বড় শক্তির তরফে চাপ নয়, বরং পরস্পরের প্রতি মর্যাদার মনোভাব নিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার বার্তা এল হোয়াইট হাউস থেকে।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জানিয়ে দিলেন, আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসের মোকাবিলা থেকে শুরু করে পশ্চিম এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, এমনকী বিশ্বের তেল বাজারকে আরও স্বচ্ছ করে তোলার মতো বিষয়েও ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ শরিক হিসেবেই দেখছে আমেরিকা।
পাকিস্তান যে বিশ্বে সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর, বৈঠকে সেই প্রসঙ্গ তোলেন মনমোহন। বলেন, জম্মুতে সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার কথাও। বৈঠকে ও তার পরে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনেও ওবামা জম্মুতে হতাহতদের জন্য শোকপ্রকাশ করেন। ওই হামলার নিন্দা করার পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন, সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় ভারতকে সব রকম সাহায্য করতে প্রস্তুত আমেরিকা।
এরই পাশাপাশি, বিদেশনীতির প্রশ্নে পোড় খাওয়া কুশলী নেতা মনমোহনের প্রশংসা করে বিশ্বের সব চেয়ে শক্তিধর দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান ভারতের সাহায্যও চেয়েছেন সিরিয়া, ইরান তথা পশ্চিম এশিয়ার সমস্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রে। উল্লেখ করেছেন আফগানিস্তান-সহ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা। আলোচনা হয় পেট্রোপণ্যের দাম অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে চলায় বিশ্ব অর্থনীতির বিপদ নিয়েও। বিশ্বের তেল বাজারকে আরও স্বচ্ছ করে তোলা ও জরুরি পরিস্থিতিতে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় রেখে চলার উপরে জোর দেন মনমোহন-ওবামা, দু’জনেই।
এ যেন ‘আমরা-ওরা’-র রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার বার্তা। সে অর্থে মনমোহন তাঁর বর্তমান মেয়াদের শেষ মার্কিন সফরে এ দিন এক ঐতিহ্যই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলেন। বিভিন্ন বিষয়ে মনান্তরকে দূরে সরিয়ে ভারত-মার্কিন সম্পর্কের একটি দিশাও তৈরি করলেন তিনি।
শীর্ষ বৈঠকের শেষে বিদেশ মন্ত্রকের কর্তাদের বক্তব্য, গোটা দুনিয়া আজ এমন সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে যে সংঘাতের আবহকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তাটাই বড় হয়ে উঠছে। আর তারই প্রতিফলন দেখা গেল মনমোহন-ওবামা বৈঠকে এবং তার পরে সাংবাদিকদের সামনে তাঁদের যৌথ উপস্থিতিতেও। বাধা গতের লিখিত বিবৃতি নয়, বরং মিনিট দশেক করে দু’জনেই বললেন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। তাতে হিসেব-নিকেশ মেটানোর চেয়েও প্রধান হয়ে উঠল সহযোগিতার বিষয়টিই। পরে যৌথ বিবৃতিতেও সব চেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে বাস্তবতার ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য-সহ দু’দেশের সহযোগিতা বাড়ানোর প্রসঙ্গ। |
একান্ত আলাপচারিতায় মনমোহন সিংহ ও বারাক ওবামা। |
