ওবামার মন জিততে মরিয়া মনমোহন
টা কি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের বিদায়ী সফর?
দিল্লি থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট আসার পথে জিজ্ঞাসা করা হল জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননকে। কেরলের পালাক্কাড জেলার সন্তান শিবশঙ্করের তিন পুরুষ কূটনীতিক। তা-ও প্রশ্নটা শুনে মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন। তার পর অস্বস্তি কাটিয়ে সহাস্যে বললেন, “এই সফরটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রীর থালা ভর্তি। তাতে নানা ধরনের খাদ্যসামগ্রী।”
আমেরিকা সফরের মূল উদ্দেশ্য রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভা হলেও মনমোহনের সব চেয়ে বড় প্রাপ্তি বারাক ওবামার সঙ্গে বৈঠক। রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিবেশনের সময় সাধারণত অন্য রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে দেখা করতে চান না মার্কিন প্রেসিডেন্ট। রাষ্ট্রপুঞ্জের সদস্য রাষ্ট্র শতাধিক। সবাই দেখা করতে চান। কত জনকে সময় দেবেন! গোড়ায় মনমোহনের সঙ্গেও মুখোমুখি বৈঠকের কোনও কর্মসূচি ছিল না ওবামার। কথা ছিল মনমোহন বৈঠক করবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত মূলত দিল্লির ঐকান্তিক আগ্রহেই ওবামা-মনমোহন ওয়ার্কিং লাঞ্চ এবং যুগ্ম সাংবাদিক বৈঠকে রাজি হয়েছে হোয়াইট হাউস। পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে সময় না দিয়ে ওবামা মনমোহনকে সময় দেওয়ায় পুলকিত ভারতীয় কূটনীতিকেরা।
প্রশ্ন হল, মনমোহনের আগ্রহ এবং ওবামার প্রাথমিক অনাগ্রহের কারণ কী?
বিদেশসচিব থেকে শুরু করে শীর্ষ কূটনীতিক সকলেই বলছেন, যত বড়ই নেতা হন না কেন, সবার বিদেশ নীতিই আদতে দেশের মানুষের কথা ভেবে। আর তাই বিদায়বেলায় সকলেই দেশের মাটিতে নিজের নীতির ছায়া রেখে যেতে চান। মেনন কবুল করুন আর না-ই করুন, ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের পরে মনমোহন ফের প্রধানমন্ত্রী হবেন, এমনটা ভাবছেন না দিল্লির কোনও রাজনীতিকই। যদি কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে তা-ও। ফলে চলে যাওয়ার মুখে নিজের ছায়া রেখে যেতে চাইছেন মনমোহন।
ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নামছেন প্রধানমন্ত্রী। ছবি: পিটিআই।
কিন্তু ১৯৯১ সালে আর্থিক সংস্কারের অগ্রদূত মনমোহন, বা ২০০৮ সালে বামেদের বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে পরমাণু চুক্তি করা মনমোহনের প্রতি আমেরিকার যে সদয় মনোভাব ছিল, দ্বিতীয় বারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের প্রতি সেটা আর নেই। কারণ সেই পরমাণু চুক্তি। ফ্রান্স বা রাশিয়ার সঙ্গে পরমাণু চুক্তির বাস্তবায়ন হলেও রাজনীতির লাল ফিতের ফাঁসে বন্দি হয়ে রয়েছে মার্কিন সংস্থাগুলি। প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি তো আবার আমেরিকার সঙ্গে কোনও প্রতিরক্ষা চুক্তি করতেই চান না। বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্তার মতে, নিজের রাজ্য কেরলে সংখ্যালঘু ভোট আর সিপিএমের ভয়েই আমেরিকার থেকে শত হস্ত দূরে থাকতে চান অ্যান্টনি। আর সনিয়া গাঁধী, রাহুল গাঁধী যতই আধুনিক হন না কেন, ভোট ব্যাঙ্কের টানে মার্কিন-বিরোধিতার সাবেক তাস খেলতে খুবই উৎসাহী।
