বিরোধিতা করে উচ্চ আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে এক পক্ষ। ভিন্ন মত পোষণ করে আর এক পক্ষ স্বাগত জানাচ্ছে রায়কে। রাজ্য সরকারের দেওয়া ইমাম ভাতাকে অসাংবিধানিক বলে সোমবার রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। রাজ্যের ইমাম সংগঠনগুলি স্পষ্টতই দ্বিধাবিভক্ত এই রায় নিয়ে। তবে দু’পক্ষই চান ভাতা চালু থাকুক।
তার জন্য ইমামদের একটি অংশ হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে। সরকার তাতে রাজি না হলে নিজেরাই উচ্চ আদালতে মামলা করার কথা ঘোষণা করেছে এই পক্ষ। আর আদালতের রায়কে যাঁরা স্বাগত জানিয়েছেন তাঁদের বক্তব্য, ওয়াকফ বোর্ডকেই তহবিল গড়ে শুধুমাত্র গরিব ইমামদের ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এই ইমামদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে ১১ দফা দাবিপত্রও পেশ করা হবে।
হাইকোর্ট রাজ্য সরকারের দেওয়া ইমাম ভাতাকে অসাংবিধানিক বলে তা বন্ধ করার নির্দেশ দিলেও সোমবারই মহাকরণ সূত্রে ইঙ্গিত দেওয়া হয়, রাজ্য সরকার ঘুরপথে ওই ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। সেটা হবে এই ভাবে: মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য সরকারি কোষাগার থেকে ওয়াকফ বোর্ডকে টাকা দেওয়ার জন্য নতুন করে বিজ্ঞপ্তি জারি করবে রাজ্য সরকার। সেখানে ইমাম ভাতা দেওয়ার প্রসঙ্গ বলা থাকবে না। কিন্তু ওয়াকফ বোর্ডকে ইমাম ভাতা দেওয়ার প্রক্রিয়া চালু রাখার নির্দেশ দেওয়া হবে। রাজ্যের শাসক দলের পক্ষ থেকেও ইমামদের আশ্বাস দিয়ে বলা হয়েছে, হাইকোর্টের রায়ে ইমাম ও মোয়াজ্জিমদের চিন্তার কোনও কারণ নেই। তাঁরা যে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছিলেন, আগামীতেও তা পাবেন।
হাইকোর্ট অবশ্য এটাও পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছে, ইমাম-মোয়াজ্জিমদের ভাতা দিতে হলে ওয়াকফ বোর্ডকে নিজস্ব তহবিল করে সেই কাজ করতে হবে। রাজ্য সরকারের থেকে টাকা নিয়ে ওয়াকফ বোর্ড মারফত এটা করা যাবে না। এই রায়ের জন্য সরকারি আইনজীবীদেরই দুষছেন ইমামদের বিভিন্ন সংগঠন। এমনই কয়েকটি সংগঠনের তরফে মহম্মদ কামরুজ্জামান মঙ্গলবার কলকাতায় এক সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, “রাজ্য সরকারের আইনজীবীদের ব্যর্থতার কারণেই হাইকোর্ট ইমাম ভাতাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। আসল তথ্য তুলে না ধরে সরকারি আইনজীবীরা আদালতে সরকারের গুণগান করেছেন।’’ এই সংগঠনগুলির দাবি, ইমামদের বেতন দেওয়ার প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯৩ সালে যে নির্দেশ দিয়েছিল, তার ভিত্তিতে সংসদে আইন পাশ করাতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। নেতারা জানান, এই দাবির সমর্থনে ইমামরা রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে জমায়েত করবেন।
কলকাতায় কয়েকটি সংগঠন হাইকোর্টের রায়ে সন্তুষ্ট না হলেও মুর্শিদাবাদের মক্তব ইমাম আ্যসোসিয়েশন শুনিয়েছে অন্য কথা। এ দিন মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ানে জামিয়া রহমানিয়া মসজিদ প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক সভায় জেলার নানা জায়গা থেকে সাড়ে পাঁচশো ইমাম যোগ দেন। সেখানেই আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়ে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়, রাজ্য সরকারের টাকায় কোনও ভাতা চান না ইমামরা। ১৯৯৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে সামনে রেখে ইমামদের যে ভাতা দেওয়া হচ্ছে, তা ওয়াকফ বোর্ডের টাকা কি না-- রাজ্য সরকারের তা স্পষ্ট করে বলা উচিত। মুর্শিদাবাদ জেলায় ৬৫% মানুষ মুসলিম। জেলায় মসজিদ রয়েছে কয়েক হাজার। সভার উদ্যোক্তাদের পক্ষে ইমাম সংগঠনের জেলা সম্পাদক মনিরুল ইসলাম দাবি করেন, “হাইকোর্টে স্পষ্ট ভাবে হলফনামা দিয়ে সরকার বলুক ইমামদের ভাতা দেওয়া হচ্ছে ওয়াকফ বোর্ড থেকে। হাইকোর্ট ইমাম ভাতা বন্ধের কথা বলেনি। বলেছে, ওয়াকফ বোর্ডের অর্থ থেকে সেই ভাতা দেওয়ার কথা। এই কারণেই হাইকোর্টের রায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন ইমামরা।”
হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানানোর কথা বললেও কামরুজ্জামানও দাবি করেন, “ওয়াকফ সম্পত্তির আয় থেকেই ইমাম ভাতা দেওয়া হোক, সরকারের টাকায় নয়।” তিনি মন্তব্য করেন, “ইমামরা গরিব হতে পারেন কিন্তু ভিক্ষা করতে বার হননি।” এই পক্ষের দাবি, রাজ্যে ওয়াকফের যে সব সম্পত্তি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার এবং অন্যরা ব্যবহার করে, তাদের কাছ থেকে বাজার দরে ভাড়া আদায় করলে ওয়াকফ বোর্ডের বছরে আয় হবে ৮০০ কোটি টাকার মতো। আর রাজ্যে ৩০ হাজার ইমামকে ভাতা দিতে বছরে খরচ হবে ৯৯ কোটি টাকা।
এ দিন সারা বাংলা ইমাম-মোয়াজ্জিম সমিতি, ইত্তেহাদুল আইমা ইমাম মোত্তাজিন কাউন্সিল, বঙ্গীয় ইমাম পরিষদ, জমিয়তে আইমা অল উলামা প্রমুখ সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, রাজ্যে বেদখল হয়ে যাওয়া ওয়াকফ সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য উদ্যোগী হোক সরকার। সংগঠনের নেতাদের অভিযোগ, পুলিশ ও প্রশাসনের সহায়তার অভাবে বহু ওয়াকফ সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। রাজ্য সরকারের সমালোচনা করে মুর্শিদাবাদের ইমাম সংগঠনের নেতা মনিরুল ইসলাম প্রশ্ন তুলেছেন, ইমামদের মধ্যে যাঁরা স্বচ্ছল, তাঁদের কেন ভাতা দেওয়া হবে? পঞ্চায়েত, বিডিও-র হাত ঘুরে কেন ইমামদের ভাতা নিতে হবে? ওয়াকফ বোর্ডই ঠিক করুক কারা ইমাম ভাতা পাওয়ার যোগ্য। তাঁর অভিযোগ, মুর্শিদাবাদে প্রায় চার হাজার ইমাম ভাতা পান। অথচ অতিদরিদ্র প্রায় ১৮০০ জন ইমাম ও মোয়াজ্জিমকে ভাতা দেওয়া হচ্ছে না।
|