মনোরঞ্জন...
ব্যান্ড বাজা আবৃত্তি
হুঁকোমুখো হ্যাংলা বাড়ি তার বাংলা
মুখে তার হাসি নাই দেখেছ?
নাই তার মানে কি
কেউ তাহা জানে কি
কেউ কভু তার কাছে থেকেছ?—
এই হুঁকোমুখো হ্যাংলাকে আমরা যে যার মতো কল্পনা করেছি ‘আবোলতাবোল’-এর ছড়া পড়ে। হুঁকোমুখো হ্যংলার বাড়িই বা কোথায়, তার কাছে থাকতেই বা কেমন লাগে সে তো সরস অনুভূতির ব্যাপার।
সেই অনুভূতিকে জ্যান্ত করতে শুধু ছড়াটা আবৃত্তি করেই শেষ করে দেওয়া যায় না। ইচ্ছে করলে প্রাণ প্রতিষ্ঠাও করা যায় অনাবিল ‘ননসেন্স’ কল্পনায়।
এমনটাই মনে করছেন ‘মহুল’ আবৃত্তি ব্যান্ডের শাঁওলি। আর ‘মহুল’ই বা কেন, কলকাতার একাধিক আবৃত্তি ব্যান্ড এখন ‘আবোলতাবোল’-এর এই সব মজাদার ছড়া থেকে শুরু করে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছন্দমেদুর ‘পালকির গান’, রবীন্দ্রনাথের ‘দিনের আলো নিবে এল/ সুয্যি ডোবে ডোবে’ থেকে আধুনিক সব রকম কবিতাই সমবেত ভাবে আবৃত্তি করছেন।
প্রশ্ন একটাই। একক শিল্পীর আবৃত্তিতে এত দিন যে অনুভূতি সঞ্চারিত হয়েছে তার থেকে বাড়তি কী দিতে পারছে আবৃত্তির ব্যান্ড?
নতুন যেটা, তা হল চোখের সামনে সুরে লয়ে জীবন্ত হয়ে উঠছে কবিতা! শুধু কথার ওঠাপড়ার জাদুতে নয়, ছড়ার সঙ্গে সঙ্গত করছে কখনও স্প্যানিশ গিটার, কখনও বা পারকাশন। থাকছে ব্যাক ভোকালস, আর ভোকাল হারমনির মেলবন্ধন।
শোভনসুন্দরের আবৃত্তির সঙ্গে জ্যাম করছেন বিক্রম ঘোষ
আবৃত্তি ব্যান্ডের এই রংদার সাফল্যের খতিয়ান কিন্তু চলছে বেশ অনেক দিন ধরেই। সে ২০০৩-এ শুরু হওয়া শোভনসুন্দর বসুর ব্যান্ড ‘বৃষ্টি’ হোক বা হালে শাঁওলি, পলাশদের আবৃত্তির ব্যান্ড ‘মহুল’।
‘মহুল’ ব্যান্ডের শাঁওলি চান গানের মতোই নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মোবাইলেও রিংটোন বা কলার টিউন হয়ে উঠুক তাঁদের আবৃত্তি। “আমাদের উদ্দেশ্যই নতুন জেনারেশনকে আবৃত্তি শোনানো। দেখবেন এরা যত গান বা ভিডিয়ো সারা দিনে ডাউনলোড করে, আবৃত্তির কোনও জায়গাই সেখানে নেই। আবৃত্তি মানেই বেশ একটা ভারিক্কি ব্যাপার, এই কনসেপ্টটাকেই আমরা বদলাতে চেয়েছি,” আবৃত্তির প্রচলিত ব্যাকরণ ভেঙে। বলেন তিনি।

