|
|
|
|
অর্ডিন্যান্স ছিঁড়ে ফেলার ডাক রাহুলের
জয়ন্ত ঘোষাল • ওয়াশিংটন
শঙ্খদীপ দাস • নয়াদিল্লি |
পাঁচ মিনিটের একটা ঝড়। আর তাতেই ছন্নছাড়া হয়ে গেল কংগ্রেস এবং সরকারের অন্দরমহল। প্রশ্ন উঠে গেল প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের ভবিষ্যৎ নিয়েও।
সাজাপ্রাপ্ত সাংসদ-বিধায়কদের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের হাত থেকে বাঁচাতে কেন্দ্রীয় সরকারের জারি করা অর্ডিন্যান্স ঘিরে বিতর্ক চলছিলই। গত কালই রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে এই অর্ডিন্যান্সে সই না-করার আর্জি জানিয়ে এসেছেন বিজেপি নেতারা। রাষ্ট্রপতি নিজেও তিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে ডেকে পাঠিয়ে অর্ডিন্যান্সের ব্যাখ্যা চেয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে আজ দিল্লি প্রেস ক্লাবে কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র অজয় মাকেনের সাংবাদিক সম্মেলনে আচমকা হাজির হয়ে দলের সহ সভাপতি রাহুল গাঁধী বলে দিলেন, “আমার মতে, সরকার যে অর্ডিন্যান্স এনেছে, সেটা একেবারে ফালতু (ননসেন্স)। ওটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ছুড়ে ফেলে দেওয়া উচিত।”
রাহুল বললেন বটে এটা তাঁর ব্যক্তিগত মত, কিন্তু তাঁর এই মন্তব্য যে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিল, সে ব্যাপারে অনেকেই এক মত। ঘটনাচক্রে এমন একটা দিনে রাহুল এই বোমা ফাটালেন, যখন মনমোহন বিদেশে এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে তাঁর বৈঠক করার কথা। বিদেশ সফররত প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেল বলে মনে করছেন শাসক ও বিরোধী দলের বহু নেতা। ফলে তাঁর ইস্তফার দাবিও উঠতে শুরু করেছে। যদিও তাঁর মন্তব্য নিয়ে ঝড় ওঠার পরে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়ে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি গভীর আস্থার কথা জানিয়েছেন রাহুল, বিতর্ক কিন্তু থামছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রের এক মন্ত্রী বলেন, “প্রধানমন্ত্রী কী করবেন জানি না, কিন্তু আমি হলে এই মুহূর্তে ইস্তফা দিয়ে দিতাম।” বিজেপি-র দাবি, প্রধানমন্ত্রীর বিন্দুমাত্র আত্মসম্মানবোধ থাকলে তাঁর ইস্তফা দেওয়া উচিত। আর মনমোহনের প্রাক্তন মিডিয়া উপদেষ্টা সঞ্জয় বাড়ুর মন্তব্য, “প্রধানমন্ত্রীর উচিত প্রথম বিমানটি ধরে পত্রপাঠ দেশে ফিরে আসা।” |
|
সাংবাদিক বৈঠকে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে সরব
কংগ্রেস সহ সভাপতি রাহুল গাঁধী। শুক্রবার। ছবি: এপি। |
এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর তরফে বিবৃতি প্রকাশ করে বলা হয়েছে, “কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা যে অর্ডিন্যান্স জারি করেছে, তাকে ঘিরে জনমানসে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কংগ্রেস সহ সভাপতিও এ ব্যাপারে আমাকে চিঠি লিখেছেন এবং বিবৃতি দিয়েছেন। সরকার গোটা পরিস্থিতির দিকেই নজর রাখছে। আমি দেশে ফেরার পরে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।” কিন্তু এই সাবধানী মন্তব্যের বাইরে মনমোহন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ বলেই তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি। তাঁর ক্ষোভের কারণ মূলত দু’টি। প্রথমত, বিদেশ সফরে থাকার সময়, ওবামার সঙ্গে বৈঠকের দিনে কেন এমন মন্তব্য করা হল! এর ফলে তো মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর বৈঠকটাই কার্যত মূল্যহীন হয়ে গেল। দ্বিতীয়ত, কেন অর্ডিন্যান্সের দায় তাঁর একার ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে? প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল দাবি করছে, ২১ তারিখ কংগ্রেস কোর গ্রুপের বৈঠকে অর্ডিন্যান্স জারির সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই বৈঠকে হাজির ছিলেন খোদ সনিয়া গাঁধী। মনমোহন নিজে কাছের লোকেদের এ-ও বলেছেন যে, সর্বদল বৈঠকে বিজেপি অর্ডিন্যান্সের বিরোধিতা করেছিল। কংগ্রেস করেনি। তা হলে তাঁকে দায়ী করা হচ্ছে কেন?
