শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য রুখতে কড়া দাওয়াই দিয়েছেন রাজ্যপাল। কিন্তু, দাওয়াই প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ-প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে ফের প্রশ্ন তুলে দিল সন্দেশখালি ও ইটাহারে অধ্যক্ষ নিগ্রহের পরবর্তী অধ্যায়। এর আগে একই বৈষম্যের অভিযোগ উঠেছিল রায়গঞ্জ ও মাজদিয়ার কলেজের দু’টি ঘটনায়।
সন্দেশখালির কালীনগর কলেজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে মারধরের অভিযোগে শনিবার, ঘটনার দিনই এসএফআইয়ের ২৪ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। রবিবার বসিরহাট আদালত তাঁদের দু’দিন জেল হাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু উত্তর দিনাজপুরের ইটাহারে ডক্টর মেঘনাদ সাহা কলেজের ঘটনায় কিন্তু দেখা গেল অন্য রকম। চার দিন আগে সেখানে ‘টুকলি করার জন্য’ খাতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল এক ছাত্রীর। তিনি গৌতম পাল নামে জেলা পরিষদের এক তৃণমূল সদস্যের স্ত্রী। খাতা কেড়ে নেওয়ার জেরে ওই কলেজের অধ্যক্ষা স্বপ্না মুখোপাধ্যায় এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মীকে মারধর করা হয়। অভিযোগ ওঠে গৌতম পাল-সহ ৭ জনের বিরুদ্ধে। সন্দেশখালিতে পুলিশ ঘটনার দিনই তৎপর হলেও অধ্যক্ষা-নিগ্রহে অভিযুক্ত ওই ৭ জনের বিরুদ্ধে এখনও ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ-প্রশাসন। ওই নেতার স্ত্রী শ্লীলতাহানির পাল্টা অভিযোগ করেছেন থানায়। |
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত অধ্যক্ষ ও ছাত্রেরা। |
একই ভাবে শনিবারই দক্ষিণ দিনাজপুরের হরিরামপুর আব্দুল গনি দেওয়ান কলেজে নকল ধরায় গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ামক সনাতন দাস-সহ ৪ জন আধিকারিককে নিগ্রহের ঘটনাতেও পুলিশকে কার্যত হাত গুটিয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। অথচ ওই ঘটনায় ক্ষুব্ধ গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য তথা রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন শনিবার রাতেই রাজ্য পুলিশের ডিজিকে বলেছিলেন, অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও জানিয়েছেন, হামলাকারী ছাত্রদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাঁর কথায়, “পরিস্থিতি কী অবস্থায় রয়েছে, তা জানা দরকার। এ বিষয়ে পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলব।”
কেন অভিযুক্তরা অধরা, তার জবাবে গঙ্গারামপুরের এসডিপিও স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুক্তি , “কারও নামে কলেজ কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেননি। অভিযুক্তদের চিহ্নিত করতে না পারায় নির্দিষ্ট ধারায় মামলাও রুজু করা যায়নি।” তবে, এ ক্ষেত্রে নকল করায় অভিযুক্ত ১৯ জন ছাত্রের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করেছে বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম বর্ষের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথম পত্রের পরীক্ষাও বাতিল করা হয়েছে।
