স্মরণ
তাড়াতাড়ি উঠে ওয়েক আপ কল দিয়ো
ছোট বেলায় পরদায় দেখা বাবার সঙ্গে কিছুতেই মেলাতে পারতাম না বাড়িতে দেখা বাবাকে। পরদায় তিনি আমার কাছে অচেনা। আর বাড়িতে? আমার সবচেয়ে প্রিয় ‘পাপা’।
বছর ছ’য়েক বয়সেই আমি বুঝতে পারলাম, আমার বন্ধুদের বাবার মতো আমার বাবা নন। কেমন যেন আলাদা। ‘একস্ট্রা স্পেশ্যাল’।
এখনকার মতো তখন ফিল্মের নায়কদের জিমে গিয়ে শরীরচর্চার চল ছিল না। কিন্তু বাবাকে দেখতাম, প্রতিদিন স্নানের আগে নিয়ম করে করতেন হাল্কা স্ট্রেচিং, জগিং, তার পরে যোগব্যায়াম।
বাবা মুম্বইয়ে থাকলে আলাদা মেজাজ নিয়ে আমরা রাতে খেতে বসতাম। সারা দিনের মধ্যে ওই সময়ই অনেকক্ষণ পেতাম বাবার সঙ্গ।
দুরন্ত মুডে থাকতেন পাপা। ব্যস্ত দিনের নানা ঘটনা উঠে আসত তাঁর বর্ণনায়। এক্কেবারে বাবার নিজস্ব ঢঙে বলে যাওয়া সেই সব কথা আজও যেন কানে বাজে। শুনতে শুনতে গড়িয়ে যেত সময়।
তত দিনে জেনে গিয়েছি যে, আমার বাবা বলিউডের ‘দ্য বিগেস্ট স্টার ইন হিজ এ্যরা’। আর আমি তাঁর সন্তান। আত্মজীবনীতে বাবা লিখে ছিলেন না, “সুনীল তো জন্মেছেই রুপোর চামচ মুখে দিয়ে!”
‘ডিনার’ সারা হয়ে গেলে আমাদের পালি হিলের বাড়ির লাগোয়া বাগানে বাবা একটু পায়চারি করতেন। গাছ লাগাতেন মালিদের দিয়ে। প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করেছেন আজীবন।
ছোটবেলায় জেদাজেদি করে বাবার সঙ্গে গিয়েছি শ্যুটিং দেখতে। ছবির নাম ‘তেরে ঘর কি সামনে’। সেই আমার প্রথম কোনও ছবির শ্যুটিং দেখতে আসা।
পড়তাম মিশনারি স্কুলে। খুব কড়াকড়ি সেখানে। বাবাও চাইতেন, বাড়ির ছোটরা সাধারণ ভাবেই যেন বেড়ে ওঠে।
আমাদের বাড়িতে আমার বন্ধুরা মাঝেমধ্যে এলে কখনও সখনও ‘পাপা’র সঙ্গে তাদের মুখোমুখি হয়ে যেত। চোখের সামনে পরদার স্বপ্নের নায়ককে স্বচক্ষে দেখেও যেন ওদের বিশ্বাস হত না!
বন্ধুদের নিয়ে জমিয়ে আড্ডা দেওয়ায় কখনও অমত ছিল না তাঁর। বাবা হিসেবে তিনি ছিলেন ‘ইউনিক’।
মানুষ হিসেবেও ছিলেন অত্যন্ত সৎ আর আদর্শবাদী। বলিউডে বাবাই বোধ হয় একমাত্র নায়ক, যাঁর কোনও ‘বডিগার্ড’-এর প্রয়োজন পড়ত না। এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে তিনি হাসতেন। ‘‘আমি কি কোনও অন্যায় করেছি যে আমাকে ‘বডিগার্ড’ নিয়ে ঘুরতে হবে?” উলটে প্রশ্ন করতেন তাঁকেই। টাকাপয়সা দিয়ে ‘স্টারডম’ কেনা যায় না, মনেপ্রাণে বাবা এ কথা বিশ্বাস করতেন।
সমসাময়িক নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে মিশতেন ‘স্পোর্টসম্যান স্পিরিট’ নিয়ে। বৈজয়ন্তীমালাজি থেকে ওয়াহিদাজি অথবা হেমাজি তাঁর বিপরীতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য কখনও কোনও নায়িকা ‘না’ করেননি। বলতেন, ‘অ্যাই অ্যাম জাস্ট লাইক অ্যান ওপেন বুক!’ দিলীপসাব-রাজসাব বা বাকিদের কারও সঙ্গে তাঁর কোনও রেষারেষি ছিল না। কোনও নায়কের ছবির মুক্তির সঙ্গে তাঁর ছবিও মুক্তি পাচ্ছে, কখনও দেখিনি তা নিয়ে তাঁর কোনও হেলদোল।
ভুলচুক করলে অনুশোচনা করতেন না। দিল্লিতে ‘জুয়েল থিফ’ ছবির প্রিমিয়ার। ঢল নেমেছে মানুষের। তিনি জনতার কাঁধে। হঠাৎ খেয়াল করলেন, তাঁর মানিব্যাগ হাওয়া। কেউ জানতেও পারল না। তাঁর জনপ্রিয়তার ঝড়ের কাছে ১৫ হাজার টাকা হারানোর দুঃখে ভেঙে পড়বেন, তিনি কী এমন মানুষ?
