|
|
|
|
জেলবন্দি লালুর লন্ঠনে এখন শুধুই অন্ধকার
নিজস্ব প্রতিবেদন |
লালু প্রসাদ ও তাঁর সমর্থকদের মুখে প্রায়ই শোনা যেত কথাটি। ‘যব তক রহেগা সামোসে মে আলু, তব তক রহেগা বিহার মে লালু!’ ঠিক এতটাই আত্মবিশ্বাস ছিল বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর।
সেই সঙ্গে বিশ্বাস ছিল বিহারের উপরে। অবিভক্ত বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাই সিঙ্গাপুরের লগ্নিকারীদের অক্লেশে বলতে পারতেন, “যা দেখে জে আর ডি টাটা বিহারে লগ্নি করেছেন, তা দেখেই আপনারাও বিহারে আসুন।” পরে সেই বিহারই কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নিল! পশুখাদ্য কেলেঙ্কারি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত লালুপ্রসাদ যাদবের রাজনৈতিক ইনিংস শেষ হয়ে গেল কি না, তা নিয়েই এখন জল্পনা শুরু হয়েছে নানা শিবিরে।
১৯৪৮ সালের ১১ জুন বিহারের গোপালগঞ্জ জেলার ফুলওয়াড়িতে এক কৃষক পরিবারে জন্ম লালুর। ১৯৭০-এর দশকে পটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ। অল্প দিনের মধ্যেই সেই সময়ের অধিকাংশ ছাত্র নেতাকে ছাড়িয়ে অনেকটাই এগিয়ে যান তিনি।
১৯৭৭ সালে জনতা দলের টিকিটে প্রথম সংসদে নির্বাচিত হন লালু। বয়স তখন মাত্র ২৯। ক্রমশই বিহার রাজনীতির অন্যতম শক্তি হয়ে ওঠেন। এক দিকে ছিল যাদব ও সংখ্যালঘু ভোটের সমীকরণ, অন্য দিকে ছিল তাঁর একেবারে নিজস্ব কথা বলা, চলাফেরার ভঙ্গি। দীর্ঘ দিন ধরে যা সংবাদমাধ্যমের কাছে অতি প্রিয় করে রেখেছিল তাঁকে। ভারতের রাজনীতিতে এত রঙিন চরিত্র দেখা গিয়েছে
খুব কমই। |
|
জামাকাপড়, কথাবার্তায় একেবারে ‘বিহারী’। সেই সঙ্গে অসাধারণ রসবোধও। জনপ্রিয়তার জোয়ারে চেপেই ১৯৯০ সালে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হন লালু। রাম জন্মভূমি আন্দোলন বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণীর পাশাপাশি লালু প্রসাদকেও তুলে ধরেছিল জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনে। বিহারে রথ নিয়ে ঢোকার পরে আডবাণীকে গ্রেফতার করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালু।
বলা হয়, ওই ঘটনাই জাতীয় রাজনীতিতে লালুকে এক লাফে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিল। লালু নিজেও এই বিষয়ে প্রচণ্ড আগ্রহী ছিলেন। আর সেখান থেকেই ১৯৯৭ সালে জনতা দল ছেড়ে গড়ে তোলেন আরজেডি। প্রতীক লন্ঠন। যে চিহ্ন নিয়ে গোটা বিহার দীর্ঘ দিন দাপিয়েছেন তিনি।
সময়ের সঙ্গে বদলে গিয়েছিল জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর শত্রু-মিত্রের তালিকাও। এক সময়ে কংগ্রেসকে প্রবল অপছন্দ করলেও পরে হাত মিলিয়েছিলেন তাদের সঙ্গেই। তাঁর পরম শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিজেপি। ২০০৪ সালে ইউপিএ সরকারের রেলমন্ত্রী হয়েছিলেন। ক্ষতিতে চলতে থাকা রেলকে লাভের মুখ দেখিয়ে চমকে দিয়েছিলেন অনেককে। ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের শিক্ষার্থীরা তখন তাঁর মুখ থেকেই শুনেছে ভারতীয় রেলের ঘুরে দাঁড়ানোর পিছনের কাহিনি। ট্রেনে কাগজের কাপের বদলে চালু করেছেন ভাঁড়। মাঝ রাতে ট্রেনে সফর করে দেখেছেন যাত্রী পরিষেবার হাল।
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেও অভিনবত্বে পিছিয়ে ছিলেন না কখনওই। গরু-মোষের দুধ দোয়ার ছবি বেরিয়েছে সংবাদমাধ্যমে। রান্নাঘরে বসে তাঁকে রুটি খেতেও দেখেছে সারা দেশ। পাশেই ছিলেন তাঁর স্ত্রী রাবড়ি দেবী। লালু জেলে যাওয়ার পরে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কিছু দিন রাশ হাতে নিয়েছিলেন রাবড়িই। দেশের গণ্ডি পার হয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল লালুর খ্যাতি। পাকিস্তান সফরে গেলে বাজারে তাঁকে রীতিমতো ঘিরে ধরেছিলেন স্থানীয়রা
কিন্তু, এত বর্ণাঢ্য চরিত্রও চাপা দিতে পারেনি তাঁর সময়ে বিহারের অর্থনীতির বেহাল দশা, আইন-শৃঙ্খলা প্রায় ভেঙে পড়ার অভিযোগ। লালু জমানার বিহার আর ‘জঙ্গল রাজ’ প্রায় সমার্থক হয়ে গিয়েছে হিন্দি সিনেমার পর্দাতেও। জনমানসে ধারণা তৈরি হয়েছে, ক্ষমতাশালী রাজনীতিকদের ছত্রছায়ায় থাকলে লালুর বিহারে সব অপরাধ করেই পার পাওয়া যায়।
জাতপাতের রাজনীতি করা নিয়েও লালুর সমালোচনা করেছেন অনেকে। তাতে অবশ্য এই যাদব নেতার কিছু যায় আসে নি। তবে তাঁকে ক্রমশই বিপাকে ফেলতে থাকে পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির মতো দুর্নীতির মামলা। বিহারে উত্থান ঘটতে থাকে নীতীশ কুমারের। শেষ পর্যন্ত নীতীশের কাছেই পটনার মসনদ হারাতে হয় লালুকে। তখন নীতীশের জোটসঙ্গী তাঁর পরম শত্রু বিজেপি।
শেষ পর্যন্ত পশুখাদ্য কেলেঙ্কারিই প্রকৃত বিপদ ডেকে এনেছে। সিবিআই আদালতে দোষী সাব্যস্ত লালুর ঠিকানা আপাতত জেল। পটনার রাজনীতি বিশেষজ্ঞ নিসার উল হকের মতে, বিহারে রাজার মতোই রাজত্ব করেছেন লালু। কিন্তু, কোনও রাজার রাজত্বই চিরদিন টেকে না। রাষ্ট্রীয় জনতা
দলের লন্ঠন নিভে গিয়ে এখন শুধুই অন্ধকার।
|
পুরনো খবর : গাঁধীর ছবিতে লালুর মালা |
|
|
|
|
|