রাজ্যপাল অনড়, চান না ছাত্রভোটে রাজনীতি
শিক্ষায়তনে রাজনীতির দাপাদাপি এবং শিক্ষক হেনস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এম কে নারায়ণনের দাওয়াই ছিল, অভিযুক্তদের ‘পিটিয়ে ঠান্ডা’ করা হোক। রাজ্যপালের সাংবিধানিক পদ থেকে এমন মন্তব্য পছন্দ করেননি মুখ্যমন্ত্রী। অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন মন্ত্রীদের অনেকেও। মঙ্গলবার দক্ষিণ কলকাতার একটি স্কুলের অনুষ্ঠানে নারায়ণন বুঝিয়ে দিলেন, তিনি নিজের অবস্থানে অনড়। এ দিন তাঁর মন্তব্য, “আমি যা বলার বলে দিয়েছি। বিতর্ক চললে চলুক।”
পুরনো বিতর্ক বজায় থাকাই শুধু নয়, রাজ্যপালের এ দিনের বক্তব্য নতুন বিতর্কও উস্কে দিয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘রাজনীতিমুক্ত’ ছাত্র সংসদ গড়ার পরামর্শ দিয়েছেন নারায়ণন। রাজনৈতিক দলগুলি প্রত্যেকেই তার বিরোধিতা করেছে। বিরোধিতা করেছে প্রশাসনও। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর মন্তব্য, “সাধারণ নির্বাচনেও সন্ত্রাস কিংবা হিংসা হয়। তা হলে কি রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনে লড়বে না?”
এ দিন নারায়ণন তাঁর বক্তব্যের শুরুতে নিজেই তাঁর আগের দিনের মন্তব্য এবং তার থেকে জন্ম নেওয়া বিতর্কের কথা তোলেন। শিক্ষক নিগ্রহ প্রসঙ্গে তাঁর সংযোজন, “আমাদের সময়ে নিয়ম মেনে চলাটা বাধ্যতামূলক ছিল। তা মানতে বাধ্য করতেন শিক্ষকেরা। তাঁদের হাতে মারও খেতাম। এখন তো শিক্ষকরা ছাত্রদের গায়ে হাত দিতে পারেন না।
অথচ পড়ুয়ারা শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলছে।”
লাগাতার শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনায় রাজ্যের শিক্ষাজগৎও উদ্বিগ্ন। কিন্তু রাজ্যপালের এই বক্তব্যের নিরিখে অনেকেরই প্রশ্ন, “শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলা মানা যায় না। কিন্তু তাই বলে ছাত্রদের উপরে দৈহিক শাস্তির রীতিকেও গ্রহণযোগ্য মনে করার কারণ নেই।” রাজ্যপাল অবশ্য মনে করেন, চারপাশের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মাত্র। সে কারণেই তিনি বলেন, “আমি যা বলার বলে দিয়েছি। বিতর্ক চললে চলুক।”
কিন্তু রাজ্যপালের সাংবিধানিক এক্তিয়ারে এ ধরনের মন্তব্যের স্থান রয়েছে কি না, সেটাই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের প্রশ্ন। তাঁদের একাংশের মতে, ভারতের রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপালের পদগুলি সংবিধান অনুযায়ী ব্রিটেনের রানির মতোই জাঁকজমকপূর্ণ সাক্ষীগোপাল ছাড়া কিছু নয়। অতীতে বামফ্রন্ট জমানায় গোপালকৃষ্ণ গাঁধী রাজ্যপাল থাকার সময় যখন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে মতামত জানাতেন, তখনও সেটা তাঁর সাংবিধানিক গণ্ডির বাইরে যাচ্ছে বলে প্রশ্ন উঠেছিল। নারায়ণনের ক্ষেত্রেও উঠছে।
তর্কবিতর্ক বাড়িয়ে দিয়ে এ দিন নারায়ণন সরাসরি ছাত্রভোট নিয়েও তাঁর মতামত দিয়েছেন। রাজ্যপাল বলেন, “আমি চাই রাজনীতিমুক্ত ছাত্র সংসদ। ছাত্র সংসদ নির্বাচনও হোক সে ভাবেই।” পুজোর পরেই রাজ্যের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রভোট করানোর সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর এই বক্তব্য আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু এ দিন জানান, রাজ্যের কলেজগুলিতে নির্বাচন পদ্ধতি কী হবে, তা পুজোর আগেই জানিয়ে দেওয়া হবে। তাঁর দাবি, “আমরা ছাত্র নির্বাচনকে হিংসামুক্ত করতে চাই।” কিন্তু রাজনীতিতে হিংসা হচ্ছে বলে সাধারণ নির্বাচন যেমন বন্ধ করা যায় না, ছাত্রভোটও নয়।