প্রশ্ন ছিল, হোয়াইট হাউসে ওভাল অফিসের পশ্চিম উইং-এ আজকের এই বৈঠককে ঠিক কোন কূটনৈতিক নামে ডাকা যাবে? এটি কি ওবামার ভারত সফরের পাল্টা মনমোহনের ব্যক্তিগত সফর, না প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় সফর? আজ হোয়াইট হাউসের ক্যাবিনেট রুমে যে মধ্যাহ্নভোজনে মনমোহনকে আপ্যায়িত করলেন ওবামা, সেটি কি ওয়ার্কিং লাঞ্চ? এই নিয়ে কূটতর্ক চলছে। এবং চলবেও। কিন্তু দিনের শেষে একটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত, ভারত-মার্কিন বন্ধুত্বের এবং পারস্পরিক নির্ভরশীলতার একটি নতুন মাইলফলক তৈরি হল এ দিন।
ওবামার সঙ্গে এটি মনমোহনের তৃতীয় বৈঠক। প্রায় তিন বছর পর। ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মনমোহনই ছিলেন তাঁর দেশের প্রথম রাষ্ট্রীয় অতিথি। দ্বিতীয় বৈঠকটি হয় ওবামা ভারত সফরে এলে। আজকের বৈঠকটির পর এ কথা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে মার্কিন মুলুকে সাবেকি দাদাগিরির যে ঘরানা, তাতে একটি নতুন বাঁক এসেছে। ইরানে নতুন প্রেসিডেন্ট আসার পর সে দেশের সঙ্গেও মার্কিন সম্পর্কে যে বদল আসতে চলেছে তা এ বার এখানে এসে চাক্ষুষ করছি। ইরান ও সিরিয়া নিয়ে মার্কিন অবস্থানেও দেখছি পরিবর্তনের ঝোঁক। সিরিয়াকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে রাশিয়ার মধ্যস্থতায়। এখানকার কূটনীতিকরা তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে একটি কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যাকে হারিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন, তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের অন্যতম সেনাপতি। ‘ওবামিয়ান’-দের বক্তব্য, মার্কিন মুলুকে এখন ভিয়েতনামে আগ্রাসনের সেই যুগ শেষ। সাবেকি যুদ্ধবাজ নীতি থেকে সরে এসে পশ্চিম এশিয়ায় শান্তির বাতাবরণ তৈরি করতে এখন অনেক বেশি আগ্রহী ওবামা
প্রশাসন। আর তাতেই ভারত অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আমেরিকার কাছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক কর্তার মতে, চরম অস্থিরতার সময়েও তেহরানের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে যাওয়ার সুফল পাচ্ছে এখন নয়াদিল্লি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও চাইছে, ইরানের সঙ্গে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গোটা অঞ্চলে একটা বড় দায়িত্ব নিক নয়াদিল্লি। আজকের বৈঠকে পরমাণু দায়বদ্ধতা বিল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মার্কিন নেতৃত্বকে জানিয়েছেন, বিলটি সংসদে পাশ হয়ে গিয়েছে। এখন এর শর্তগুলি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে কিছু সময় লাগবেই। ভারতের মতো বড় একটি দেশে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাও কম নয়। এই বিষয়টি বিবেচনার
মধ্যে রাখতে ওবামাকে অনুরোধ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
ওয়েস্ট লন-এ দাঁড়িয়ে হোয়াইট হাউসের এক প্রবীণ কূটনীতিক বললেন, “নির্বাচন সব দেশেই পর্যায়ক্রমে আসে আর সরকার বদলায়। কিন্তু নির্বাচনের আগে পর্যন্ত সরকার বহাল থাকে, লেমডাক সরকার বলে কিছু হয় না।” মনে পড়ে গেল, এই হোয়াইট হাউসের ভোজসভায় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন এবং অটলবিহারী বাজপেয়ীকে দেখেছিলাম আলোচনায় মগ্ন হতে। তখন ভোটের মোডে চলে গিয়েছিলেন ক্লিন্টন। কিন্তু তাঁর সঙ্গেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছিলেন