|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
তথ্য থেকে আখ্যানে নকশাল আন্দোলন |
শিলাদিত্য সেন |
আটটা-ন’টার সূর্য, অশোককুমার মুখোপাধ্যায়। দে’জ (প্রকাশিতব্য)
লাল তমসুক, অমর ভট্টাচার্য। গাঙচিল, ৪০০.০০ |
বাংলা উপন্যাসের অনিশ্চিত বিকাশের কথা মেনে নিলেও এ তো সত্য যে, কথাকারেরা ক্রমশই খুঁজে চলেছেন নিজেদের লিখনভঙ্গির নতুন কোনও গড়ন, বা বিষয়ের নতুন কোনও অভিঘাত। সে চেষ্টা সার্থক পরিণতি পাবে এমন কোনও নিশ্চয়তা যেমন নেই, তেমন তা বাতিল করে দেওয়ারও কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তা ছাড়া আধুনিকতার সংজ্ঞা বরাবরই গোলমেলে, বিবিধ কাঠামোয় কোনও আখ্যানকে আঁটাতে গিয়ে আমরা বড় বেশি তত্ত্ব পেশ করি। ফলে সে উপন্যাসের শ্বাসেপ্রশ্বাসে-ঘামরক্তের জীবন, বা স্পন্দ্যমান মানুষ অবান্তর হয়ে যায়।
বাংলা উপন্যাস পড়ার এমন বিপজ্জনক প্রবণতা থেকে বেরিয়ে যদি একটু খেয়াল করা যায় যে কোনও নবীন ঔপন্যাসিক কোনও বিকল্প আধুনিকতার আদল এনে ফেলার চেষ্টা করছেন তাঁর রচনায়, তবে তা অবশ্যই পড়ে ফেলা উচিত, শিল্প হয়ে-ওঠা বা না-ওঠার কূটতর্কে না মেতে।
বিকল্প আধুনিকতার একটা আবিষ্কার সব সময়ই সঞ্চিত থাকে বিপুল তথ্যসংগ্রহের পদ্ধতিতে। সে পদ্ধতিই নিয়েছেন অশোককুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রকাশিতব্য উপন্যাস আটটা-ন’টার সূর্য-তে। শুরুতে বলেছেন যে এ তাঁর ‘নকশালপন্থী রাজনীতি নিয়ে তথ্য-উপন্যাস’। সঙ্গে এও বলতে ভোলেননি যে ‘এই আখ্যানে চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, সরোজ দত্ত প্রমুখ ঐতিহাসিক চরিত্রের গমনাগমন থাকলেও, তাঁদের চলনের নিরানব্বই ভাগ কাল্পনিক।’
আসলে একজন ঔপন্যাসিক তাঁর আখ্যানের বিবরণের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারেন নিজে না জেনেই। তিনি আসলে তখন বহু মানুষের এমন স্বর খুঁজে বেড়ান, যে বহুস্বরের মধ্যে তাঁর নিজের স্বরও মিশে থাকে। আখ্যানকার কোনও জায়গায় তাঁরই কথা বলে প্রায় কোনও কথা বলেন না, অথচ আখ্যানকারের নিজের স্বর ছাড়া অন্য সব স্বরই সেখানে অর্থহীন। অন্য বহুস্বর ছাড়া তাঁর সেই নির্দিষ্ট স্বর চিনে নেওয়া যায় না, কিন্তু আখ্যানকারের নিজস্ব স্বর ছাড়া সেই অন্য স্বরগুলি হয়ে যায় অপ্রাসঙ্গিক। এই দুইয়ের টানাপড়েন থেকেই তৈরি হয় অশোককুমারের উপন্যাসের আততি।
এই আততির কথা ভূমিকা-য় মনে করিয়ে দেন সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়: ‘উপন্যাসটি এক বিশেষ ঢং-এ রচিত— যাকে বলা যেতে পারে documentary novel বা তথ্য-নির্ভরশীল ঐতিহাসিক দিনলিপি ও চরিত্রের সঙ্গে কাল্পনিক ঘটনা ও নায়ক-নায়িকার একীকরণের রচনাশৈলী। ... প্রামাণিক দলিল-ভিত্তিক বিবরণীর গণ্ডি ভেঙ্গে কাল্পনিক চরিত্রগুলি মনোজগতে ডুব দেয়।’