আয় বৃষ্টি ঝেঁপে
বাংলা আবৃত্তিতে প্রথম লাইভ মিউজিক ইন্ট্রোডিউস করা ছাড়াও রাজা সেনের পরিচালনায় প্রথম আবৃত্তির ভিসিডিও প্রকাশ করেছিল শোভনসুন্দরদের ব্যান্ড ‘বৃষ্টি’ই। কিন্তু আবৃত্তির ব্যান্ড ব্যাপারটা কেমন যেন একটু গিমিকের মতো শোনায় না! উত্তরে বললেন, “গিমিক হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। ভাল গান গাইতে গেলে যেমন রাগরাগিণী ভাল জানতে হয়, ঠিক তেমনই আবৃত্তিশাস্ত্র জানতে ছন্দটাকে জানতে হবে। ছন্দও তো রাগরাগিণী ছাড়া কিছুই নয়। অনেক সাঙ্গীতিক উপাদান রয়েছে এতে।”
কিছু দিনের মধ্যেই বেরোবে বিক্রম ঘোষের সঙ্গে কবিতার অ্যালবাম। বললেন, “বিক্রমের তাল আর কবিতার ডি-কনস্ট্রাকশন, এটাই আমাদের কাজের বিষয়। আবৃত্তির দুনিয়ায় এ রকম নিদর্শন কিন্তু অভূতপূর্ব।”

এই বেশ ভাল আছি
‘শঙ্খমালা’ আবৃত্তি দলের সুমন্ত্র সেনগুপ্ত বললেন, “ব্যান্ড ব্যাপারটা সাম্প্রতিক কালের ‘কয়েনেজ’। বিভিন্ন গানের দল যেমন ব্যান্ড হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, আমার মনে হয় আবৃত্তির ব্যান্ডও সেই একই কারণে করা। গোটা ব্যাপারটাতে চমকটাই যেন বড়। গানের ব্যান্ড এতটা জনপ্রিয়তা না পেলে, আবৃত্তির ব্যান্ডও আদৌ তৈরি হত কি?”
সুমন্ত্ররা আবৃত্তির সঙ্গে ব্যবহার করেন রেকর্ডেড মিউজিক। তাঁর মোদ্দা কথা, ব্যান্ড চলুক ব্যান্ডের মতো আর স্বকীয় আবৃত্তি সংস্থাগুলো চলুক প্রচলিত ধারায়। এই দুইয়ের সমন্বয়েই তো আসল মজা।

ব্যান্ডবাজা না দলবাজি
হাওড়ার ‘শ্রুতি মঞ্জিল’ আবৃত্তি দলের সোমনাথরা যেমন ১৩৫ জনের দল হিসেবে কাজ করছেন, তেমনই ছ’জন সদস্যের ব্যান্ড ‘আবৃত্তি অন রিদম’ নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যান্ড পারফর্ম্যান্সও করছেন। কথায় কথায় জানালেন, “ব্যান্ড করে তা চালু রাখতে গেলে বেশ বড় রকম খরচের ব্যাপার থাকে। অনেক আবৃত্তি দলের পক্ষেই যা সম্ভব নয়।”
কাটোয়ার নন্দন সিংহ ২০০ জন সদস্য নিয়ে তিনি তাঁর আবৃত্তি দল ‘বহুবচন’ চালাচ্ছেন প্রায় পঁচিশ বছর। বললেন, “আমি কোনও দিন ব্যান্ড বানানোর কথা ভাবিনি। তবে আবৃত্তির সঙ্গে মিউজিকের যথাযথ প্রয়োগ হলে বেশ ভালই লাগে। সত্যি বলতে মিউজিক নিয়ে প্রচুর রিহার্সাল করতে হয় যা খরচসাপেক্ষ তো বটেই, আবার এক দিনে করা সম্ভবও নয়।”
মোদ্দা কথা একটাই, আবৃত্তির ব্যান্ডবাজি ভালই চলছে আর চলবেও। জেন ওয়াইও আবৃত্তি শুনুক, এমনটাই যে চান এ প্রজন্মের আবৃত্তিকারেরা।

রূপম ইসলাম

ব্যাপারটা বাংলায় নতুন হচ্ছে। ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডে
নতুন নয়। জিম মরিসন নিজে কবি ছিলেন।
স্টেজে ড্রামস, অরগ্যান, গিটার নিয়ে যখন পারফর্ম
করতেন, তখন কবিতাটাই গান হয়ে উঠত।
আমার মতে আবৃত্তির সঙ্গে যদি মিউজিক,
তা হলে সেটা গানই। মিউজিশিয়ানরাও
তো তা ভেবেই বাজান।

