না-ভোটেরও অধিকার চাই, বলল আদালত
নির্বাচনে স্বচ্ছতা এবং সংস্কারের পথে আরও এক ধাপ। কোনও প্রার্থীকেই পছন্দ না হলে এ বার থেকে ভোট দিয়ে সেই মত প্রকাশের অধিকার ভোটারদের হাতে তুলে দিল সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালত আজ এক ঐতিহাসিক রায়ে বলেছে, বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্রে (ইভিএম) বা ব্যালটে ‘উপরের কোনও প্রার্থীকেই নয়’ বলে একটি বোতাম বা চিহ্ন রাখতে হবে। যে বোতাম টিপে বা যে চিহ্নে ছাপ দিয়ে ভোটার নিজের অসন্তোষ নথিভুক্ত করতে পারবেন। এই ব্যবস্থা রাজনৈতিক দুর্নীতি, দাগি প্রার্থী আর পেশিশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বড় অস্ত্র হয়ে উঠবে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের আশা। এই রায়ের পরে পাঁচ রাজ্যে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনেই ইভিএমে এমন বোতাম রাখার প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন।
‘পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ’ (পিইউসিএল) নামে একটি বেসরকারি সংস্থার আবেদন করা মামলায় রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি পি সদাশিবমের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ আজ জানায়, কোনও প্রার্থীকেই ভোট না দিয়ে তাঁদের প্রত্যাখ্যান করার অধিকার রয়েছে নাগরিকদের। প্রার্থীদের নিয়ে যাঁরা সন্তুষ্ট নন, এই প্রক্রিয়া চালু হলে তাঁরাও ভোটদানে সামিল হতে উৎসাহ পাবেন। বিশ্বের তেরোটি দেশে এই ‘না-ভোট’ ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। এই ব্যবস্থা চালু হলে রাজনৈতিক দলগুলি স্বচ্ছ ভাবমূর্তির ব্যক্তিকে প্রার্থী করতে বাধ্য হবে বলেই মনে করে সুপ্রিম কোর্ট।
ভারতীয় সংবিধানের নির্বাচন পরিচালনা বিধি (১৯৬১)-র ৪৯-ও ধারা অনুসারে ভোট না দেওয়ার অধিকার কিন্তু ভোটারদের এখনও রয়েছে। তবে সে জন্য ভোটারকে বুথে এসে প্রিসাইডিং অফিসারকে তা জানাতে হয়। তার পর একটি নির্দিষ্ট ফর্ম পূরণ করে তাতে সই করে জমা দিতে হয়। স্বাভাবিক ভাবেই সেই পদ্ধতিতে ভোটারের নাম ও পরিচয় গোপন থাকে না। কিন্তু ইভিএম বা ব্যালটে ‘না-ভোট’ চিহ্ন চালু হলে ভোটারের নাম-পরিচয় গোপন থাকবে। প্রার্থীদের প্রতি অনীহায় অনেকে ভোট দিতেই আসেন না। এ বারে সেই অসন্তোষ তিনি বোতাম টিপে প্রকাশ করতে পারবেন।
এই ব্যবস্থা কার্যকর হলে ভোটযন্ত্রে কী পরিবর্তন হবে?