ফলে পরমাণু দায়বদ্ধতা চুক্তি নিয়ে টানাপোড়েন এমন জায়গায় পৌঁছল যে, ওবামার বিরাগভাজন হয়ে ভারত ছাড়তে হল মার্কিন রাষ্ট্রদূত টিমোথি রোমারকে। রোমার ওবামাকে বলেছিলেন, দ্বিতীয় বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়ে মার্কিন সংস্থাগুলির সঙ্গে পরমাণু ব্যবসায় গতি আনবেন মনমোহন। কিন্তু সেটা যখন হল না, তখন স্বাভাবিক ভাবেই রোমারের কূটনৈতিক দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিল ওবামা প্রশাসনের মনে।
তবে শুধু পরমাণু প্রসঙ্গ নয়, ইরান, সিরিয়া সংক্রান্ত বিদেশ নীতি থেকে আর্থিক সংস্কার দ্বিতীয় ইনিংসে সব বিষয়েই মনমোহনকে নড়বড়ে বলে মনে করেছে আমেরিকা। মার্কিন কূটনীতিকদের মতে, এ দফায় প্রধানমন্ত্রী প্রতি মুহূর্তে কংগ্রেসের রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার সামনে নতজানু। আর সেই নীতিপঙ্গুত্বই বেদম চটিয়েছে হোয়াইট হাউসের কর্তাদের। তাই ওবামা যুগের কূটনৈতিক রণকৌশল, যাকে বলা হচ্ছে ‘রাইস-কেরি অ্যাপ্রোচ’, (মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুসান রাইস ও বিদেশসচিব জন কেরির যৌথ উদ্যোগে রচিত নীতি) তাতে খুব একটা ভারত প্রীতি নেই।
শেষ বেলায় এসে এই ক্ষত মেরামতির কাজে হাত দিয়েছেন মনমোহন। তার একটা কারণ যদি নিজের নীতির ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়, অন্য কারণ অবশ্যই নরেন্দ্র মোদীর উত্থান। মোদী যখন শক্তিশালী ভারত গঠনের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হতে চাইছেন, গোধরা-কলঙ্ক ভুলিয়ে জাতীয় নেতা হওয়ার চেষ্টা করছেন, আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের সেতু জোড়া লাগাতে চাইছেন তখন আমেরিকা গিয়ে মনমোহন বলতে চান, মোদীর হিন্দুত্ব নয়, কংগ্রেসের নেতৃত্বে এক শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনই ভারতের ভবিষ্যৎ।
এটা ঠিক যে কূটনীতি আর বিদেশ নীতিতে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এক বার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে বৈঠক করে ইন্দিরা গাঁধী এতটাই বিরক্ত হয়েছিলেন যে, হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে মার্কিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন ফরাসি ভাষায়। অথচ রোনাল্ড রেগনের সঙ্গে ইন্দিরার দারুণ সখ্য গড়ে উঠেছিল। জর্জ বুশ জুনিয়রের সঙ্গে মনমোহনের যে বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিল, ওবামার সঙ্গে সেটা হয়নি। কিন্তু দেশের অর্থনীতি এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে যে, আমেরিকাকে উপেক্ষা করার অবস্থায় নেই মনমোহন। ভারতের আজ বিদেশি লগ্নি দরকার। আর মার্কিন অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, তখন তারাই হতে পারে সব চেয়ে বড় বলভরসা। তাই মনমোহন আজ আমেরিকার পথে। তাই হোয়াইট হাউসের আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে আগামিকালই মার্কিন সংস্থা ওয়েস্টিংহাউসের সঙ্গে পরমাণু চুল্লি গড়ার ব্যাপারে চুক্তি করতে চলেছে নিউক্লিয়ার পাওয়ার কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেড।
অর্থনীতির পোড় খাওয়া প্রশাসক জানেন, কোন সুরে বাঁধতে হবে তাঁর একতারা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.