লিফটের বোতাম টিপে নবান্নের ১৫তলায় উঠতেই ধাঁধিয়ে গেল চোখ। ঝাঁ-চকচকে অন্দরমহল বেশি টানছে, নাকি উদার গঙ্গা আর মুক্ত আকাশের যুগলবন্দি! ধাঁধা লেগে গেল। গঙ্গার পশ্চিম কূলে নতুন মহাকরণে রয়েছে পাঁচটি লিফট। তিনটি লিফট আমজনতার জন্য। জনতা লিফট। বাকি দু’টি ব্যবহার করবেন ভিআইপি-রা। ভবনের পূর্ব দিকের গেট দিয়ে ঢুকেই পাশাপাশি তিনটি জনতা লিফট। বৃহস্পতিবার তারই একটি সোজা পৌঁছে দিল ১৫তলায়। ওই তলাটি মুখ্যমন্ত্রীর জন্য বরাদ্দ। কাল, শনিবার সেখানে বসতে শুরু করবেন তিনি। তাঁর ঘরের গায়েই একটি বড় ঘর। সম্ভবত সেখানেই শনিবার মন্ত্রিসভার বৈঠক হতে চলেছে। নবান্নে মন্ত্রীরা এই প্রথম বৈঠকে বসছেন। তবে মন্ত্রিসভার বৈঠকের জন্য ১৪তলায় একটি ঘর নির্দিষ্ট আছে। কাল মন্ত্রিসভার বৈঠকের আগেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্বোধন করবেন নবান্নের। তুলবেন জাতীয় পতাকা।
১৫তলায় জনতা লিফট থেকে বেরিয়ে ডান দিকে গেলে মুখ্যমন্ত্রীর ঘর। সামনে বিশাল কাচের দরজা। দু’টি দেওয়ালে ছবির প্যানেল। ১৫ অগস্ট আর ২৬ জানুয়ারির অনুষ্ঠানের বিভিন্ন দৃশ্যের কাট-আউট। মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের বাঁ দিকে খানিকটা এগোলেই কাচে ঘেরা বসার জায়গা। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসা অতিথিরা বসবেন সেখানেই। তার পরে দু’দিকে বিভিন্ন কর্তার বসার জায়গা। আর এক দিকে কাচে ঘেরা বারান্দা। সেই বারান্দার কাচ দিয়ে দেখা যায় গঙ্গা। মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের কাচ দিয়েও গঙ্গা দেখা যায় পরিষ্কার। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ১৫তলার বারান্দা থেকে করিডর বাহারি গাছের টব দিয়ে সাজানো। আর সর্বত্র আকাশের বাড়ানো হাত। নতুন নবান্ন-নাট্যে আকাশ আর গঙ্গাই যেন সব থেকে বড় কুশীলব! |
মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের সামনে অপরিসর অলিন্দ, জানলাহীন ঘরের তুলনায় এটা যেন মুক্ত আকাশ। মুখ্যমন্ত্রীর ঘর, তাঁর আলোচনা কক্ষ, অতিথিদের বসার জায়গা আর কয়েক জন অফিসারের ঘর নিয়ে ১৫তলার এলাকা প্রায় সাড়ে আট হাজার বর্গফুট। মুখ্যমন্ত্রীর নিজস্ব এলাকার আয়তন তিন হাজার বর্গফুটের মতো। তাঁর ঘর কী ভাবে সাজানো হয়েছে, এ দিন তা দেখা হয়নি। বাধা দিয়েছেন নিরাপত্তারক্ষীরা। কলকাতা পুলিশের অফিসারদের সঙ্গে বেসরকারি সংস্থার রক্ষীরা কাচের দরজা আগলে দাঁড়িয়ে।
মহাকরণ থেকে গত কয়েক দিনে দফায় দফায় বিভিন্ন দফতরের (যারা নবান্নে উঠে যাচ্ছে) মালপত্র এসেছে। বুধবার অর্থমন্ত্রী, মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিবের দফতরের ঘরের জিনিসপত্র এসেছে নবান্নে। তবে এত দিন মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে হাত পড়েনি। সরকারি সূত্রের খবর, আজ, শুক্রবার মহালয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর ঘর থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাঠানো হবে নবান্নে। সন্ধ্যার মধ্যেই নবান্নের ১৫তলাটি পুরোপুরি ছেড়ে দিতে হবে রক্ষীদের হাতে। তার পরে সেখানে যাবে পুলিশ-কুকুর। শনিবার দুপুরে মুখ্যমন্ত্রী যাওয়ার আগে পুলিশ-কুকুর আরও এক বার ঘুরবে গোটা চত্বরে। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে শনিবারেই মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিব বসবেন তাঁদের নির্দিষ্ট ঘরে। ১৪তলায় মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিবের জন্য ঘর নির্দিষ্ট হয়েছে। বৃহস্পতিবার সেখানে চলছিল শেষ মুহূর্তের গোছগাছ। ১৪তলায় লিফট থেকে বেরিয়ে ডান দিকে মুখ্যসচিবের অফিস। বাঁ দিকে বসবেন স্বরাষ্ট্রসচিব। ওই তলায় তৈরি হয়েছে ক্যাবিনেট কক্ষ। যেখানে মন্ত্রিসভার বৈঠক হবে। |
