পদমর্যাদায় তিনি পশ্চিমবঙ্গ পরিকাঠামো উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের অ্যাকাউন্টস অফিসার। নিগমের টাকা কোন কোন ব্যাঙ্কে জমা রাখা হবে, যে-কমিটি সেই সিদ্ধান্ত নেয়, তার আহ্বায়কও তিনি। নিগমে চাকরি করছেন প্রায় ১৫ বছর। সব মিলিয়ে প্রভূত ক্ষমতা তাঁর হাতে। আর নিগমের ১০০ কোটিরও বেশি টাকা তছরুপে জালিয়াতদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে অ্যাকাউন্টস অফিসার অজয়কুমার সিংহ তাঁর সেই ক্ষমতারই পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছিলেন বলে তদন্তে জেনেছেন লালবাজারের গোয়েন্দারা। বছর বিয়াল্লিশের অজয়কে বৃহস্পতিবার গ্রেফতার করার পরে এই ব্যাপারে আরও অনেক তথ্য তদন্তকারীদের হাতে এসেছে।
ওই জালিয়াতির মূল চক্রী হিসেবে অভিযুক্ত ইন্দ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে আগেই গ্রেফতার করা হয়েছে। এতে অজয় জড়িত কী ভাবে?
লালবাজার সূত্রের খবর, বেশি সুদ পেতে নিগমের টাকা এক ব্যাঙ্ক থেকে অন্য ব্যাঙ্কে পাঠিয়ে ফিক্সড ডিপোজিট (এফডি) করার জন্য নিয়ম অনুযায়ী নিগম ১০টি ব্যাঙ্ক থেকে সুদের হারের ‘কোটেশন’ নেয়। প্রতিটি ব্যাঙ্ক লিখিত ভাবে নিগমকে নিজেদের কোটেশন পাঠায়। নিগমের বিনিয়োগ বিষয়ে নির্ণায়ক কমিটিতে ওই কোটেশনগুলি পেশ করা হয়। তার মধ্যে যে-ব্যাঙ্ক সব চেয়ে বেশি সুদ দেবে বলে কোটেশন দিয়েছে, সেই ব্যাঙ্কেই টাকা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় নিগম।
নিগমের কর্তারা জেনেছিলেন, ইউকো ব্যাঙ্কের সার্কাস অ্যাভিনিউ শাখার কোটেশন ছিল সব চেয়ে বেশি। তাই ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কলেজ স্ট্রিট শাখা থেকে সরিয়ে সেখানেই ১২০ কোটি টাকা পাঠিয়ে ফিক্সড ডিপোজিট বা স্থায়ী আমানত করার সিদ্ধান্ত নেন নিগম-কর্তারা।
কিন্তু তদন্তে ধরা পড়েছে, ইউকো ব্যাঙ্ক এই ধরনের কোনও কোটেশনই পাঠায়নি নিগমের কাছে। ইন্দ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে জালিয়াতেরাই ইউকো ব্যাঙ্কের নাম করে একটি ফ্যাক্সবার্তা পাঠিয়েছিল নিগমে। আর এখানেই অজয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন বলে গোয়েন্দারা জেনেছেন।
তদন্তকারীদের বক্তব্য, গত জুলাইয়ে ইউকো ব্যাঙ্কের নাম করে যে-ফ্যাক্স নম্বর থেকে নিগমে বার্তা পাঠানো হয়েছিল, সেটি আদৌ ইউকো ব্যাঙ্কের নম্বরই নয়। কিন্তু অজয় নিজেই নিগমের কর্তাদের সামনে ব্যাঙ্কের ওই ভুয়ো ফ্যাক্সবার্তা পেশ করেছিলেন বলে কারও সন্দেহ হয়নি। বাকি ন’টি ব্যাঙ্ক কিন্তু সত্যিই কোটেশন পাঠিয়েছিল। এবং তারা কী হারে সুদ দেওয়ার কথা জানিয়েছে, নিগমের অ্যাকাউন্টস অফিসার এবং বিনিয়োগ নির্ণায়ক কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে সবই জানতেন অজয়।
এক গোয়েন্দা-কর্তার কথায়, “বাকি ন’টি ব্যাঙ্কের দেওয়া কোটেশনের মধ্যে সর্বোচ্চ সুদের হার কত, ইন্দ্রজিৎদের সেটা জানিয়ে দিয়েছিলেন অজয়। ফলে তার চেয়েও বেশি হারে সুদ দেওয়ার কথা জানিয়ে ইউকো ব্যাঙ্কের নামে ওই ফ্যাক্সবার্তায় কোটেশন পাঠিয়ে দেন ইন্দ্রজিৎ ও তাঁর শাগরেদরা। কমিটির বৈঠকে ব্যাঙ্কের ভুয়ো ফ্যাক্সবার্তাটি পেশ করেছিলেন অজয়ই।” ইউকো ব্যাঙ্কের সার্কাস অ্যাভিনিউ শাখায় টাকা পাঠানো হলেও সেটা নিগমের নামে জমা পড়েনি। অথচ নিগম ওই ব্যাঙ্কের কাছ থেকে এফডি সার্টিফিকেট পেয়ে গিয়েছিল। সেটি ছিল জাল। সেখানেও অজয়ই নিগম-কর্তৃপক্ষকে ধোঁকা দিয়েছিলেন বলে গোয়েন্দাদের দাবি।
বদলে কী পেলেন অজয়? তছরুপে সহযোগিতা করার জন্য ইন্দ্রজিতের কাছ থেকে অজয় কত বখরা পেয়েছিলেন, গোয়েন্দারা এখন সেটাই খতিয়ে দেখছেন। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, নিগমের টাকা নির্ঝঞ্ঝাটে ইউকো ব্যাঙ্কে পাঠানোর বিষয়ে ভূমিকা ছিল অজয়ের। আর ব্যাঙ্কে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট এবং সেই অ্যাকাউন্ট থেকে ওই বিপুল পরিমাণ টাকা ইন্দ্রজিতের অ্যাকাউন্টে সরিয়ে ফেলার পিছনে ভূমিকা নিয়েছিলেন ইউকো ব্যাঙ্কের সার্কাস অ্যাভিনিউ শাখার ম্যানেজার অ্যালায়েস লাকড়া। তাঁকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
|