দু’টি কলেজের ক্ষেত্রেই অধ্যক্ষ নিগ্রহের অভিযোগ দায়ের হয়েছে থানায়। কিন্তু তার একটি ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের গ্রেফতার ও জেল-হাজত এবং অন্য ক্ষেত্রে কোনও ব্যবস্থাই না নেওয়া মনে করিয়ে দিচ্ছে দেড় বছর আগের রায়গঞ্জ-মাজদিয়ার ঘটনা। রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে মারধর ও সরকারি সম্পত্তি নষ্টের অভিযোগ উঠেছিল উত্তর দিনাজপুরের তৃণমূল নেতা তিলক চৌধুরী-সহ ১০ জনের বিরুদ্ধে। সকলেই জামিন পান। অথচ এর পরেই নদিয়ার মাজদিয়ার সুধীররঞ্জন লাহিড়ী মহাবিদ্যালয়ে অধ্যক্ষকে নিগ্রহের অভিযোগে পাঁচ এসএফআই কর্মীর জেল-হাজত হয়। |
বসিরহাট আদালতে ধৃত এসএফআই সমর্থকেরা। |
এ বার সন্দেশখালি-ইটাহার পর্বেও প্রশ্ন উঠছে পুলিশ-প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে। সন্দেশখালির কলেজটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মনোরঞ্জন নস্কর ২৮ জন এসএফআই কর্মী-সমর্থকের বিরুদ্ধে তাঁর উপরে হামলার অভিযোগ করেছেন। পুলিশ খুনের চেষ্টা-সহ ১০টি ধারায় মামলা রুজু করেছে। ঘটনার দিনই ২৪ জনকে ধরা হয়েছে। কিন্তু এসএফআই-ও পাল্টা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) ১১ জনের বিরুদ্ধে তাদের উপরে হামলার অভিযোগ দায়ের করেছে থানায়। রবিবার রাত পর্যন্ত সেই ১১ জনের কাউকে পুলিশ ধরেনি। সিপিএমের প্রাক্তন ছাত্রনেতা এবং বর্তমানে দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তীর কটাক্ষ, “পুলিশ এখন আর ভারতীয় দণ্ডবিধি মানছে না। তারা চলছে রাজ্য সরকার এবং শাসক দলের দু’এক জন নেতা-নেত্রীর ঠিক করে দেওয়া বিধি মেনে!”
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষাঙ্গনে তাদের সংগঠনের সদস্যদের আচরণ সংযত রাখার বার্তা দিয়েছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। তাঁর বক্তব্য, “বিচ্ছিন্ন এই ঘটনাগুলি না ঘটলেই ভাল হোত। তবে শিক্ষক এবং ছাত্র দু’তরফকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখার আবেদন করছি।” দলের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে ছাত্রদের কাছে তাঁর আবেদন, “শিক্ষকদের সম্মান দিতে হবে। কেউ যাতে কোনও ভাবে আঘাত না পান, তা খেয়াল রাখতে হবে ছাত্রদের। দলতন্ত্র চালানো যাবে না শিক্ষাঙ্গনে।” একই সঙ্গে শিক্ষকদের প্রতি তাঁর আবেদন, “শিক্ষকরাও রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষাদান করার চেষ্টা করলে বোধহয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুস্থ পরিবেশ থাকতে পারে।”
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্য ঠেকাতে সংগঠনের সদস্যদের সতর্ক থাকতে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডাও। রবিবার সংগঠনের সমস্ত জেলা সভাপতি এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বকে পাঠানো চিঠিতে শঙ্কুদেব লিখেছেন, “শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রতি কোনও রকম অন্যায় আচরণ বা আক্রমণ সাংগঠনিক ভাবে বরদাস্ত করা হবে না।”
তবে, সন্দেশখালি কলেজে অধ্যক্ষের উপর হামলার (যেখানে অভিযুক্ত এসএফআই) ঘটনায় টিএমসিপি-র বদনাম করার চক্রান্ত হচ্ছে বলে ওই চিঠিতে দাবি করা হয়েছে। সংগঠনের উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে! দোষীদের চিহ্নিত করে দরকারে সংগঠন থেকে বহিষ্কার বা সাসপেন্ড করা হতে পারে।”
