বেনজির সংক্রমণে বাড়ছে উদ্বেগ
রক্ত ঝরানোর নয়া অস্ত্রে আক্রমণ চালাচ্ছে ডেঙ্গি
রূপ বদলে আসা ডেঙ্গির গ্রাসে শহর-শহরতলি ইতিমধ্যে বেসামাল। রোজই নতুন করে বহু মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, রোগীর চাপে কলকাতা ও সল্টলেকে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোর নাভিশ্বাস উঠছে। বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসকদের অনেকে জানাচ্ছেন, নয়া চেহারার এই ডেঙ্গিতে অনুচক্রিকাই (প্লেটলেটস) শুধু কমছে না, লিভারে রক্ত জমাট বাধার সহায়ক প্রোটিনও অত্যধিক কমে যাচ্ছে। যা অনেক ক্ষেত্রেই শরীরের অভ্যন্তরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে বলে ওঁদের দাবি।
বেসরকারি হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্যভবনে তথ্য না-যাওয়ায় স্বাস্থ্য দফতরের ওয়েবসাইটে অবশ্য ডেঙ্গি-আক্রান্তের সংখ্যা ‘নিয়ন্ত্রিত।’ কলকাতার সরকারি হাসপাতাল চিত্তরঞ্জন সেবাসদনে এক বালকের মৃত্যু হলেও সরকার বা কলকাতা পুরসভা তা স্বীকার না-করায় কলকাতায় ডেঙ্গিতে মৃতের সংখ্যা ‘সরকারি ভাবে’ সেই তিনেই আটকে রয়েছে। কিন্তু অশনি সঙ্কেত দেখছেন চিকিৎসক-গবেষকেরা। রোগীদের শরীর থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন উপাদান পরীক্ষা করে তাঁদের অনেকে নিশ্চিত যে, এ বছরের হানাদার ডেঙ্গি নতুন অস্ত্রে বলীয়ান। কী রকম?
ডেঙ্গির অন্যতম প্রধান উপসর্গ শরীরের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ। যার কারণ হিসেবে মূলত প্লেটলেটের সংখ্যাহ্রাসকেই এ যাবৎ ডাক্তারেরা চিহ্নিত করে আসছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, অনুচক্রিকা কমে যাওয়ায় ডেঙ্গি-আক্রান্তের দেহে রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। কিন্তু এ বার কিছু রোগীর ক্ষেত্রে এই রক্তক্ষরণের পরিমাণ অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের সন্দেহ হয়েছিল, এর পিছনে অন্য কোনও কারণ নেই তো?
ডেঙ্গি নিয়ে কলকাতায় কংগ্রেসের বিক্ষোভ। রবিবার। —নিজস্ব চিত্র
পরীক্ষায় ধরা পড়ে, তাঁদের সন্দেহই ঠিক। দেখা যায়, ওই সব রোগীর খাদ্যনালীর ভিতরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে যাচ্ছে। শারীরিক উপাদান পরীক্ষা করে দেখা যায়, অনুচক্রিকার সঙ্গে সঙ্গে টান পড়ছে লিভারের ছ’টি প্রোটিনেও, যেগুলো রক্তকে জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। তার জেরেই বাড়তি রক্তক্ষরণের শিকার হচ্ছেন ওই রোগীরা।
এই কারণেই এ বারের ডেঙ্গি তাঁদের যথেষ্ট ‘শিক্ষা’ দিয়েছে বলে জানাচ্ছেন প্রবীণ পরজীবী বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী। স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ওই প্রাক্তন অধিকর্তার কথায়, “এ বার কলকাতা ও সল্টলেকে যে ধরনের ডেঙ্গি সংক্রমণ হয়েছে, তা আগে দেখিনি। জানতাম না যে, ডেঙ্গি লিভারের এতটা ক্ষতি করতে পারে! ক্ষেত্রবিশেষে খুব তাড়াতাড়ি হেপাটাইটিস হয়ে যাচ্ছে। লিভারে রক্ত জমাট বাঁধার সহায়ক প্রোটিনগুলো নষ্ট হচ্ছে।”
আর এ জন্যই বেশ কিছু এনএস-ওয়ান পজিটিভ রোগীর অবস্থা আচমকা ঘোরালো হয়ে পড়ছে বলে অমিতাভবাবুর দাবি। এনএস-ওয়ান পজিটিভকে রাজ্য সরকার বা পুরসভা আমল দিতে না-চাইলেও শহরের অধিকাংশ চিকিৎসক-বিশেষজ্ঞ সতর্ক। এনএস-ওয়ান পজিটিভ রোগীর অন্যান্য উপসর্গ বিচার করে শীঘ্র হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা। অমিতাভবাবুই এই মুহূর্তে কলকাতার চারটি বেসরকারি হাসপাতালে এমন আট জনের চিকিৎসা করছেন, যাঁদের লিভার প্রোটিন অত্যধিক কমে গিয়ে খাদ্যনালীতে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তিনি জানান, এনএস-ওয়ান পজিটিভ হওয়ার পরেই হঠাৎ ওঁদের পেটে রক্তক্ষরণ শুরু হয়।
