|
|
|
|
জামিনদার মেলে না, সংখ্যালঘু ঋণ অধরাই
মনিরুল শেখ • কলকাতা |
নিয়মের নিগড়ে মুখ থুবড়ে পড়ার মুখে পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের মেয়াদি ঋণ দান প্রকল্প।
১৯৯৭ সালের অগস্ট থেকে বিত্ত নিগম কাজ শুরু করে। নিম্নবিত্ত পরিবারের সংখ্যালঘু যুবক-যুবতীরা যাতে ছোটখাটো ব্যবসা করে স্বনির্ভর হতে পারেন, তার জন্য প্রথম থেকেই অল্প সুদে মেয়াদি ঋণদানের নীতি নেওয়া হয়। গ্রামীণ এলাকায় ৮১ হাজার এবং শহরাঞ্চলে এক লক্ষ তিন হাজার বার্ষিক আয়ের যে কেউ তার জন্য আবেদন করতে পারেন।
বেশির ভাগ সরকারি ঋণের শর্ত হিসেবে সম্পত্তি বন্ধক রাখতে হয়। বিত্ত নিগমের মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন নেই। তবে ব্যবসার অভিজ্ঞতা বা নির্দিষ্ট ব্যবসার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। ঋণের উর্ধ্বসীমা ৫ লক্ষ টাকা, বাৎসরিক সুদের হার মাত্র ৬ শতাংশ।
কিন্তু ঋণ পাওয়ার অন্যতম শর্ত, সরকারি চাকুরিজীবী বা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-আইনজীবীকে জামিনদার হতে হবে। বাস্তব হল, গ্রামাঞ্চলের খুব কম মানুষ জামিনদার হিসেবে তেমন কাউকে জোগাড় করতে পারেন। বাধ্য হয়ে কেউ-কেউ সমবায় সমিতি বা ব্যাঙ্ক থেকে অন্তত দ্বিগুণ সুদে ঋণ নিচ্ছেন। অনেকে হাল ছেড়ে দিচ্ছেন। |
|
বিত্ত নিগম সূত্রের খবর, ২০১১-১২ বছরে মাত্র ৪৩২৭ জন বৈধ আবেদনকারী ছিলেন। তাঁদের ঋণ দিতে খরচ হয় প্রায় ২৯ লক্ষ টাকা। পরের বছর আবেদন করেন ৮৮২৭। ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৬ লক্ষ টাকা। এক-এক জন গ্রহীতা গড়ে ৬৪ হাজার টাকা করে ঋণ পেয়েছেন। কিন্তু সংখ্যাটা আসলে অনেক বেশি বাড়া উচিত ছিল বলে নিগমের কর্তারাই মনে করছেন। বিভিন্ন জেলার ফিল্ড সুপারভাইজাররা জানাচ্ছেন, বহু ছোট ব্যবসায়ী ব্যবসা বাড়ানোর জন্য ঋণ চান। কিন্তু জামিনদার জোটাতে পারেন না।
কলকাতার পার্ক সার্কাসের বছর ছাব্বিশের নাজমা আলম চেয়েছিলেন, নিগমের থেকে ঋণ নিয়ে সেলাই মেশিন কিনে বাড়িতেই কাজ করবেন। কিন্তু হন্যে হয়ে ঘুরেও তিনি জামিনদার জোগাড় করতে পারেননি। নাজমার কথায়, “আমার স্বনির্ভর হওয়াও আর হল না।” ৪০ নম্বর ব্রাইট স্ট্রিটের সালমা জহুর পার্ক সার্কাস হজ হাউসের পাশে ছোট একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালান। নিগমের থেকে অল্প সুদে ঋণ নিয়ে তিনি আরও বেশ কয়েকটি কম্পিউটার কিনতে চেয়েছিলেন। গত দু’বছর ধরে নানা জায়গায় চক্কর কাটার পরে সদ্য তিনি দুর্গাপুরের এক ইঞ্জিনিয়ারের সই জোগাড় করতে পেরেছেন। সালমার কথায়, “দু’বছর আগে ঋণটা পেলে ভাল হত। এ বছর আবেদন করেছি। দেখি কবে টাকা হাতে পাই।”
