সাক্ষাতের জন্য সাজন গেল সেখানে। দেখল এক সুন্দরী তরুণী কার জন্য অধীর অপেক্ষায় ঘন ঘন জল খাচ্ছে। ও বুঝল ও-ই ইলা। কিন্তু নিজের গোঁফ-চুলে পাক ধরা প্রৌঢ় চেহারাটা ওর সামনে নিয়ে ফেলতে পারল না। পর দিন ইলার ডাব্বা এল বিলকুল খালি। তাতে শুধু একটা অভিমানী চিরকুট।
কিন্তু এখানেই কাহিনির শেষ নয়। বাকিটুকু বললে ছবি ও দর্শকের প্রতি অবিচার করা হবে। তবে যেটা বললে দোষ হবে না, কারণ সেটা ছবির বিজ্ঞাপনেই ব্যবহার করা হচ্ছে তা হল ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ হল এমন দুই প্রেমিকের গল্প যাদের কখনও দেখাই হয় না।
না দেখার কান্নাটাই ‘দ্য লাঞ্চবক্স’-এর মূল সুর। এই কষ্টটা ভাঙার জন্য একটা চরিত্র আছে ছবিতে সাজনের দফতরে কাজ শিখতে আসা তরুণ। নাম শেখ। কাজ শেখার থেকে কাজ ভণ্ডুল করতেই যার দক্ষতা বেশি। কমিক রিলিফের দায় সামলাতে সামলাতে এক সময় সাজনের সঙ্গে এক রকমের অনুভূতির সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়ে শেখ। ট্রেনে ভিড়ের কামরায় একদিন ওরই মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ে একটা দার্শনিক কথা যা ছবির থিম থট, অর্থাৎ মূল ভাবনা হতে পারে। “কভি কভি গলত ট্রেন ভি সহি জগাহ্ পঁহুচা দেতি হ্যায়।”
সত্যজিতের ‘মহানগর’-এ শেষ দিকে একটা আশার আলো দেখা গিয়েছিল। রীতেশ বাত্রার ‘দ্য লাঞ্চবক্স’-এর শেষ কিন্তু চোখের জল আর বিহ্বলতায়। নানা ট্রেন নানা রুটে যাওয়ার মধ্যে কোথায় যেন একটা সম্পর্কহীনতার আভাস। ‘দ্য লাঞ্চবক্স’-এ মুম্বই জীবনের উপর এক নির্মম মন্তব্য চোখে পড়ে। আকাঙ্ক্ষার শহরে আশাভঙ্গের রোজনামচা। মুম্বইয়ের সবটাই অমিতাভ বচ্চন আর সচিন তেন্ডুলকর নয়।
মুম্বই অবসরের আগে অবসর নেওয়া সাজন ফার্নান্ডেজেরও শহর। যে শহর ছেড়ে এখন নাসিকে বসতি করতে চাইছে। একটু শান্ত জীবনের লক্ষ্যেই হয়তো। মুম্বই ছেড়ে ভুটান যাওয়া মনস্থ করেছে ইলা। না হলে বহুতল থেকে ঝাঁপাতে হতে পারে ওকেও।
সাজনের ভূমিকায় এমন অভিনয় করেছেন ইরফান খান, যা ভারতের মাপকাঠিতে মাপা কঠিন। একেবারে আন্তর্জাতিক মানের। শুধু চোখ, শুধু মুখভাব এবং নীরবতা দিয়ে যে কাজ সেরেছেন, তা শতেক কথার বাড়া। অল্প কথার মানুষ সাজন, তার কম হাসি, চাপা বিরক্তি, আবার প্রশ্রয়ের চাহনি সব মিলে একটা চেনা জ্যান্ত মানুষ তৈরি করে দেয়।
নিমরত কউরের নরম, কিছুটা দিশেহারা ইলাও একটা চমক! তাঁরও মুখ-চোখ কথা বলে। গোটা উপস্থিতির মধ্যেই একটা নিঃসঙ্গ ভাব। হিন্দিতে লেখা তাঁর চিরকুটের মাধ্যমে কণ্ঠস্বর এলে (সাজন ফার্নান্ডেজের চিরকুট সব ইংরেজিতে) কী রকম একটা আরাম হয় সাজন এবং দর্শকের। ক্যাডবেরি বিজ্ঞাপনের মেয়েটিই যে এই রোল করেছে ভেবে অবাক হচ্ছি। |
আর নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকির শেখ তো একটা ভীষণ, ভীষণ প্রিয় চরিত্র হয়ে ওঠে। ওঁকে দেখতে দেখতে একেক সময় আমার মনে পড়েছে বাংলার রবি ঘোষকে। ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ ছবির পরিচালনার গুণ এটাই যে কোথাও কোনও বাড়াবাড়ি বা কারিকুরির ছাপ নেই। যে ক্যান্টিনে বসে সাজন ও শেখ লাঞ্চ খায়, সেখানে ওদের দু’জন এবং আশেপাশের এক-আধজন ছাড়া ক্যামেরা কাউকে ধরে না।
চিরকুট পড়ার নির্জনতা বা শেখকে সাজনের শাসন করা এ ভাবেই তোলা। কিন্তু শেষে একটা টপ শটে গোটা পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় করানো হয় দর্শকের। এ ছাড়া ডাব্বাওয়ালাদের কেত্তন গেয়ে গেয়ে ট্রেনে পাড়ি দেওয়াও একটা সাবলীল প্রসঙ্গ। আর অতি অবশ্য ইলার চাচি, যার শুধু কণ্ঠই শুনি আমরা, মানুষটিকে চোখেও দেখি না। শহুরে সম্পর্কের এর চেয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ চিত্রায়ণ আর কী হতে পারে!
এই ছবি অস্কারে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছে না জেনে একটু খারাপই লাগছে। ‘দ্য গুড রোড’ কতখানি ভাল বা খারাপ জানি না কারণ দেখা হয়নি, তবে এ ছবির বদলে যখন গেছে তখন নিশ্চিত হতে হবে খুবই ভাল। দেখা যাক। |