ধান মাটিতে হয়। মাটির ঠাকুরেই প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় দেবীর। নিজেদের সেই মাটির অধিকারটুকুই যখন নেই, তখন মাটির প্রতিমা আর গ্রামে আনবেন না। যেদিন নিজের দখলে মাটি ফিরবে, মহা ধুমধামে মাটির প্রতিমা গ্রামে আনবেন আবার।
এমনই স্থির করেছেন রাজ্যে জমি আন্দোলনের পীঠস্থান সিঙ্গুরের বেড়াবেড়ির বাসিন্দারা। তাই এ বারও ঘটপুজো করেই দুর্গাপুজো সারবেন ওঁরা। পাঁচিলের আড়ালে-থাকা জমির ভূত-ভবিষ্যৎ এখনও কোর্টের চৌহদ্দিতেই আটকে আছে। পুজো তাই সারা হচ্ছে নমো-নমো করে।
“কেন গ্রামে প্রতিমা এনে পুজো করব বলুন?” প্রশ্ন তোলেন বেড়াবেড়ির বধূ বন্দনা বাগ। “বুদ্ধবাবু (প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য) জোর করে আমাদের জমি নিয়ে নিয়েছেন। আমাদের শুধু পাঁচ বিঘে জমিই যায়নি, আন্দোলনে পুলিশের মারে স্বামীর শরীরটাও গিয়েছে। সরকার চাল, টাকা দিচ্ছে, তাই কোনও ক্রমে সংসার চলছে। জমি ঘরে ফিরলে তবেই গ্রামে প্রতিমাও ফিরবে।”
বেড়াবেড়ি পূর্বপাড়া শীতলামাতা শক্তি সঙ্ঘের পুজোর অন্যতম উদ্যোক্তা বিজন দাস। বলেন, “আমাদের পুজো এ বারে ২১ বছরে পড়ল। টানা ১৪ বছর প্রতিমা এনে পুজো করেছি। আন্দোলনের বছর থেকে ঘটপুজো করছি। ৫৮ শতক জমি ছিল আমাদের। ধান মানে লক্ষ্মী। সেই লক্ষ্মীই যখন ধরে রাখতে পারলাম না, তখন মিছিমিছি প্রতিমা এনে কী লাভ!” পুজোর কথার মধ্যেও সিঙ্গুরের বেড়াবেড়ি গ্রামের মানুষের কথায় ঘুরে ফিরে আসে আন্দোলনের গল্প। সুশীল বাগ শোনাচ্ছিলেন পুলিশের সঙ্গে তাঁর লড়াইয়ের কাহিনী। “পরিবারের তিন বিঘে তিন ফসলি জমি কথা নেই বার্তা নেই, কী করে ছেড়ে দিই বলুন তো! গেলাম বিডিও অফিসে। প্রতিবাদ, চেঁচামেচি করতেই চার জন পুলিশ আমাকে বাগিয়ে ধরল। আমিও ছাড়ার পাত্র নই।” পুলিশের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে বাঁইবাঁই ঘুরিয়ে, শেষে দৌড়ে গিয়ে কী ভাবে লুকিয়ে পড়েছিলেন মূলোর খেতে, সেই গল্প বলতে বলে ছোট ডাকাবুকো মানুষটা কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। “এখন আমার সাড়ে সাত কাঠা মাত্র জমি। দু’-দু’টো মেয়ে। কী ভাবে চলে বলুন তো?”
পূর্বপাড়ার বধূ পারমিতা দাস বলছিলেন ২০০৬-এর ২৫ সেপ্টেম্বরের কাহিনী। তিনি বলেন, “পুলিশের লাঠি খেয়েছি। আন্দোলনে গিয়েছি। কিন্তু ধরা পড়িনি। ধরা পড়লেই তো শেষ। আন্দোলনে থাকতে পারতাম না।” শুধু ইতিহাসের পাতায় চলে যাওয়া ওই দিনটা নয়, আন্দোলন পর্বে নানা দিনের কাহিনীই ভেসে উঠছিল তাঁর গলায়। তিনি বলেন, “আন্দোলনের ছেলেদের জন্য বাড়িতে ভাত চাপিয়েছি। মাঠ পেরিয়ে পুলিশের এক একটা কাঁদানে গ্যাসের শেল এসে পড়ছিল দোরগোড়ায়। ভিজে কাপড়ে চোখ মুছতে মুছতে হাতা দিয়ে ভাত নেড়েছি। ফের ছুটে গিয়েছি মাঠে।”
সিঙ্গুর পঞ্চায়েতের কর্মাধ্যক্ষ পারমিতা আবার পুজোর কথার খেই ধরিয়ে দেন। বলেন, “এ বার বাচ্চাদের একটু মন হয়েছিল প্রতিমা আনি। বড়রা ওদের সংযত করি। পথ এখনও অনেকটা বাকি। দেখবেন গ্রামের প্রতিমা একদিন ঘর আলো করে গ্রামে ফিরবেই।” প্রকল্প এলাকার ৯৯৭ একরের বেশির ভাগটাই এখন কাশফুলে ঢাকা। এই কাশবনের নীচেই পারমিতাদের ‘হারানো’ জমি কোথায় ঢাকা পড়েছে। আজও তাঁরা তা খুঁজে চলেছেন। |