পুরসভা ও স্বাস্থ্য দফতর ডেঙ্গি-পরিস্থিতির ‘গুরুত্ব ও জটিলতা’কে সে ভাবে আমল না-দেওয়ায় সঙ্কট বাড়ছে বলে চিকিৎসকদের একাংশের মত।
পাশাপাশি একই সঙ্গে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ এ বছর ডেঙ্গিকে স্বতন্ত্র মাত্রা দিয়েছে। অমিতাভবাবুর কাছে চিকিৎসাধীন এক জনের ডেঙ্গির সঙ্গে ভাইভাক্স ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ হয়েছে। আর এক জন ডেঙ্গির সঙ্গে ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত। ডেঙ্গির মতো ভাইভাক্স ম্যালেরিয়াও অনুচক্রিকা কমিয়ে দেয়। আবার ফ্যালসিপেরামের শারীরিক প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে ডেঙ্গির শারীরিক প্রতিক্রিয়ার নানা মিল। তাই দু’ক্ষেত্রেই বিশেষ নজরদারি জরুরি বলে অমিতাভবাবু মনে করছেন। ট্রপিক্যালের আর এক প্রাক্তন অধিকর্তা অমিয় হাটির কথায়, “সেকেন্ডারি ও ডেঙ্গি হেমারেজিক ফিভার হলে রোগীর লিভার বড় হয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে প্লাজমা লিকেজ হতে পারে। তাতে শরীর জলশূন্য হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা।”
লিভার-বিশেষজ্ঞ অভিজিৎ চৌধুরীও ডেঙ্গির রকম-সকম দেখে কিছুটা বিভ্রান্ত। তিনি বলেন, “কলকাতায় ডেঙ্গি সংক্রমণ হচ্ছে বেশ ক’বছর ধরে। কিন্তু ডেঙ্গি যে লিভারকে এ ভাবে অকেজো করে দিতে পারে, আগে জানা ছিল না!” তাঁর বিশ্লেষণ, “রক্ত জমাট বাঁধায় প্লেটলেটের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লিভার প্রোটিনের। ডেঙ্গির জন্য লিভার প্রোটিনের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তাতে শরীরের ভিতরে বাড়তি রক্তক্ষরণ হচ্ছে।”
শহরের আরও কিছু ডাক্তারের কাছে এ বারের ডেঙ্গির ভাবগতিক অন্য রকম ঠেকছে। এক সরকারি চিকিৎসক বলছেন, “এই ডেঙ্গি ভাইরাসের চরিত্র কিছুটা আলাদা। এত তাড়াতাড়ি শরীরের জল শুকিয়ে যাচ্ছে (ডিহাইড্রেশন) যে, চিকিৎসা শুরু করার সময়টুকু পাচ্ছি না! কারও কারও অন্ত্রে তৈরি হওয়া মল থেকেও জল টেনে নিচ্ছে শরীর। ফলে প্রচণ্ড কোষ্ঠকাঠিন্য। কারও জলের মতো পাতলা পায়খানা! কার যে কী হবে, আগাম বোঝার উপায় নেই!” কিছু রোগীর আলকাতরার মতো কালো পায়খানা হচ্ছে। ডেঙ্গির ক্ষেত্রে যা একেবারে নতুন উপসর্গ। পরে জানা যাচ্ছে, খাদ্যনালীর মধ্যে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেরই মলের এমন কালো রং।
এবং এ সবেরই পিছনে যে ডেঙ্গি-ভাইরাসের জিনগত পরিবর্তন, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞেরা মোটামুটি একমত। তাঁদের বক্তব্য: শরীর যত নিজের মতো রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদে তত মরিয়া হয়ে উঠবে রোগ-জীবাণু। জিন-চরিত্র বদলে তারা মানবশরীরে হামলা চালাবে। সেই টক্করেরই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হয়তো এ বারের ডেঙ্গি।

রোগ-সঙ্কেত
নতুন উপসর্গ
• খুব তাড়াতাড়ি শরীরে জলে টান
• কিছু বোঝার আগে পেটে রক্তক্ষরণ
• পিচের মতো পাতলা পায়খানা
• মেয়েদের ঋতুচক্রে হঠাৎ পরিবর্তন
• লিভারে গণ্ডগোল থেকে জটিলতা
• পেটে-বুকে জল জমা
হুঁশিয়ারি
• জ্বর হলেই রক্ত পরীক্ষা করান
• ফের জ্বর আসার অপেক্ষা নয়
• রক্ত পরীক্ষা সব সময়ে করা যায়
• এনএস-১ পজিটিভ হলে সাবধান
• বেশি করে ওআরএস খান
• ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ নয়



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.