পুস্তক পরিচয় ১...
জঙ্গলমহলে এক আমলার দিনলিপি
কিন্ডলিং অব অ্যান ইনসারেকশন/ নোটস ফ্রম জঙ্গলমহলস, চন্দন সিন্হা। রাটলেজ, ৮৫০.০০
দৃশ্যটা চোখে পড়েছিল বাঁশপাহাড়িতে। এক অবসন্ন অপরাহ্ণে পুরুলিয়া ও ঝাড়খণ্ড লাগোয়া পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রত্যন্তে বিনপুর-২ ব্লকের বাঁশপাহাড়ির এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের বাইরে অস্বাভাবিক ভিড় দেখে চোখ আটকে গিয়েছিল। ভিড়ের হাতে হাতে ঘুরছে দড়িতে বাঁধা ছাগল। ছাগল কিনতে নাকি ঋণ দেওয়া হচ্ছে শবরদের।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বোঝা গেল, কুমিরছানা দেখানোর মতোই ছাগলছানা দেখিয়ে ঋণ নিচ্ছেন শবরেরা। ছাগল ‘ভাড়া’ নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন মহাজনের কাছ থেকে। ছাগলপিছু ‘ভাড়া’ ২০০ টাকা। গরুর ক্ষেত্রে টাকাটা আরও বেশি। তৎকালীন শাসক দলের কিছু নেতা এবং পঞ্চায়েতের কোনও কোনও কর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, এই ঋণ পাওয়ার পিছনে ‘লেনদেন’ রয়েছে। কারণ, তাঁদের সুপারিশ মেনেই ঋণের তালিকায় নাম ওঠে শবরদের। ছাগল কেনার ঋণ তো মেলে, কিন্তু সেই ছাগল কি শবরের ঘরে পৌঁছয়? প্রশ্নটা করা মাত্রই সমবেত জনতা যে ভাবে হেসে উঠেছিল, তার মধ্যেই স্পষ্ট ছিল উত্তরটি।
মাওবাদীদের একদা মুক্তাঞ্চল সেই বাঁশপাহাড়ির স্মৃতি ঝলসে উঠল চন্দন সিন্হার বইটি পড়তে পড়তে। এ যে আদতে এক জন আমলার লেখা তা বলে না দিলে বোঝা মুশকিল। ২০০৪-এর ৩ মার্চ পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক হিসেবে যোগ দেন চন্দন। এর পর থেকে জেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরতে শুরু করেন তিনি। তৈরি করতে থাকেন ‘ট্যুর নোট’। আর সেই ‘ট্যুর নোট’ ধীরে ধীরে পরিণত হতে থাকে অবহেলিত জেলার প্রান্তিক মানুষগুলোর সুখ-দুঃখের দিনলিপিতে।
দেশের সব থেকে অনগ্রসর মোট দেড়শোটি জেলার মধ্যে কেন্দ্রীয় যোজনা কমিশন পশ্চিম মেদিনীপুরকেও রেখেছে। স্বাভাবিক ভাবেই কেন্দ্র ও রাজ্যের বিভিন্ন প্রকল্পের সুফল এই জেলার মানুষ আদৌ পাচ্ছেন কি না বা পেলেও কতটা পাচ্ছেন, জেলাশাসক হিসেবে তা দেখা অবশ্যকর্তব্য ছিল চন্দনের। সেই কাজ করতে গিয়ে এই সরকারি অফিসার যে ভাবে গোটা বিষয়টিকে দেখেছেন তা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী।
পড়তে পড়তে মনে হয়, আমলা হিসেবে নয়, যেন কোনও সংবেদনশীল সাংবাদিকের চোখ দিয়ে প্রান্তিক মানুষগুলোর কথা তুলে ধরেছেন চন্দন সিন্হা। পশ্চিম মেদিনীপুরের জনজাতীয়দের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, দারিদ্র, অশিক্ষা, অজ্ঞতা এবং রাজনৈতিক ভাবে প্রান্তিক হয়ে যাওয়ায় তাঁদের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না। পাশাপাশি, পিছিয়ে পড়া এলাকায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ফাঁকফোকরও তাঁর নজর এড়ায়নি। তিনি লিখছেন, গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান এবং পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিদের অনেকেই প্রথম বারের জন্য ওই সব পদে বসেছেন। জেলাস্তরে তাঁদের অনেকেই দলীয় নেতৃত্বের হাতের পুতুল। বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়ণের আগে তা জেলার বা তার উপরের স্তরের দলীয় নেতৃত্ব খতিয়ে দেখেন। ফলে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব অবশ্যম্ভাবী বলে বিশ্লেষণ করেছেন চন্দন।
তিনটি ভাগে বিভক্ত এই বইয়ে রয়েছে ৪০টি অধ্যায়। রয়েছে অনেক ছবি, তালিকা, পরিসংখ্যান। পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন ব্লকের নানা অঞ্চল ঘুরতে ঘুরতে তাঁর যে ধরনের বোধোদয় হয়েছে, তা চমকপ্রদ। বিন্দুমাত্র ভণিতা না করে জঙ্গলমহলের পরিস্থিতি যে ভাষায় বর্ণনা করেছেন চন্দন, তা থেকেই বোঝা যায়, কেন এই বইটি ব্যতিক্রমী। তাঁর বক্তব্য, প্রায় প্রতিটি ব্লকে পঞ্চায়েতের কর্মী, সরকারি অফিসার এবং ঠিকাদারদের মধ্যে একটি চক্র রয়েছে। এমনকী, ঝাড়গ্রাম এলাকার ঠিকাদারদের অধিকাংশই জনজাতীয় নন। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প রূপায়ণের পর্যায়ে অর্থ নয়ছয় এখানকার বিভিন্ন অঞ্চলে খুব সাধারণ ঘটনা। ওই চক্রের লোকজন, যৌথ বা আলাদা ভাবে প্রতিটি প্রকল্প থেকে কমিশন নেয়। কখনও ঠিকাদারদের থেকে, এমনকী, উপকৃতদের কাছ থেকেও।

