শহরে ফের ডেঙ্গির হানা।
কলকাতা পুরসভার হিসেব বলছে, বর্ষা নামার পরে গত দু’মাসে (জুলাই ও অগস্ট) শহরে ২০ জনের রক্তের নমুনায় ডেঙ্গির ভাইরাস মিলেছে। সরকারি হিসেবে এ বছর এখনও পর্যন্ত ডেঙ্গিতে কারও মৃত্যু হয়নি। তবে পুরসভা সূত্রের খবর, গত সপ্তাহে দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত এক যুবকের রক্তের নমুনায় ডেঙ্গির ভাইরাস পাওয়া গিয়েছিল। তবে ডেঙ্গির পাশাপাশি তাঁর হেপাটাইটিস-এ সংক্রমণও হয়েছিল। শরীরে অন্য রোগও ছিল।
বর্ষার মরসুমে শহরের যেখানে যেখানে ডেঙ্গি ছড়িয়েছে, সেই সব এলাকা ইতিমধ্যেই তাঁরা চিহ্নিত করেছেন বলে পুর-কর্তৃপক্ষের দাবি। পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, শহরের ১৫টি ওয়ার্ডে গত দু’মাসে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত রোগী মিলেছে। যে সব বাড়ির বাসিন্দার ডেঙ্গি হয়েছে, সেখানে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চলছে সচেনতার প্রচার। বিভিন্ন আবাসন, কর্মী-আবাসন এবং বস্তি এলাকায় ডেঙ্গি সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। কারণ, ডেঙ্গি বা ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী এক-একটি মশা পরপর একাধিক লোককে কামড়ায়। তাই সংক্রমণও দ্রুত ছড়ায়।
খুব সম্প্রতি ডেঙ্গি ছড়িয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মী-আবাসনে। গত কয়েক দিনে ওই আবাসনের তিন জন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন। এক জন সদ্য সুস্থ হয়ে উঠলেও দু’জন এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কী ভাবে ওই আবাসনে ডেঙ্গি ছড়াল, তা দেখতে মঙ্গলবার কলকাতা পুরসভার একটি দল পরিদর্শনে যায়। নেতৃত্বে ছিলেন মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ।
অতীনবাবু জানান, ওই আবাসনে জঙ্গলের মধ্যে ছোট ছোট জায়গায় জল জমে রয়েছে। যা এডিস মশার বংশ বিস্তারের পক্ষে আদর্শ। ওই জঙ্গল কেটে পুরো এলাকায় গর্ত বোজাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষকে। মেয়র পারিষদ বলেন, “আক্রান্তদের মধ্যে এক জন উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা। সম্ভবত সেখান থেকেই তিনি জীবাণু নিয়ে এসেছেন।” কারণ, শিলিগুড়ি এবং অন্ডালে ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গি। তবে বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসকেরা জানান, কোথাও ডেঙ্গি আক্রান্ত মানুষ এবং এডিস ইজিপ্টাই মশা থাকলে ডেঙ্গি ছড়াতে পারে। আর সেই এলাকায় যদি পরিষ্কার জল জমে থাকে, সেখানে ডেঙ্গির জীবাণুবাহী মশা বংশ বিস্তার করতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, দ্বাররক্ষী অনিত ছেত্রীর স্ত্রী সুমিত্রা বেশ কিছু দিন ধরে জ্বরে ভুগছিলেন। গত বুধবার জ্বর বাড়ে। শনিবার তাঁকে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অনিতবাবুর কথায়, “জ্বর কমে গেলেও ওর শরীর খুব দুর্বল ছিল। আমার ঘরে ছোট বাচ্চা। তাই ঝুঁকি না নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেছি। চিকিৎসকেরা বলেছেন সেখানে থাকতে হবে আপাতত।” অন্য এক কর্মীর নাতি বিশাল বালাও দিন দু’য়েক হল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। বিশালের দিদি পূজা, তাদের পাশের ঘরের বাসিন্দা অচিন্ত্য আড়ির মেয়ে লতিকা এবং ওই কোয়ার্টার্সেরই দোতলার বাসিন্দা নিমাই ঘড়াইয়ের স্ত্রী কনকদেবীর জ্বর। সঙ্গে গায়ে ব্যথা। তাঁদেরও রক্ত পরীক্ষা করাতে দেওয়া হয়েছে।
চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের ওই আবাসনের কর্মীরা রীতিমতো আতঙ্কিত। কনকদেবীর ছেলে বিশু ঘড়াই বলেন, “কতগুলি মুখ খোলা চৌবাচ্চা আছে ক্যাম্পাসে। সেখানে জল জমে মশা জন্মাচ্ছে।” লতিকার ভাই তাপসেরও অভিযোগ, ক্যাম্পাস এলাকা ঠিকমতো পরিষ্কার করা হয় না বলেই সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, এ দিন পুরসভার পরিদর্শক দল জানিয়েছে, ওই ওয়ার্ডে সব থেকে বেশি সংক্রমণ হয়েছে যাদবপুরের কর্মী-আবাসনে।
এক বাসিন্দার কথায়, “পুরসভা বারবার জানিয়েছে ক্যাম্পাস পরিষ্কার রাখতে হবে। জল কোথাওই জমতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলদোল নেই। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার জেরেই এমন অবস্থা।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রদীপ ঘোষের অবশ্য দাবি, “প্রতি বছর বর্ষার সময়ে ক্যাম্পাস পরিষ্কার রাখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ বছরও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টির পরে পুরসভার পরিদর্শক দল গত সপ্তাহে জানিয়েছিল যে, তাতে মশার লার্ভা পাওয়া গিয়েছে। এটা জেনেই সাফাইয়ের ব্যবস্থা হয়।”
প্রদীপবাবুর দাবি, মঙ্গলবার পুরসভার দল জানিয়েছে, সাফাই অভিযানের সুফল মিলেছে। অনেকটাই উন্নতি হয়েছে পরিস্থিতির। ক্যাম্পাস সাফাই অভিযান চলবে বলে জানিয়েছেন রেজিস্ট্রার।
পুরসভার অবশ্য দাবি, গত বারের তুলনায় এ বার ডেঙ্গি সংক্রমণের হার অনেক কম। পুরসভার মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীনবাবু জানান, গত বছর জানুয়ারি থেকে অগস্ট পর্যন্ত এগারোশো জন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এ বার তা নেমে এসেছে ৪৫-এ। তিনি জানিয়েছেন, এ বার শহরের বেশ কয়েকটি এলাকায় বিচ্ছিন্ন ভাবে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলেছে। কিন্তু ওই রোগীদের থেকে রোগ অন্যত্র ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েনি। |
|
ডেঙ্গি কথা |
• রোগটা কী? |
ডেঙ্গি ভাইরাস বহনকারী কোনও এডিস প্রজাতির মশা কাউকে কামড়ালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ডেঙ্গি রোগ হয়।
এডিস মশা এই রোগ এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে ছড়ায়। |
• উপসর্গ কী? |
|
• জ্বর প্রথমে কম থাকে,
তার পরে হঠাৎ করে বেড়ে যায়
• মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা, চোখের পিছনে ও গাঁটে ব্যথা
• গায়ে লাল লাল দাগ, চোখ লাল হওয়া
• অনেক সময়ে পেটে অসহ্য যন্ত্রণা, বমি
• শরীর থেকে রক্তপাত শুরু হওয়া
• দেহে জলের পরিমাণ কমে যাওয়ায় দুর্বলতা |
• কী ভাবে চিকিৎসা হয়? |
|
চিকিৎসকের পরামর্শে প্যারাসিটামল খেতে হয়।
সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে
জল খেতে হয়। |
|
• মৃত্যুর আশঙ্কা কতটা? |
ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু না হলে হেমারেজিক ডেঙ্গি
(যেখানে শরীর থেকে রক্তপাত হয়) মৃত্যু ঘটাতে পারে। |
|
• রোগের প্রতিরোধ কোনও ভাবে সম্ভব কি? |
মশা নিয়ন্ত্রণই একমাত্র প্রতিরোধ। এই রোগের কোনও প্রতিষেধক এখনও বেরোয়নি। |
• কী ভাবে রোগ ধরা পড়ে? |
|
উপসর্গ মিললেই রক্ত পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া দরকার। এক বার রক্ত পরীক্ষায় জীবাণু ধরা না পড়লে দ্বিতীয় বার পরীক্ষা করানো উচিত |
• যেখানে মিলেছে ডেঙ্গি রোগী |
কাশীপুর (৪), চিৎপুর (৬), শ্যামবাজার (১৫), রাজাবাজার (৩৭), বড়বাজার (৪৪),
ধাপা (৫৮), ভবানীপুর (৭৪), গড়িয়াহাট (৮৫), যাদবপুর-ঢাকুরিয়া (৯২),
বিজয়গড় (৯৬), ম্যুর অ্যাভিনিউ (৯৭), সন্তোষপুর (১০৩), রাজডাঙা (১০৭),
বাঁশদ্রোণী (১১৩) এবং পুটিয়ারি (১১৫) (বন্ধনীতে ওয়ার্ড নম্বর) |
|