ভার পিডিসিএলের কাছ থেকে নিয়েছে এনটিপিসি। কেন্দ্রীয় এই সংস্থাও ২০০৬ সালে পিডিসিএল এবং রেলমন্ত্রকের ওই চুক্তিতে রাজি হয়েছিল। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা আনার জন্য ওই রেলপথের অর্ধেক টাকা দিতে রাজি বলে রেলকে জানিয়েছিল এনটিপিসি। ওই প্রকল্পের জন্য প্রাথমিক ভাবে ২৪৫ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছিল। ৫৩ কিলোমিটার ওই রেলপথের সঙ্গে বর্ধমান-বলগোনা ২৬ কিলোমিটার ব্রডগেজ করে দিয়েছে রেল। বছরখানেক আগে বৈদ্যুতিন ওই রেলপথের উদ্বোধন করেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়। তার ঠিক আগে কাটোয়া থেকে বলগোনা পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার রেলপথের জন্য গত বছর মে মাসে এনটিপিসি-র কাছ থেকে ১১২ কোটি টাকা চেয়ে চিঠি দেয় রেল। |
বছর কেটে গেলেও এনটিপিসি এ ব্যাপারে কোনও আগ্রহ দেখায়নি। এনটিপিসি-র পূর্বাঞ্চল দফতরের এক আধিকারিকের বক্তব্য, “কাটোয়ায় এনটিপিসি বিদ্যুৎ প্রকল্প শেষ পর্যন্ত করা যাবে এমন নিশ্চয়তা কোথায়? যেখানে নিশ্চয়তা নেই, সেখানে কোনও সংস্থাই লগ্নি করতে আগ্রহী হবে না, এটাই তো স্বাভাবিক।” ইতিমধ্যে এনটিপিসি কর্তৃপক্ষ জমি-জটের কারণে উৎপাদন কমিয়ে ১৩২০ মেগাওয়াট করতে রাজি হয়েছে। বিগত বাম আমলে কাটোয়াতে ৫৫৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। তারা রাজ্য সরকারের কাছ থেকে আর ১৫০ একর জমি দাবি করেছে।
রেল সূত্রে জানা যায়, ১৯১৫-১৭ সালের মধ্যে ধাপে ধাপে এই রেলপথ চালু হয়। ১৯১৬ সালের ১ এপ্রিল কাটোয়া থেকে প্রথম ন্যারোগেজ ট্রেন চলে। গন্তব্য ছিল কৈচর। এই স্টেশনের উদ্বোধন করেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। ১৯৬৬ পর্যন্ত বর্ধমান-কাটোয়া রেলপথের শেয়ার ছিল ভারত সরকার, ম্যাকলিওড কোম্পানি-সহ স্থানীয় জমিদারদের হাতে। সে বছর ১ এপ্রিল রেলমন্ত্রক সমস্ত শেয়ার কিনে নিয়ে নিজেদের তত্ত্বাবধানে বর্ধমান-কাটোয়া ন্যারোগেজ ট্রেন চালাতে শুরু করে। জানা গিয়েছে, এই লাইনে কখনও লাভের মুখ কোনও পক্ষই দেখতে পায়নি।
এই ন্যারোগেজ লাইনকে ব্রডগেজে রূপান্তরের জন্য সরব হয়েছে সব রাজনৈতিক দল। কাটোয়ার কংগ্রেস বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় সম্প্রতি দিল্লি গিয়ে এ ব্যাপারে রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেন। রবীন্দ্রনাথবাবুর দাবি, “এ বার বাজেটেই কাটোয়া-বলগনা রেলপথ ব্রডগেজে রূপান্তরের ব্যাপারে রেলমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন।” সিপিএমের মঙ্গলকোটের বিধায়ক শাহজাহান চৌধুরী বলেন, “এই লাইন তৈরির ব্যাপারে রাজ্য সরকারের একটি ভূমিকা রয়েছে। সে কারণে আমি বিধানসভায় সরব হয়েছি। এই জেলার সিপিএম বিধায়ক ও সাংসদেরা ওই লাইন তৈরির দাবিতে রেলমন্ত্রীর কাছে ধর্নায় বসবেন।” তৃণমূলের বর্ধমান জেলা (গ্রামীণ) সভাপতি তথা রাজ্যের প্রতিমন্ত্রী স্বপন দেবনাথ বলেন, “আমরা চাই, বাকি রেলপথ দ্রুত তৈরি হোক। এ ব্যাপারে রেলকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
পূর্ব রেলের বিবি লুপ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পুরবধি মুখোপাধ্যায়, কাটোয়া আদালতের আইনজীবী চন্দনচন্দ্র সাহাদের আবার দাবি, “চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে আসুক রেল। বাকি পথটুকু ব্রডগেজ হয়ে গেলে নতুন রুট তৈরি হয়ে যাবে। তাতে রেলের লাভই হবে।” রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী অবশ্য বলেন, “রেল তার অংশ ইতিমধ্যেই করে দিয়েছে। এনটিপিসি এ রাজ্যে লগ্নি করতে ইচ্ছুক হওয়ায় আমার মনে হয় রাজ্যের লাভ হয়েছে। রাজ্য তথা এনটিপিসি ভাগের টাকা দিলেই আমরা বাকি পথটুকু করে দেব।”
অর্থাৎ, কিছুদিনের মধ্যে শতবর্ষে পা রাখতে চলা এই রেলপথ কবে বড় হবে, সদুত্তর নেই কারও কাছে। |