টিএমসিপি’র রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডা এ প্রসঙ্গে বলেন, “আমি রাজ্যপালের মন্তব্যের উপর কোনও কথা বলব না। তবে আমি মনে করি ‘অরাজনৈতিক’ বলে পৃথিবীতে কিছু হয় না।” এসএফআইয়ের রাজ্য সভাপতি মধুজা সেনরায়ের বক্তব্য, “ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থায় শিক্ষা-ব্যবস্থার মাপকাঠি এবং শিক্ষাখাতে টাকার অঙ্ক কী হবে, সবই ঠিক করেন রাজনৈতিক নেতারা। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার অধিকার রক্ষা স্বার্থে ছাত্রছাত্রীদের রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে।” ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদকর কৌস্তুভ বাগচিরও মত, “আদর্শগত ভাবে আমরা রাজ্যপালের মন্তব্যের সঙ্গে সহমত। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা কখনওই সম্ভব নয়। কারও রাজনীতি করার অধিকারে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না।”
চলতি বছরের গোড়ায় গার্ডেনরিচের কলেজে ভোট ঘিরে গোলমালের পরেই ছাত্রভোট স্থগিত করেছিল রাজ্য। কিন্তু এখন আবার ছাত্রভোট চালু করার সময় রাজ্যের তরফে বলা হচ্ছে, গোলমাল এড়াতে নয় পঞ্চায়েত ভোটের জন্যই ছাত্রভোট স্থগিত করা হয়েছিল। অথচ ইটাহার-সন্দেশখালি-হরিরামপুর-রানিগঞ্জের ঘটনা ক্রমাগতই দেখিয়ে দিচ্ছে, শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ কোথাও বদলায়নি। আমরা-ওরার রাজনীতি নিয়ে অভিযোগ ওঠাও বন্ধ হয়নি। রাজ্যপাল এবং সরকারের তরজার মাঝে এ দিন শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের হুমকি, ইটাহারের মেঘনাথ সাহা কলেজের কোনও পরীক্ষার্থীর রেজিস্ট্রেশন বাতিল করলে কলেজ অচল করে দেবে তারা। ছাত্র সংগঠনের এই সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিয়েছে তৃণমূলের উত্তর দিনাজপুর জেলা নেতৃত্বও। স্থানীয় বিধায়ক তথা তৃণমূলের জেলা সভাপতি অমল আচার্যের সঙ্গে বৈঠক করেই এ দিন ওই আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। অমলবাবুও এ দিন গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে ফোন করে কোনও পড়ুয়া যাতে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন, তা মাথায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।
কিন্তু ইটাহারের অধ্যক্ষা নিগ্রহই হোক বা আগের দিন রানিগঞ্জের টিডিবি কলেজে ভাঙচুর পুলিশ এখনও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। হরিরামপুরেও কেউ ধরা পড়েনি। সব ক’টিতেই অভিযোগের আঙুল ছিল শাসক দলের দিকে। কালীনগরের ঘটনায় অভিযুক্ত এসএফআইয়ের ছাত্রদের ধরতে অবশ্য দেরি হয়নি। রাজ্য সরকার মুখে যাই বলুক, এর মধ্যে আমরা-ওরার নীতিই খুঁজে পাচ্ছেন বিরোধীরা। কালীনগরে ধৃত ২৪ জন এসএফআই কর্মী-সমর্থককে এ দিন ফের ১৪ দিন জেল-হাজতে রাখার নির্দেশ দেন বসিরহাট আদালতের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট গোপালকৃষ্ণ সিংহ। মঙ্গলবার ধৃতদের আদালতে হাজির করানোর পাশাপাশি তদন্তকারী অফিসারকে মনোরঞ্জনবাবুর ইনজুরি-রিপোর্ট এবং তদম্তের সিডি পেশ করারও নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারক। কিন্তু মনোরঞ্জনবাবু এখনও বসিরহাট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় এ দিন ওই রিপোর্ট পেশ করতে পারেনি পুলিশ। রিপোর্ট না পেশ করা পর্যন্ত ধৃতদের তাই জেল-হাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক।

আমি যা বলার বলে দিয়েছি। বিতর্ক চললে চলুক। আমি চাই রাজনীতিমুক্ত ছাত্র সংসদ। ছাত্র সংসদ নির্বাচনও হোক সে ভাবেই।
এম কে নারায়ণন
রাজ্যপাল
ছাত্র নির্বাচন রাজনীতিমুক্ত করার ব্যাপারে পাল্টা প্রশ্ন, সাধারণ নির্বাচনেও হিংসা হয়। রাজনৈতিক দলগুলি কি তবে ভোটে লড়বে না?
ব্রাত্য বসু
শিক্ষামন্ত্রী

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.