জগন্নাথ বসু
প্রথম দিকে ব্যান্ডের নানা কায়দা ভাল লাগত না।
কিছুটা কৃত্রিম ভাবে চাপিয়ে দেওয়ার মতো মনে হত
বিষয়টা। স্বতোৎসারিতার অভাব ছিল। ইদানীং কিন্তু
এরা পেশাদারি দক্ষতায় কাজ করছে। বিষয় আর
আঙ্গিক পরস্পরের পরিপূরক হলে তবেই কিন্তু
এই জায়গাটায় পৌঁছনো যায়। ফাঁকিবাজি
করে সম্ভব নয়।


বিজয়লক্ষ্মী বর্মন

আবৃত্তির মতো কঠিন পারফর্মিং আর্ট খুব কমই আছে।
কবিতার তো নিজেরই রিদম আছে। মিউজিক বা অলঙ্করণ
যেন মূল বিষয়কে ছাপিয়ে না যায়। ব্যান্ডের ক্ষেত্রে
বোধহয় শোনার চাইতে দেখার বিষয়টাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে ওঠে। আমি তাই বিশুদ্ধ আবৃত্তি নিয়েই খুশি।

ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়

আবৃত্তি করার সময় ট্র্যাক বাজালে কবিতায় কনসেনট্রেট
করতে অনেক সুবিধে হয়। একজন ভাল ট্র্যাক
অপারেটর থাকলেই যথেষ্ট। কবিতা তো আর গান
নয় যে তার একটা নির্দিষ্ট স্বরলিপি থাকবে। কবিতার
সঙ্গে জড়িত ইমোশন বদলাতেই পারে। লাইভ
মিউজিকের কোনও প্রয়োজনই সেখানে নেই।


সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়

আমি আবৃত্তির সঙ্গে ট্র্যাকে মিউজিক চালাই। দেবজ্যোতি বসু মিউজিক অ্যারেঞ্জ করেন। প্রত্যেকটা কবিতার
সঙ্গে ইনডিভিজুয়ালি গিটার, সেতার, সরোদ, তবলা ব্যবহার করা হয়। কবিতার সঙ্গে এমন মিউজিক কখনওই
ব্যবহার করা উচিত নয় যাতে কবিতার মাধুর্য নষ্ট হয়। মিউজিক থাকবে অলঙ্কারের মতো। ভাবনাটাকে সঠিক
ভাবে দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ব্যান্ড পারফর্ম্যান্স নিয়ে আমার আপত্তি নেই।
তবে শুনতে গেলে সবটা কেমন যেন গুলিয়ে যায়।


রায়া ভট্টাচার্য

মানুষ সব সময়ই বৈচিত্র খোঁজে। তাই যা কিছু বৈচিত্রপূর্ণ,
নান্দনিক তাই তাঁদের ভাল লাগতে বাধ্য। সময়ের সঙ্গে
সঙ্গে বদলে গিয়েছে আমাদের জীবনযাত্রা, মূল্যবোধ,
দৃষ্টিভঙ্গি। আলো বা ধ্বনি সহযোগে এখন যে ভাবে
আবৃত্তির উপস্থাপনা হচ্ছে, তা বর্তমান যুগের সঙ্গে
তাল মিলিয়ে আমার মতে যথেষ্টই প্রাসঙ্গিক।

অভিজিৎ বর্মন (পটা)

আবৃত্তির ব্যান্ড ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়। আবৃত্তির
সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর হিসেবে বা লাইভ মিউজিকের
ব্যবহার গোটা বিষয়টাকে যথেষ্ট কালারফুল করে
তোলে। এখনকার ছেলেমেয়েরা যে কবিতা নিয়ে নতুন
কিছু ভাবছে এটাই অনেক বড় ব্যাপার। দেখতে হবে
গান বা মিউজিক যেন কবিতা বলার
জায়গাটাকে হ্যাম্পার না করে।


ঐশ্বর্যা বসু

আবৃত্তির ব্যান্ড বেশ একটা এক্সপেরিমেন্টাল কাজ। সত্যি বলতে আবৃত্তি নিয়ে প্রথাগত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে
চিন্তাভাবনা করার লোক ইদানীং কমে গিয়েছে। শোভনসুন্দর তাঁর ব্যান্ড ‘বৃষ্টি’কে নিয়ে বেশ এক্সপেরিমেন্টাল কাজ
করেছিলেন। এখন যাঁরা ব্যান্ড করছেন তাঁরা ভবিষ্যতে বাংলা গানের ব্যান্ডের মতোই জনপ্রিয়তা পাবেন আশা করি


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.