খাস কলকাতার ইংরেজি মাধ্যমে পড়া সালমার পক্ষে যদি জামিনদার জোগাড় করা এত শক্ত, গ্রামের অনেকের পক্ষেই তা কার্যত অসম্ভব। নদিয়ার ধুবুলিয়ার বাসিন্দা সোহেল শেখ বলেন, “রাজস্থানের জয়পুরে সোনার কাজ শিখেছি। দোকান করার জন্য ঋণ নেব ভেবেছিলাম। কিন্তু জামিনদার না পেয়ে আবেদনই করতে পারলাম না। ব্যবসাও হল না।”
যাঁরা ঋণ পাচ্ছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে আবার রয়েছে মামলার ঝুঁকি। নিগমের নিয়মে, এক বা একাধিক কিস্তি সময় মতো শোধ করতে না পারলে নিগম মামলা করবে, এই মর্মে প্রথমেই আবেদনকারীকে সই দিতে হয়। সেই ভয়েই অনেকে ধারে-কাছে ঘেঁষেন না। নিগমের আইনজীবী মহম্মদ মুস্তাফা বলেন, “বছরে মোটামুটি শ’খানেক গ্রাহকের বিরুদ্ধে ১৩৮ এনআই আইনের অধীনে মামলা করা হয়। তাঁদের আলিপুর কোর্ট থেকে জামিন নিতে হয়। প্রায় দু’বছর ধরে মামলা চলে।” যার যেখানেই বাড়ি হোক, মামলা হলে যেতে হবে সেই আলিপুরেই।
বছরখানেক আগে ধুবুলিয়ার জাইদুল শাহের বিরুদ্ধে মামলা করে নিগম। তাঁর কথায়, “কয়েকটা কিস্তি গরমিল হওয়াতেই এই ঝক্কি। এই শেষ! আর ঋণের কথা ভাবব না।” উত্তর চব্বিশ পরগনার এক ফিল্ড সুপার ভাইজার জানান, দার্জিলিঙের এক গ্রহীতা কিস্তি দিতে না পারায় তাঁকেও কয়েকশো কিলোমিটার উজিয়ে আলিপুরে এসে জামিন নিতে হয়েছিল। কৃষ্ণনগর জেলা আদালতের প্রবীণ আইনজীবী সামসুল ইসলাম মোল্লা বলেন, “বাংলা স্বনির্ভর কর্মসংস্থান প্রকল্পের মতো অনেক সরকারি ঋণের ক্ষেত্রেই গ্রহীতাকে ঋণ শোধের সুযোগ দেওয়া হয়। অত সহজে মামলা হয় না। ব্যাঙ্কগুলিও অতি তৎপর হয়ে কোর্টের দ্বারস্থ হয় না। কিন্তু সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগম দু’একটি কিস্তি ঠিক সময়ে দিতে না পারলেই মামলা করছে।”
রাজ্যের সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের প্রতিমন্ত্রী গিয়াসউদ্দিন মোল্লা বলেন, “জমিবাড়ি বন্ধক রেখে ঋণ দেওয়ার পরিকাঠামো আমাদের নেই। তবে জামিনদার হিসেবে চাকুরিজীবী ছাড়াও বেশ কয়েকটি পেশার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ও করদাতাদের যুক্ত করা হয়েছে। সাধারণত এক বা দু’টো কিস্তি বাদ পড়লে মামলা হওয়ার কথা নয়। কেন এটা হচ্ছে, খোঁজ নিয়ে দেখছি।”
|
পুরনো খবর: ক্ষমতা খাটিয়েই নিগমকর্তা তথ্য দেন ইন্দ্রজিৎকে |
|
|
|
|
|