উপন্যাসটির গুরুত্বপূর্ণ এক আখ্যানাংশ উদ্ধৃত করলে এই আততির স্বরূপ স্পষ্ট হবে আরও। অংশটি চারু মজুমদারকে নিয়ে: ‘তাঁর কমরেডরা সারা দেশ জুড়ে শহরে-গ্রামে লড়াই করছে। তাদের সঙ্গে সংযোগ রাখার পক্ষে কলকাতাই সবচেয়ে ভালো জায়গা। ঊনসত্তরে পার্টি গঠিত হওয়ার পর থেকে সত্তর সালের নভেম্বর অবধি আন্দোলনের সেই তুঙ্গ অবস্থায় যখন পুলিশ-সি আর পি-র সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই শহরের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘর্ষ চলছে, তখনও তিনি কলকাতা ছেড়ে যাননি। তাঁর মতো সরোজবাবু, সুনীতিবাবু-সহ আরও অনেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কলকাতা বা শহরতলীর বিভিন্ন শেলটারে আত্মগোপন করে থেকেছেন। যেন জলের মধ্যে মাছ। পুলিশ টের পায়নি একদম। কলকাতার দক্ষিণ পূর্বে, গার্ডেনরিচ রেল কলোনিতে গোপনে অনুষ্ঠিত হয়েছে পার্টি কংগ্রেস। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিনিধিরা এসেছিলেন সেই সম্মেলনে। গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছে সেই অনুষ্ঠান। পার্টি কংগ্রেসের আগে, কলকাতার থেকে ট্রেনের অসংরক্ষিত কামরায় চেপে তিনি ঘুরে এসেছেন ভারতবর্ষের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। উপস্থিত থেকেছেন পার্টির প্রতিটি রাজ্য সম্মেলনে। যে শহর তাঁকে নিরাপত্তা দিয়েছে, সংযোগের এত সুবিধা দিয়েছে সেই কলকাতা ছাড়তে হবে? হ্যাঁ কমরেড ছাড়তে হবে। কারণ শেলটারের সংখ্যা কমে আসছে। শহর আগের মতো নিরাপদ নয় আর। দ্বিতীয় কথা, আপনার শরীর খুবই খারাপ। বেলগাছিয়ার এই আলোবাতাসহীন, স্যাঁতসেতে ঘরে থাকলে শরীর আরও খারাপ হবে। পার্টির স্বার্থে আপনার নিরাপদ থাকা, সুস্থ থাকা দরকার। কমরেডদের চাপে সেই কলকাতা ছেড়ে বেরনো।’
শুধুমাত্র একটা কালপর্বে আটকে থাকে না এই আখ্যান, নিছক ‘পিরিয়ড-নভেল’ না হয়ে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-জঙ্গলমহলের সাম্প্রতিককে ছুঁয়ে ফেলে। নকশাল আন্দোলনের স্বপ্ন বা আদর্শ আজও কী ভাবে বাহিত নতুন প্রজন্মে, তার ইঙ্গিতেই লেখক শেষ করেন উপন্যাসটি।
১৯৬৭-র এই নকশাল আন্দোলনকে বিচ্ছিন্ন ভাবে না দেখে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণের জন্যে এক প্রামাণ্য তথ্য-সংকলন তৈরি করেছেন অমর ভট্টাচার্য লাল তমসুক। যেহেতু নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষিত ও বিস্তার সমাজকর্মী ও গবেষকদের নিরীক্ষার বিষয়, সে জন্য প্রায় ইতিহাস খুঁড়ে বের-করে-আনা অতীব শ্রমসাধ্য এ-কাজটির কারণে অমরবাবু ধন্যবাদার্হ। শুধু এ-দেশ নয়, সারা দুনিয়ার মাওপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে এই নকশাল আন্দোলনের যোগসূত্র আবিষ্কার, অপ্রকাশিত ও অকথিত দলিল উদ্ধার ঋদ্ধ করেছে বইটিকে। ‘আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এমন একটা ঐতিহাসিক ঘটনার তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাস থাকা প্রয়োজন।’— মুখবন্ধ-এ লেখকের এ-মন্তব্যের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে ১৯৭২-এ ১ অগস্ট মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় সংগঠনী কমিটি থেকে প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রচারপত্রের বক্তব্যকে। ক’দিন আগেই ২৮ জুলাই শহিদ হয়েছেন চারু মজুমদার, সে উপলক্ষেই প্রচারপত্রের শিরোনামে ছিল: ‘বিপ্লবীদের হত্যা করে কোনও দেশের বিপ্লবকে ধ্বংস করা যায়নি। কমঃ চারু মজুমদার ও অন্যান্য বিপ্লবীকে হত্যা করে ভারতের বিপ্লবকে ধ্বংস করা যাবে না।’
প্রথমটি তথ্যের আখ্যান, পরেরটি তথ্যের সম্ভার, দু’টি বই-ই গত শতকের নকশাল আন্দোলন সম্পর্কে একুশ শতকের পাঠকের কাছে অজানা দরজা খুলে দেবে। |
|
|
|
|
|