বাজপেয়ী। আবার আজ যখন ওবামার সঙ্গে বৈঠক করলেন মনমোহন, তখন তাঁর দলও নির্বাচনের ‘মোড’-এ চলে গিয়েছে। তবে কূটনীতির বৈঠকে দু’টি দেশের মধ্যে যে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক তৈরি হয়, তার সঙ্গে দেশের সরকার বদলের সম্পর্ক নেই বলেই মনে করছেন কূটনৈতিক কর্তারা। আমেরিকায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত নিরুপমা রাওয়ের কথায়, “ভারত-মার্কিন সম্পর্কের একটা জীবন্ত রং আছে।” |
হোয়াইট হাউসে ঢোকার মুখে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। |
শীর্ষ বৈঠকের পর আজ বেশ ক’টি চুক্তি হয়েছে দু’দেশের মধ্যে। প্রতিরক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা, বিদ্যুৎ থেকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা গুরুত্ব পেয়েছে এই বিষয়গুলি। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের রক্ষণশীল মনোভাব আজ কাটিয়ে উঠতে চেয়েছেন মনমোহন। এ ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে বিস্তর। কংগ্রেসের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গী, দেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার পাশাপাশি রয়েছে পরমাণু ব্যবসায় রাশিয়া, ফ্রান্স ও আমেরিকার প্রতিযোগিতার কুফলও। সব মিলিয়ে ভারত-মার্কিন প্রতিরক্ষা সম্পর্কে কিছুটা মন্দা এসেছে। কিন্তু এর মধ্যেও আজ ভারতের ‘নিউক্লিয়ার পাওয়ার কর্পোরেশন’ এবং আমেরিকার ‘ওয়েস্টিংহাউস ইলেকট্রিক কোম্পানি’-র মধ্যে পরমাণু চুল্লি গঠনের বিষয়ে একটি প্রাথমিক চুক্তি সই হয়েছে। প্রকল্পটি গুজরাতে তৈরি করা হবে। ভোটের আগে এই পদক্ষেপটি করে মনমোহন একটি বার্তা দিতে চাইলেন যে, তাঁর সরকার গোটা দেশের জন্যই কাজ করতে আগ্রহী, সেখানে কোনও রাজ্যই অচ্ছুত নয়।
বৈঠকে জম্মুতে জঙ্গি হানা, আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস, ভারতের বিরুদ্ধে হাফিজ সইদের প্রকাশ্য যুদ্ধঘোষণা, লস্কর-ই-তইবার মতো বিষয়গুলি গুরুত্ব পেলেও মনমোহন শুধু ভারতের কথা বলেননি। গত ২৩ তারিখ ভারত, ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকা (ইবসা)-র যৌথ মঞ্চে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, তারও উল্লেখ করেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একটি মঞ্চ গড়ে তুলতে একমত হয়েছেন দুই নেতা।
শীর্ষ বৈঠক সেরে আজই ওয়াশিংটন থেকে নিউ ইয়র্ক ফিরে গেলেন মনমোহন। কিন্তু সঙ্গে নিয়ে গেলেন উষ্ণতা এবং সুসম্পর্কের এক কূটনৈতিক স্মৃতি। আজ মনমোহন যখন পশ্চিম উইং-এ ওবামার সঙ্গে বৈঠকে ব্যস্ত , তখন তাঁর স্ত্রী গুরশরণ কৌরকে নিজের বাসকক্ষে চায়ের আসরে আপ্যায়ন করেছেন মিশেল ওবামা।
সব দেখেশুনে মনে হতে বাধ্য, আন্তর্জাতিক মন্দার ধাক্কায় কূটনীতিতেও বদল এসেছে অনেকটা। যেখানে মতান্তরকে মনান্তরে টেনে নিয়ে যাওয়া নয়, বরং পারস্পরিক বাণিজ্যস্বার্থকে আরও বেশি করে আবিষ্কার করাই লক্ষ্য। পরস্পরের প্রতি মর্যাদাপূর্ণ আচরণে সেটিই করলেন দু’দেশের নেতৃত্ব। ওবামা বরং এক ধাপ এগিয়ে বিরল সৌজন্য দেখালেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে। হোয়াইট হাউস থেকে মনমোহনের ফিরে যাওয়ার সময় ওবামা নিজে তাঁকে এগিয়ে দিলেন পোর্টিকো পর্যন্ত। হোয়াইট হাউসের প্রোটোকলে যা সৌজন্যের বিরল দৃষ্টান্তগুলির মধ্যে বিরলতম। |