তবে ছবি রিলিজ করার আগে একটু টেনশনে থাকতেন। মনে আছে, ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’ ছবির দুরন্ত সাফল্যের পরে খবরের কাগজের সমালোচনা পড়ে তিনি শিশুর মতো আনন্দ করেছিলেন।
আমেরিকায় বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়ার সময়ে বাবা এসেছিলেন আমার কলেজে। রাতে ঘুমিয়েছিলাম এক বিছানায়। বাবার পাশে। পরদিন তিনি চলে যাওয়ার সময়ে আমার চোখে প্রায় জল। আমাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিলেন।
আরও এক বার গিয়েছি তাঁর প্রিয় শহর নিউ ইয়র্কে। এখানে স্থানীয় নাট্যশালায় আর শহরের বিভিন্ন বইয়ের দোকানে ঢুঁ মারা তাঁর অভ্যাস।
রাস্তা দিয়ে আমরা কত কথা বলতে বলতে হাঁটলাম। কী যে ভাল লাগছিল!
‘আনন্দ ঔর আনন্দ’য়ের শ্যুটিংয়ের আগে আমি খুব নার্ভাস। বাবাকে না জানিয়েই ভর্তি হয়েছিলাম অভিনয় শেখার স্কুলে। কিন্তু ঠিক ভরসা পাচ্ছি না। বাবা ঠিক বুঝে গিয়েছেন। বললেন, “জাস্ট রিল্যাক্স। অ্যাক্টিং ইজ অল অ্যাবাউট ফেস।” ব্যস, দু’মিনিটেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। এমন করে আর কে শেখাবেন বাবা ছাড়া? সব সময় তিনি স্বাভাবিক, সব সময় পজিটিভ।
‘গাইড’-এ সঙ্গে ওয়াহিদা
তিনি নেই। মেনে নিতে পারিনি। আমার জীবনটাই তো বাবাকে ঘিরে। বিয়ে পর্যন্ত করে ওঠা হয়নি। প্রায়ই বলতেন, ‘মুভি-মেকিং মন এবং শরীরের অ্যাডভেঞ্চার।’ ছবি হিট হবে কী ফ্লপ, সে নিয়ে কখনও মাথা ঘামাতেন না। বলতেন, ‘আমরা তো আশা নিয়েই বেঁচে থাকি।
কখনও থেমে থাকেননি এক জায়গায়। পার্টিতে যেতেন না, বাড়িতেও সবাইকে ডাকতেন না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লিখে যেতেন। সত্যি করেই তিনি ছিলেন কর্মযোগী। বলতেন, “দুঃখ করবে না। সব সময় সামনে তাকাবে।”
লন্ডনে শেষ চিকিৎসার সময়েও পরের ছবির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এক্কেবারে বাচ্চা ছেলের মতো তিনি অস্থিরচিত্ত। ‘হি ওয়াজ রিয়ারিং টু গো’। প্রায় সেরে উঠছিলেন।
বিছানায় শুয়ে শুয়েই কত কিছু যে নোট করেছিলেন। পরের দিন আমার সঙ্গে স্কটল্যান্ডে শ্যুটিংয়ের লোকেশন দেখতে বেরিয়ে পড়ার কথা। বললেন, “গেট আপ আরলি, গিভ মি অ্যা ওয়েক আপ কল।” তখন কে জানত, আর কোনও দিন তাঁর জীবনে আসবে না কোনও সকাল!
আদ্যন্ত ফ্যামিলি ম্যান বলতে যা বোঝাত, তিনি ছিলেন তা-ই। কাজ শেষ হলেই বলতেন, “চলো চলো ঘর চলো।” বাবার মৃত্যু আমার মা-র কাছেও তো বড় আঘাত। এখন তিনিও অনেকটা সামলে নিয়েছেন নিজেকে। এই বছরের শেষে বা সামনের বছরের শুরুতেই আমি পরিচালনায় ফিরব।
তাঁর স্বপ্ন ছিল, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ স্টুডিয়োকে অত্যাধুনিক রূপ দেওয়া। আমেরিকা থেকে আর্কিটেক্ট আনিয়ে আমি বাবার স্বপ্নকে সার্থক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। বলতে দ্বিধা নেই, সুযোগসুবিধার দিক দিয়ে আমাদের এই স্টুডিয়ো এখন বিদেশের সেরাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। স্টুডিয়োর মধ্যে বসবে বাবার ব্রোঞ্জ মূর্তি। বাবার স্মৃতি জড়ানো এই পেন্টহাউসেই বসব আমিও।
বাবার কোন ছবির গান আমার সব চেয়ে প্রিয়? ‘আমির গরিব’ ছবির ‘ম্যায় আয়া হু ম্যায় আয়া হু’ এবং ‘হীরা পান্না’র সব গানই।
পিছন ফিরে তাকাতে মানা করতেন। কিন্তু কী করে ভুলব?, জন্মদিনে ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ বলার পরেই তাঁর সেই ভুবনভোলানো হাসি? কী করে ভুলব, বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খাওয়ার সেই স্বর্গীয় দৃশ্য?
তাঁর জন্মদিনে এখনও সকাল থেকেই ফোনে-ফোনে, এসএমএসে ভেসে আসে অজস্র শুভেচ্ছাবার্তা। বাবা হারিয়ে যেতে পারেন না। তিনি সর্বদাই আছেন আমার সঙ্গে।
আমার চেতনায়, আমার অনুভবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.