আমলাশোলের ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
২০০৫-এর ২৭ মার্চ শালবনির মহারাজপুর গ্রামে গিয়েছিলেন জেলাশাসক চন্দন। সেখানকার মহিলাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি দেখেন, সোমবারি টুডু, মণি মুর্মু এবং মাঙ্গলি মুর্মুর চোখে ছানি পড়েছে। সোমবারির বয়স ষাটের উপর। চোখে চশমা। দৃষ্টিহীনতা রোধে প্রতি বছর সরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করা হয়। সেখানে কেন তিনি যাচ্ছেন না? চন্দন এ কথা জিগ্যেস করা মাত্র সোমবারি বলেন, ওখানে টাকা লাগবে। জেলাশাসক যখন বলেন, ওখানে নাম লেখানো, অস্ত্রোপচার ও তার পরবর্তী দেখভাল সবটাই নিখরচায় হয়, তখনও সোমবারি তাঁকে বিশ্বাস করতে পারেননি। কারণ, তিনি কখনও এ রকম কথা শোনেননি। চন্দনের উপলব্ধি: সরকারি প্রকল্পগুলির প্রচারের হাল এমনই খারাপ যে, জেলা সদর থেকে মাত্র কুড়ি কিলোমিটার দূরের মানুষও সে সব প্রকল্পের কথা শোনেননি।
বিনপুর-১, বিনপুর-২, গোপীবল্লভপুর-১, আমলাশোল, নয়াগ্রাম, কেশিয়ারি, ঘাটাল, সাঁকরাইল, ঝাড়গ্রাম, জামবনি, মেদিনীপুর সদর, শালবনি, কেশপুর, খড়্গপুর, দাঁতন— একের পর এক জায়গা ঘুরেছেন চন্দন। নিছক সরকারি রিপোর্ট নয়, তিনি এই জেলার প্রান্তবাসীদের ছোট ছোট সুখ-দুঃখের কাহিনি বিবৃত করেছেন তাঁর বইয়ের একের পর এক অধ্যায়ে। শুধু সমস্যার কথাই বলেননি, তার সমাধানের পথও বাতলেছেন। চমৎকার বিশ্লেষণে সমস্যার স্বরূপ তুলে ধরার আন্তরিক প্রয়াস রয়েছে।
চন্দন যে সময়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসকের দায়িত্ব নেন, সে সময়ে এই জেলার বিরাট এলাকা, বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি ব্লকে সংশয়াতীত প্রাধান্য বিস্তার করেছে মাওবাদীরা। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ২০০৮-এর ২ নভেম্বর শালবনিতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়ে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণের উল্লেখ করে তিনি বর্ণনা করেছেন, কী ভাবে ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৬ নভেম্বর লালগড়ের ছোটপেলিয়া গ্রামে তল্লাশির সময় পুলিশি অত্যাচারের অভিযোগ ওঠে। একটি চোখের দৃষ্টি হারান ৫৫ বছরের মহিলা চিন্তামণি মুর্মু।
ওই ঘটনা আসলে ছিল খড়ের গাদায় আগুন ধরানোর মতোই। এর পরে লালগড় থানা অবরোধ করেন জনজাতীয়রা। থানার বিদ্যুৎ ও টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। হাজার হাজার সাঁওতাল তির-ধনুক-টাঙ্গি নিয়ে রাস্তা কেটে দিয়ে, গাছ ফেলে লালগড়কে জেলার বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। চন্দন লিখছেন, এর পরের কয়েকটি মাস গোটা পৃথিবী, সম্ভবত প্রথম বার টেলিভিশনের পর্দায় ‘লাইভ’ দেখল, মাওবাদী গেরিলাদের হাতে এক বিরাট অঞ্চল কী ভাবে ‘মুক্ত’ হয়ে রইল!
চন্দনের পাঠানো ‘ট্যুর রিপোর্ট’ পড়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর চোখে জল এসে গিয়েছিল বলে মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ের এক অফিসার চন্দনকে জানিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দেন, চন্দনের ওই ‘ট্যুর রিপোর্ট’ রাজ্যের তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রক থেকে প্রকাশিত ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’-এ মুদ্রিত হোক এবং তার কপি তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধীর কাছেও পাঠানো হোক।
এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু অসংখ্য উন্নয়নমূলক প্রকল্প তৃণমূল স্তরে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না তা দেখার মানুষের হয়তো অভাব পড়েছিল। একদা লৌহকঠিন দুর্গ কখন যে তাসের হয়ে গিয়েছিল, তা বুঝতেও পারেনি তৎকালীন শাসক দল।
সে দিনের জেলাশাসক, এখন রাজ্যপালের সচিব চন্দন সিন্হা মনে করেন, জঙ্গলমহলের আগুন হয়তো সাময়িক ভাবে প্রশমিত হয়েছে। তবে সে আগুন ছাইচাপা!
চন্দন সিন্হার মতো আমলা বেশি থাকলে আমআদমি উপকৃত হবেন, কিন্তু কোনও শাসকদলের পক্ষেই কি তা স্বস্তিদায়ক?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.