এখন ইভিএমে প্রার্থীদের নাম ও তাঁদের নির্ধারিত চিহ্নের পাশে একটি বোতাম থাকে। এ ভাবে কোনও কেন্দ্রে যত জন প্রার্থী থাকেন, তাঁদের সকলের নাম, চিহ্ন ও বোতাম উপর থেকে নীচে পরপর সাজানো থাকে। ভোটার যে প্রার্থীকে বেছে নেন, সেই নাম ও চিহ্নের পাশের বোতামে চাপ দিয়ে নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। নির্বাচন কমিশন সূত্রের মতে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে নতুন ব্যবস্থা কার্যকর হলে সব প্রার্থীর নাম ও চিহ্নের শেষে ভোটযন্ত্রে আরও একটি বোতাম যুক্ত হবে। তাতে লেখা থাকবে, ‘উপরের কোনও প্রার্থীকেই নয়’। ভোটার যদি কোনও প্রার্থীকেই যোগ্য বলে মনে না করেন, তা হলে ওই শেষের বোতামটি টিপে নিজের মত দিতে পারবেন।
শীর্ষ আদালতের এ দিনের রায়কে স্বাগত জানিয়েছে একাধিক সংগঠন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা এবং দুই প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনারও সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, অনেক ক্ষেত্রেই এমন লোককে প্রার্থী করা হচ্ছে, যাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে। এই রায় সেই সব অযোগ্যদের দাঁড় করানোর বিরুদ্ধে বড় প্রতিবাদ হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক শোভনলাল দত্তগুপ্তের কথায়, “যে ভাবে ভোট হচ্ছে আর যাঁরা প্রার্থী হচ্ছেন, সেখানে মানুষের ‘প্রোটেস্ট ভোট’-এর একটা জায়গা থাকা দরকার।” তবে একই সঙ্গে তাঁদের বক্তব্য, রাজনৈতিক দলগুলি গ্রামাঞ্চলে যে রকম সংগঠিত ভাবে ভোট করায়, সেখানে এর প্রভাব নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
অন্য দিকে মুখে স্বাগত জানিয়েও রীতিমতো সংশয়ে রাজনৈতিক দলগুলি। বিশেষত, পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আগে এমন রায় নিয়ে চিন্তায় প্রায় সব দলই। তবে যে হেতু রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনা, অর্থ ও পেশীবল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই রায় দেওয়া হয়েছে, তাই প্রকাশ্যে কোনও দলের পক্ষেই এর বিরোধিতা করা কঠিন। তাই বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদী থেকে বসপা-র মায়াবতী সকলেই এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদী একটি দীর্ঘ ব্লগ লিখে এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। অরবিন্দ কেজরিওয়ালরাও এই রায়ে উৎসাহিত। অন্য দিকে প্রাক্তন সাংসদ তথা পিডিএসের রাজ্য সভাপতি সৈফুদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, “আমরা ২০১১ সালের নভেম্বর মাসেই মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের কাছে দাবি করেছিলাম, ভোটদাতাদের কোনও প্রার্থীকেই উপযুক্ত মনে না হলে ভোট না দেওয়ার অধিকারের স্বীকৃতি দিতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এই অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।”
সিপিএমের বক্তব্য অবশ্য কিছুটা ভিন্ন। ‘না ভোটের’ কথা মাথায় রেখে প্রার্থী নিবাচনে রাজনৈতিক দলগুলি আরও সতর্ক হবে, এই পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়েছে তারা। সেই সঙ্গে নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের পক্ষে ফের সওয়াল করে সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, “দেশের আইন অনুযায়ী নির্বাচনের যে নিয়ম, তাতে যিনি সর্বাধিক ভোট পাবেন, তিনিই নির্বাচিত হবেন। প্রত্যাখ্যান ভোটের সংখ্যা বেশি হলেও ইতিবাচক ভোটের মধ্যে বেশি পাওয়া ব্যক্তি জিততে পারবেন। ফলে, বাস্তবে বিরাট কোনও প্রভাব পড়বে না।” লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় আবার সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়েই প্রশ্ন তুলে জানিয়েছেন, আইন করার দায়িত্ব সংসদের হাতেই আছে।
সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের পরে নির্বাচন কমিশন তা রূপায়ণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেও অনেক বিষয়ে এখনও ধোঁয়াশা রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলির বক্তব্য, নতুন ব্যবস্থায় জানা যাবে, কত জন ভোটার সব প্রার্থী খারিজের পক্ষপাতী। কিন্তু তাতে কি বড় কোনও বদল হবে? প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এন গোপালস্বামীর কথাতেও সেই সুর। তাঁর যুক্তি, “কোনও কেন্দ্রে একশো জন ভোট দিলেন। তার মধ্যে ৯৯ জন কোনও প্রার্থীকেই পছন্দ না করার রায় দিলেন। কিন্তু একজন ভোটার কোনও একজন প্রার্থীকে ভোট দিলেন। বর্তমান নিয়মে সেই প্রার্থীই তো জিতে যাবেন!”
অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা এই ত্রুটি পূরণের দাবি তুলেছেন। তাঁদের মতে, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় স্বচ্ছতার পথে প্রথম পদক্ষেপ। এ বারে সব দলের উচিত, আইন সংশোধন করে এটা স্পষ্ট করা যে, যদি সিংহভাগ মানুষ সব প্রার্থীকে খারিজ করে দেন, তা হলে সেই কেন্দ্রে নতুন করে ভোট হবে। যদি সব প্রার্থী বদল করে ফের নতুন করে ভোট হয়, সে ক্ষেত্রেও ভোটারদের মানসিকতার পরিবর্তন না হলে? কংগ্রেসের রশিদ আলভির শঙ্কা, “নির্বাচনে জাতি, ধর্ম, আঞ্চলিক সমস্যার মতো বিষয়গুলিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ফলে কোনও এলাকার সমস্যার জন্য যে ভোটাররা এত দিন ভোট বয়কট করে এসেছেন, তাঁরা লাগাতার একের পর এক নির্বাচনে যদি সব প্রার্থীকে প্রত্যাখ্যান করেন, তা হলে তো নৈরাজ্য তৈরি হবে!” বিজেপির মুখপাত্র মীনাক্ষী লেখি ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, মাওবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সামিল হওয়ার বিরোধী। এ ধরনের রায় সেই মনোভাবকেই আরও উস্কে দিতে পারে। তা ছাড়া জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার ক্ষেত্রে দেখা হয়, মোট ভোট কত পরেছে। এ বারে কি হবে? সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তা স্পষ্ট নয়।

অপছন্দের ভোট
সুপ্রিম কোর্ট কী বলেছে
ইভিএম বা ব্যালটে ‘উপরের কোনও প্রার্থীকেই নয়’ বলে বোতাম বা চিহ্ন থাকবে
সব প্রার্থীকেই খারিজ করাও মৌলিক অধিকার
এই ভোট গোপন থাকবে। প্রার্থীর প্রতি ভোটারের অসন্তোষ নথিভুক্ত থাকবে
‘না-ভোট’ নিয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে নির্বাচন কমিশনকে

উত্তর মেলেনি
প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের থেকে খারিজ ভোটের হার বেশি হলে কী হবে
আইন সংশোধন না হলে খারিজ ভোট কোনও প্রার্থীর জয় আটকাতে পারে না
আইন সংশোধনের জন্য সব দলকে রাজি করিয়ে সংসদে পদক্ষেপ করতে হবে
খারিজ ভোটের ভিত্তিতে যদি নির্বাচন বাতিল হয়, তখন ফের ভোট হলেও কি পরিস্থিতি বদলাবে
ভোটারদের মানসিকতার পরিবর্তন না হলে এক কেন্দ্রে কত বার ভোট করা যাবে
যে ভোটাররা ভোটই দেন না, তাঁরা কি এই অধিকার প্রয়োগ করতে বুথে যাবেন
খারিজ ভোটের হার সিংহভাগ হলে জামানত জব্দের মাপকাঠি কী হবে
কাউকেই ভোট না দেওয়ার বোতাম/চিহ্ন ভোটারদের বিভ্রান্ত করবে না তো

নজির
গ্রিস, আমেরিকার নেভাদা, ইউক্রেন-সহ ১৩টি দেশে চালু আছে ‘না-ভোট’
২০০৮ সালে বাংলাদেশে চালু ‘না-ভোট’। সামান্য সাড়া। পরে ‘না-ভোট’ বাতিল
২০১৩ সালে পাকিস্তানে ব্যালটে ‘না-ভোট’ চিহ্ন থাকলেও পরে নির্বাচন কমিশন তা বাতিল করে


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.