পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন দলের ছাত্রদের হামলাবাজি, শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনায় রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন যে ভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তাতে অসন্তুষ্ট মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তৃণমূল সূত্রে জানা যাচ্ছে, মমতা অধ্যক্ষ নিগ্রহ বা ছাত্র রোষের অগণতান্ত্রিক প্রকাশকে মোটেই সমর্থন করছেন না। কিন্তু রাজ্যপাল যে ভাবে অভিযুক্ত ছাত্রদের ‘পিটিয়ে ঠান্ডা করা’র কথা বলেছেন, সেটি নিয়েও রাজ্য সরকারের অন্দরে প্রশ্ন উঠেছে।
রাজ্যের প্রবীণ মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় আজ বলেছেন, “এ ভাবে শিক্ষকদের নিগ্রহ করে আইন নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা আমরা সমর্থন করছি না। এ ব্যাপারে আইন আইনের পথেই চলবে। আইন মোতাবেক আমরা ব্যবস্থাও নেব। কিন্তু তার জন্য আমরা বলতে পারি না, ওরা পেটাচ্ছে বলে আমরাও পেটাব।”
তা হলে কি সুব্রতবাবু রাজ্যপালের দিকেই এই ইঙ্গিত করছেন? রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্য সরকারের কি তা হলে মতপার্থক্য তৈরি হচ্ছে? জবাবে সুব্রতবাবু বলেন, “কে কী বলছেন জানি না।” তবে তাঁর মন্তব্য যে রাজ্যপালের বক্তব্যের প্রেক্ষিতেই, সেটি নায়ায়ণনের নাম না করেও বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি।
ছাত্রদের হামলার বিষয়ে নিজের কড়া মনোভাব স্পষ্ট করেছেন মমতাও। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “ছাত্ররা, সে যে দলেরই হোন, নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন, সন্ত্রাস করবেন তা হতে পারে না। শক্ত হাতে মোকাবিলা করব। আইন আইনের পথেই চলবে।” বেশ কিছু দিন স্থগিত থাকার পরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ফের ফিরিয়ে আনার কথা ভাবছে রাজ্য সরকার। মমতার মতে, “স্কুলের কথা আলাদা। কিন্তু যে ছাত্র-ছাত্রীরা কলেজে পড়ছেন, তাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক। রাজনীতি করার অধিকারও রয়েছে তাঁদের। ওটাকে এক কথায় স্টিম রোলার চালিয়ে বন্ধ করতে পারি না। তবে সকলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে অদূর ভবিষ্যতে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
শুধু ছাত্রদের হামলার বিষয়ে নয়, বেশ কিছু দিন ধরেই রাজ্যপালের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর মতপার্থক্য চলছে। যে ভাবে বিভিন্ন বিষয়ে রাজ্যপাল প্রকাশ্যে মতামত জানাচ্ছেন, তা নিয়ে সরকারের মধ্যে বিতর্ক চলছে। তৃণমূল ও রাজ্য প্রশাসনের একটি জোরালো অংশের মত হল, সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যপাল একটি সাংবিধানিক পদে আসীন। ব্রিটেনের রানির মতোই তাঁকে জাঁকজমকপূর্ণ সাক্ষীগোপাল হয়ে থাকতে হয়। সেটিই রীতি। বামফ্রন্ট জমানায় গোপালকৃষ্ণ গাঁধী রাজ্যপাল থাকাকালীন যখন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে মতামত জানাতেন, তখন তা তৎকালীন বিরোধীদেরই সাহায্য করত। তখনও কিন্তু বিতর্কটি ছিল। অনেকেই মনে করেন, সে দিন সাংবিধানিক রীতি মেনে গোপালকৃষ্ণ গাঁধীর ওই ধরনের মন্তব্য করা উচিত হয়নি। আজও রাজ্যপাল নারায়ণন ওই ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না।
ছাত্র-হামলা রোধে রাজ্যপালের পিটুনি-তত্ত্ব হিংসায় আরও ইন্ধন দিতে পারে বলে মনে করেন অনেকে। তিনি ছাত্রদের পেটানোর কথা বললে এক শ্রেণির ছাত্র সেই প্ররোচনায় পা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে আরও বেশি করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এ ভাবে চলতে থাকলে অরাজকতার পরিস্থিতি তৈরি হবে বলে আশঙ্কা অনেকের।
শুধু ছাত্রদের হাতে শিক্ষক নিগ্রহের বিষয়টিই নয়, আরও কিছু বিষয়ে রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে শাসক তৃণমূল ও প্রশাসনের অন্দরে। নানা কারণে রাজ্যপাল ফোন করছেন, মুখ্যসচিবকে ডেকে পাঠাচ্ছেন। এই সক্রিয়তা শুরু হয়েছে কেন্দ্র থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার পর থেকেই। তৃণমূল কেন্দ্রে সমর্থন তুলে নেওয়ার পর থেকে কংগ্রেসের সঙ্গে যখন বিরোধ শুরু হল, তখন থেকে রাজ্যপালের ভূমিকারও পরিবর্তন চোখে পড়েছে দল ও প্রশাসনের। তারা মনে করছে, এই বিচ্ছেদের পর থেকে রাজ্যপাল অনেক বেশি কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। সম্প্রতি রাজ্যপালের একটি চিঠি নিয়েও ঝড় উঠেছে। যেখানে উনি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। রাজ্যের মুখ্যসচিবের কাছে নোট পাঠিয়েছেন, শুধু বাঙালিদের নিয়োগ করা হচ্ছে কেন? যার অর্থ, যাঁরা বাঙালি নন, তাঁদেরও রাখতে হবে। রাজ্য সরকারও প্রতিবাদ জানিয়ে রাজ্যপালের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। তাতে জানিয়ে দিয়েছে, রাজ্য সরকার কোনও রকমের ভাষাগত অনৈক্যে বিশ্বাস করে না। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষিজীবীর কাছে পৌঁছনোর জন্য ভাষাগত ভাবে বাঙালিদেরই নেওয়ার প্রয়োজন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজ্যপাল যে প্রশ্ন তুলেছেন, তাতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ রাজ্য সরকার।
তবে অসন্তুষ্ট হলেও মমতা এগুলি নিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে সংঘাতে যেতে চাইছেন না। তার সবথেকে বড় প্রমাণ, গত বছরও রাখি পূর্ণিমার দিন রাজ্যপালকে রাখি পরাতে গিয়েছিলেন মমতা। এ বছরেও তার অন্যথা হয়নি। এ বারেও তিনি রাজ্যপালকে রাখি দিতে গিয়েছিলেন। মমতা বরং এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন, তাঁর দিক থেকে মনোভাবের কোনও পরিবর্তন তিনি করতে চাইছেন না। |