গোটা বিষয়টি নিয়ে আজ ফোনে সনিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন মনমোহন। কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, সনিয়া প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, আপনি ভুল বুঝবেন না। আমরা সকলেই আপনার সঙ্গে আছি। তবে একই সঙ্গে এই অর্ডিন্যান্সের আর কোনও ভবিষ্যৎ রইল না বলেই কংগ্রেস সূত্রের দাবি। মনমোহন দেশে ফেরার পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকে এটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। প্রসঙ্গত, আজও এই অর্ডিন্যান্সে সই করেননি রাষ্ট্রপতি। গত কাল তিন মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার পরে আজ অ্যাটর্নি জেনারেল এবং লোকসভার এক প্রাক্তন মহাসচিবের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। রাষ্ট্রপতি ভবন সূত্রে বলা হচ্ছে, অর্ডিন্যান্স নিয়ে রাষ্ট্রপতির কিছু সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন আছে। প্রধানমন্ত্রী দেশে না-থাকায় তিন মন্ত্রীকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে কথা বলেও সন্তুষ্ট হননি বলেই আইনি পরামর্শ নিচ্ছেন।
কিন্তু তার আগে রাহুলের মন্তব্যে দলের ভাল হল না মন্দ, তা নিয়ে কংগ্রেস নেতারা দ্বিধাবিভক্ত। কেউ কেউ বলছেন, রাহুলই কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ। ফলে নৈতিক প্রশ্নে তিনি যে আপসহীন অবস্থান নিলেন, তাতে আগামী লোকসভা ভোটে আখেরে দলের ভালই হবে। রাহুল আজ বলেছেন, “আমি জানি আমার দল বা সরকারের নেতারা রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে এই অর্ডিন্যান্স জারি করেছেন। কিন্তু আমরা যদি দুর্নীতির সঙ্গে লড়াই করতে চাই, তা হলে এই সব ছোটখাটো আপস করা আমাদের বন্ধ করতে হবে।” এই নেতাদের মতে, গোটা দেশে যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হচ্ছে, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যখন মূল অভিযোগই হল দুর্নীতিকে মদত দেওয়ার, তখন রাহুলের মন্তব্য দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সাহায্য করবে। তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করবে। তা ছাড়া, রাষ্ট্রপতিকে অর্ডিন্যান্সে সই না-করার অনুরোধ জানিয়ে বিজেপি যে রাজনৈতিক ফায়দা লুঠতে চাইছিল, তার পথও বন্ধ করে দিলেন তিনি। ফলে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের সুবিধা হবে। ওই সব রাজ্যের কংগ্রেস কর্মীরা রাহুলের মন্তব্যে উল্লসিত।
কিন্তু এই মতের বিরোধী নেতাদের বক্তব্য, নিজের দলের সরকারকে ছোট করে রাহুলের পক্ষে কি বড় হওয়া সম্ভব? অর্ডিন্যান্স নিয়ে তাঁর যখন এত আপত্তি, তখন সেটা তিনি দলের অন্দরে জানাননি কেন? দলের বর্ষীয়ান নেতারা অনেকেই একান্তে বলছেন, রাহুল আজ যে ভাষায়, যে ভঙ্গিতে নাটকীয় ভাবে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন, সেটা মোটেই শোভন নয়। তিনি কার্যত প্রধানমন্ত্রীকে অপমান করেছেন।
বস্তুত, কংগ্রেসের অনেকেরই মতে, আজই সম্ভবত মনমোহন যুগের অবসানের সূচনা করে দিলেন রাহুল। দলের মধ্যে গোড়া থেকেই যাঁরা এই অর্ডিন্যান্সের বিরোধিতা করে আসছিলেন, সেই জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, সন্দীপ দীক্ষিত, মিলিন্দ দেওরারা নবীন প্রজন্মের নেতা এবং রাহুল-ঘনিষ্ঠ। রাহুল আজ বুঝিয়ে দিলেন, কংগ্রেসে পুরোদস্তুর তাঁর যুগ শুরু হওয়ার পথে।
