সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসায় গাফিলতি সংক্রান্ত নালিশের শেষ নেই। সেগুলোর ফয়সালা নিয়ে গড়িমসির অভিযোগও অন্তহীন। যার সুরাহায় এ বার অভিযোগ নিষ্পত্তির পুরো প্রক্রিয়াটি ‘আউটসোর্স’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যে কারণে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর কলসেন্টার তৈরিতে প্রয়াসী হয়েছে।
চিকিৎসা-অবহেলার অভিযোগের নিষ্পত্তিতে পুজোর আগেই যাতে এই পরিষেবা শুরু করা যায়, সে জন্য জেলায়-জেলায় মুখ্য স্বাস্থ্য-অধিকর্তাদের কাছে নির্দেশ পৌঁছে গিয়েছে। এর বিজ্ঞাপনও প্রায় তৈরি, যার মূল প্রতিপাদ্য এখন আর কোথাও হত্যে দিতে হবে না, অপেক্ষা করতে হবে না, শুধু নিজের মোবাইল ফোন থেকে কলসেন্টারের টোল-ফ্রি নম্বরে ফোন করলেই হবে। তাতেই চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় অভিযোগের নিষ্পত্তি হাতে-নাতে মিলবে বলে সরকারের দাবি। সেই সঙ্গে কোন হাসপাতালে কী পরিষেবা পাওয়া যায়, কোথাও কত শয্যা খালি হচ্ছে, এ সব তথ্যও কলসেন্টার থেকে পাওয়া যাবে।
স্বাস্থ্য-কর্তারা জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য-পরিষেবার উন্নয়নের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ টাস্ক ফোর্সের ‘মস্তিষ্কপ্রসূত’ এই কলসেন্টার-প্রকল্পটিতে সিলমোহর দিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বাস্থ্য-কর্তাদের একাংশ বলছেন, রাজ্যে তৃণমূল জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরে মুখ্যমন্ত্রী চিকিৎসা গাফিলতি সংক্রান্ত অভিযোগগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তিতে জোর দিয়েছিলেন। অফিসারদের তিনি বলেছিলেন, কোনও অভিযোগ যেন এক মাসের বেশি পড়ে না-থাকে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
বরং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অভিযোগের ফাইল দিন দিন স্তূপীকৃত হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর অফিসে। এরই প্রেক্ষিতে সমস্যার সমাধানে কলসেন্টার গড়তে মুখ্যমন্ত্রী বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছেন বলে এই মহলের দাবি।
তাই প্রকল্পটি রূপায়িত করতে স্বাস্থ্য দফতর কার্যত কোমর বেঁধে নেমেছে। কিছু দিনের মধ্যে দরপত্র ডাকা হচ্ছে। কী ভাবে কাজ করবে কলসেন্টার?
স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা জানিয়েছেন, এখানে চব্বিশ ঘণ্টাই ফোন ধরার লোক থাকবে। থাকবে একাধিক কম্পিউটার। শুধু মোবাইল থেকে করা ফোনই ধরা হবে। ফোনে রোগী বা তাঁর পরিজন অভিযোগ জানালে সংশ্লিষ্ট সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিশেষ নম্বর তাঁদের জানিয়ে দেবেন অপারেটর। সেই সঙ্গে বলে দেওয়া হবে একটা নির্দিষ্ট সময় পরে কলসেন্টারে আবার ফোন করে অভিযোগ-পরবর্তী পরিস্থিতির ‘অগ্রগতি’ জেনে নিতে। তার পরে?
স্বাস্থ্য-সূত্রের খবর: অভিযোগ পাওয়ার পরেই অভিযুক্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা চিকিৎসককে কলসেন্টার থেকে ফোন করে পুরো বিষয়টি জানিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে উত্তর চাওয়া হবে। উত্তর এলে অভিযোগকারীকে তা জানিয়ে দেবে কলসেন্টার। শুধু তা-ই নয়, তিনি পরবর্তী পদক্ষেপ কী নেবেন বা নিতে পারেন, সে সম্পর্কে পরামর্শও দেওয়া হবে। এক স্বাস্থ্য-কর্তার কথায়, “রাত তিনটেয় কেউ অভিযোগ জানাতে ফোন করলেও কলসেন্টারকে সাড়া দিতে হবে। দ্রুত নিষ্পত্তিও করতে হবে। হাসপাতাল থেকে রোগী ফেরানো, ওষুধ না-দেওয়ার ঘটনা তো রাতেই বেশি ঘটে!”
এত সবের মধ্যে অবশ্য কিছু ‘কিন্তু’ও থেকে যাচ্ছে। কেন?
স্বাস্থ্য দফতরেরই একটি অংশের বক্তব্য: চিকিৎসা ব্যবস্থা চাঙ্গা করতে আগেও বেশ কিছু পরিকল্পনা হয়েছিল। অথচ কোনওটা কার্যকর হয়নি, কোনওটা ক’দিন চলার পরে মুখ থুবড়ে পড়েছে। যেমন, আউটডোর ঠিক সময়ে খোলা হল কি না, এসএমএস মারফত সেই তথ্য জানার প্রক্রিয়া চালু করেও লাভ হয়নি। প্রতি মেডিক্যাল কলেজ, জেলা, মহকুমা, স্টেট জেনারেল হাসপাতালে অভিযোগ জানানোর বাক্স রাখার পরিকল্পনা কার্যত খাতায়-কলমে রয়ে গিয়েছে। এইচআইভি সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য জানাতে এবং এইচআইভি-রোগীদের অভাব-অভিযোগ শুনতে তৈরি হওয়া ‘বুলাদি’ হেল্পলাইনের অবস্থাও তথৈবচ। অন্যায় ভাবে রোগী রেফার হলে তা ‘রেফারেল রেজিস্ট্রি’তে নথিভুক্ত করে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ৯৯% জায়গায় সেই রেজিস্ট্রি-ই চালু করা যায়নি। এমনকী, স্বাস্থ্য দফতরের ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট বিভাগে কোনও বেসরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামো সংক্রান্ত নালিশের ফাইল বছরের পর বছর পরে থাকে বলে অভিযোগ। “এই যখন পরিস্থিতি, তখন কলসেন্টার কত দিন চলবে?” সংশয় কিছু স্বাস্থ্য-কর্তারই। |