তবে উদ্বোধনের দু’দিন আগেও নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে নিশ্চিত নন পুলিশকর্তারা। তাঁদের একাংশের গলায় মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ। মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের আশপাশ অনেকটাই ফাঁকা। শুধু কাচ ছাড়া কিছু নেই। তাই নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে। মহাকরণের এক কর্তা বলেন, “ঠিক ছিল, মুখ্যমন্ত্রীর অফিসের চার ধারে, ১৪তলায় বুলেটপ্রুফ কাচ লাগানো হবে। কিন্তু জার্মানি থেকে ওই কাচ আনাতে অন্তত তিন মাস লাগে। সেই সময় হাতে ছিল না। তাই শক্তপোক্ত কাচ দিয়েই কাজ চালানো হয়েছে।” মহাকরণেরই খবর, শীঘ্রই বুলেটপ্রুফ কাচ লাগানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। কার্যত এ দিনই নবান্নে কাজে যোগ দেন বেশির ভাগ সরকারি কর্মচারী। তাঁদের অনেকে প্রথম দিনটা নতুন জায়গায় ধাতস্থ হতেই কাটিয়ে দিলেন। মহাকরণ থেকে আসা বড় বড় বস্তা খুলে ফাইল বার করে কবে কাজ শুরু হবে, তা নিয়ে অনেক কর্মীর কপালে চিন্তার ভাঁজ। মহাকরণের স্যাঁতসেঁতে ঘরে অনেকে কাটিয়েছেন ২০-২২ বছর। ঝাঁ-চকচকে এই দফতরে এসে অনেকেই বিস্মিত। অর্থ দফতরের এক মহিলা কর্মী ১২তলার উপর থেকে অনেক নীচের হাওড়া শহরের ছবি তুলছিলেন মোবাইলে। ছবি তুলতে তুলতেই বিভাগীয় কর্তাকে বললেন, “আমি কিন্তু জানলার ধারে জায়গা চাই।” পূর্ত দফতরের এক কর্মীর চিন্তা খাবার নিয়ে। বললেন, “মহাকরণে খাবারের অভাব ছিল না। এ দিন অফিসে ঢোকার সময় চার পাশটা ভাল করে দেখলাম। ভাল খাবারের দোকান নেই। মনে হচ্ছে, বাড়ি থেকেই নিয়মিত টিফিন আনতে হবে।”
সওয়া ২টো নাগাদ তেতলায় দমকলমন্ত্রী জাভেদ খানের ঘরের সামনে হুড়োহুড়ি। পূর্ত দফতরের এক কর্মী মিস্ত্রিদের প্রায় হাতজোড় করে বলছেন, “বাবা, তোরা দরজাটা আগে লাগিয়ে দে। শুনছি, মন্ত্রীমশাই আসবেন ৩টেয়। এসে যদি দেখেন ঘরের দরজা নেই, তা হলেই তো কেলেঙ্কারি!” মন্ত্রী অবশ্য এলেন ৪টেয়। তত ক্ষণে দরজা তৈরি।
আড়াইটেয় নবান্নে এলেন মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী কে কে দ্বিবেদী। নতুন সচিবালয়ে মুখ্যমন্ত্রীর প্রবেশ-প্রস্থানের রাস্তা, গাড়ি রাখার জায়গার নিরাপত্তা ভাল করে খতিয়ে দেখে গেলেন তিনি। তার পরেই, ৩টে নাগাদ নবান্নে ঢুকলেন কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের উচ্চপদস্থ কর্তা দীপনারায়ণ গোস্বামী। একই সঙ্গে ঢুকল কলকাতা পুলিশের বম্ব স্কোয়াডের বিশাল দল। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে ১৩ এবং ১৪তলার নিরাপত্তা খতিয়ে দেখে দলটি।
দুপুরেই নবান্নের পাশে নতুন বাস ডিপো দেখতে আসেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র এবং পরিবহণসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। মন্ত্রী বলেন, “বিভিন্ন পরিবহণ নিগম এখানে বাস চালাবে। সারা দিনে বিভিন্ন বাস প্রায় ৩৫০ বার নবান্নে যাতায়াত করবে। শুক্রবার সন্ধ্যার মধ্যেই ডিপো তৈরির কাজ শেষ হয়ে যাবে।”
মহাকরণ থেকে এ দিনও নথিপত্র এসেছে নবান্নে। মহাকরণে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দিনভর চলেছে শেষ মুহূর্তের ফাইলপত্তর গোছানোর কাজ। মুখ্যমন্ত্রীর দফতর, ভূমি ও ভূমি সংস্কার এবং অর্থ দফতরের ফাইল বস্তায় ভরা হয়েছে এ দিনও। তার সঙ্গে ডাঁই করা হয়েছে প্রচুর চেয়ার-টেবিল। মহাকরণে অবশ্য এ দিন অধিকাংশ ঘরই ছিল সুনসান। ইতিউতি ছড়িয়ে রয়েছে কাগজ, টাউপরাইটার, ছেঁড়া ফাইল, চায়ের ভাঁড়। দীর্ঘদিন ধরে মহাকরণের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অনেক কর্মীর মুখেই এক কথা, ‘বহু সুখ-দুঃখের সঙ্গীদের ছেড়ে যেতে হচ্ছে। কষ্ট তো হচ্ছেই।’
তার মধ্যেই অনেক সরকারি কর্মী আশায় বুক বাঁধছেন। নবান্নে প্রথম দিন এসেই এ-দফতর সে-দফতর ঘুরছিলেন তৃণমূল প্রভাবিত সরকারি কর্মী সংগঠনের এক নেতা। বললেন, “মুখ্যমন্ত্রী শনিবার নবান্নের উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি কর্মীদের জন্য মহার্ঘ ভাতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবেন। দুর্গাপুজোর আগে এই আশাতেই আছি।” |