তবে দশ জনপথের ঘনিষ্ঠ কোনও কোনও কংগ্রেস নেতা আবার দাবি করছেন, রাহুল মোটেই প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেননি। এর সমর্থনে এ দিনই সাংবাদিক বৈঠকের পরে রাহুল প্রধানমন্ত্রীকে যে চিঠি লিখেছেন, সেটি তুলে ধরছে কংগ্রেস। রাহুল লিখেছেন, “আমি জানি, আমার মত মন্ত্রিসভা এবং কোর গ্রুপের সিদ্ধান্তের বিরোধী। এ-ও জানি যে সেটা নিয়ে বিরোধীরা শোরগোল তুলবে। কিন্তু আপনি জানেন যে, আপনার প্রতি আমার অসীম শ্রদ্ধা। এবং আপনার প্রজ্ঞার দিকেই আমি আশা নিয়ে তাকিয়ে আছি।”
ওই কংগ্রেস নেতা এ-ও বলছেন যে, অর্ডিন্যান্স জারির প্রক্রিয়ার সঙ্গে তো সনিয়াও যুক্ত। ফলে বলা যেতে পারে নিজের মায়ের মতকে প্রকাশ্যে খণ্ডন করলেন রাহুল। ওই নেতার বক্তব্য, সম্প্রতি সনিয়ার সঙ্গে দেখা করে অর্ডিন্যান্স আনার জন্য রীতিমতো অনুনয়-বিনয় জুড়ে দেন লালুপ্রসাদ যাদব। তিনি বলেন, ৩০ সেপ্টেম্বর পশুখাদ্য মামলার রায় বেরোবে। তাতে দোষী সাব্যস্ত হলে লোকসভার সদস্যপদ খোয়াতে হবে তাঁকে। সনিয়াকে লালু এ-ও বলেন যে, বিহারে নরেন্দ্র মোদীকে রোখার মতো কংগ্রেসে কেউ নেই। সেখানে তিনি একাই মোদীকে রুখে দেবেন। এর পরেই সনিয়া অর্ডিন্যান্সে মত দেন বলে ওই কংগ্রেস নেতার দাবি।
কিন্তু আপত্তি করেন রাহুল। তাঁকে বোঝানো হয়, এটা শুধু যে কংগ্রেস চাইছে তা নয়, সব দলই এই অর্ডিন্যান্সের পক্ষে। বিজেপি কিন্তু অর্ডিন্যান্সের বিরোধিতায় সরব হয়। ফলে রাজনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ে কংগ্রেস। যে ক্ষতি সামাল দিতে রাহুল আজ মুখ খুলেছেন বলে কংগ্রেস নেতাদের একাংশের দাবি।
এখন প্রশ্ন হল, অজয় মাকেনের সাংবাদিক বৈঠকে রাহুলের চলে আসাটা কি পূর্বপরিকল্পিত? কেউ বলছেন হ্যাঁ, কেউ বলছেন না। মাকেন অবশ্য রাহুল আসার আগে অর্ডিন্যান্সের পক্ষেই কথা বলছিলেন। এমন সময় তাঁর আপ্ত সহায়ক এসে বলেন, “স্যর আপনার জরুরি ফোন আছে।” ফোন ধরে ফিরে এসে মাকেন সাংবাদিকদের বলেন, “ভাল খবর আছে। রাহুল গাঁধী আসছেন।”
রাহুল এলেন। পাঁচ মিনিট রইলেন। ঝড় তুলে দিয়ে গেলেন ঘরে-বাইরে।
|
|
|
|
কংগ্রেস সহ সভাপতি আমাকে
চিঠি লিখেছেন, বিবৃতিও দিয়েছেন।
আমি দেশে ফেরার পরে মন্ত্রিসভার
বৈঠকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।
মনমোহন সিংহ
প্রধানমন্ত্রী |
আমরা প্রথম দিন থেকেই ওই
অর্ডিন্যান্সের বিরোধিতা করে
আসছিলাম। ভালই হল, আমাদের
মতের সমর্থক জুটল!
সীতারাম ইয়েচুরি
সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য |
এটা কি একটা সরকার
না নাট্যদল?
নাটক করে
সরকারের
ব্যর্থতা ঢাকতে
পারবে না কংগ্রেস।
অরুণ জেটলি
রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা |
|
|
|
রাহুল গাঁধী
আজ যা
বলেছেন,
তা সঠিক।
অজয় মাকেন
কংগ্রেস সাংসদ |
দল এবং সরকারের মধ্যে যে
কোনও সমন্বয় নেই, রাহুল
গাঁধীর মন্তব্যে তা স্পষ্ট।
নীতীশ কুমার
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী |
কংগ্রেসের
অন্দরমহলের
বিভ্রান্তি আরও স্পষ্ট হল।
সৌগত রায়
তৃণমূল সাংসদ |
|
পুরনো খবর: দাগি-রক্ষায় অর্ডিন্যান্স কেন, ব্যাখ্যা চান প্রণব |
|
|
|
|
|