সন্দেশখালি থেকে ধৃত এসএফআই সমর্থকদের এজলাসে তোলা হলে বসিরহাটের এসিজেএম গোপালকৃষ্ণ সিংহ এ দিন প্রথমে ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাঁদের জেল হাজতে রাখার নির্দেশ দেন। ধৃতদের মধ্যে কয়েক জনের পরীক্ষা শুরু হচ্ছে বৃহস্পতিবার থেকে। এ বিষয়টি বিবেচনার আর্জি জানান দাঁদের আইনজীবীরা। তখন ধৃতদের দু’দিন জেল-হাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক। আগামী মঙ্গলবার ধৃতদের আদালতে হাজির করা এবং মামলার সিডি ও ইনজুরি রিপোর্ট পেশ করার নির্দেশ দেন তিনি।
এ দিন বসিরহাট হাসপাতালে অধ্যক্ষ মনোরঞ্জনবাবু অভিযোগ করেন, “কলেজে এসএফআই পরিচালিত ছাত্র সংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ওই ঘরে তালা দিয়ে দিতে হয়। সেই চাবি নিতে ওরা মে মাসেও আমার উপরে হামলা করেছিল। খুনেরও হুমকি দিয়েছিল। পুলিশকে তা জানিয়েছিলাম। তবে, শনিবার যা হল, তাতে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছি।” যদিও এসএফআইয়ের রাজ্য কমিটির সদস্য শেখ সাহানুর রহমান বলেন, “আমাদের ছেলেরা অধ্যক্ষকে স্মারকলিপি দিতে গিয়েছিল। টিএমসিপি-র ছেলেরাই ওদের মারধর করে ঘরে আটকে রাখে। পরে মিথ্যা অভিযোগে পুলিশের হাতে তুলে দিল।” তাঁর অভিযোগ, অধ্যক্ষ একটি নির্দিষ্ট দলের হয়ে কাজ করছেন। অথচ, এসএফআইয়ের অভিযোগে পুলিশ গুরুত্ব দিচ্ছে না।
ধৃতদের অভিভাবকদের একাংশেরও বক্তব্য, পুলিশ শাসক দলের কথামতো কাজ করেছে। ইটাহারে অধ্যক্ষা নিগ্রহে কাউকে ধরা না হলেও এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠনের সমর্থক হওয়াতেই তাঁদের ছেলেদের ফাঁসানো হল। উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী অবশ্য দাবি করেছেন, “একটি ছাত্র সংগঠন (এসএফআই) অন্য সংগঠনের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ করায় নির্দিষ্ট মামলা হয়েছে। কিন্তু অভিযোগের সারবত্তা এখনও মেলেনি। তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যে ২৪ জনকে ধরা হয়েছে, তা অধ্যক্ষের অভিযোগের ভিত্তিতেই।”
ইটাহারের কলেজে পুলিশ এখনও অভিযুক্তদের ধরল না কেন?
পুলিশ সূত্রের খবর, অভিযুক্তদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। উত্তর দিনাজপুরের পুলিশ সুপার অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, “দু’পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। আইন অনুযায়ী মামলা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করেই অভিযুক্তদের ধরা হবে।”
|
নৈরাজ্যের তিন কলেজ |
সন্দেশখালি |
ইটাহার |
হরিরামপুর |
অভিযোগ |
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে অধ্যক্ষা-সহ
তিন গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের
বেধড়ক মারধর, খুনের চেষ্টা।
সরকারি সম্পত্তি নষ্ট। |
অধ্যক্ষা-সহ তিন
শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং
এক শিক্ষাকর্মীকে মার |
গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা
নিয়ামক সহ চার জনকে হেনস্থা,
গাড়ি ও অধ্যক্ষের ঘর ভাঙচুর। |
প্রমাণ |
ভিডিও ফুটেজ
বা ছবি নেই। |
ভিডিও ফুটেজ
বা ছবি নেই। |
নিয়ামকের মেডিক্যাল
রিপোর্ট। ছবি নেই। |
পদক্ষেপ |
ধৃত এসএফআইয়ের ২৪ জন। |
গোলমালে অভিযুক্তদের চিহ্নিত
করার কাজ শুরু হয়েছে
বলে
দাবি পুলিশের। |
থানায় নিয়ামকের জিডি। শনিবার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথম পত্রের পরীক্ষা
ও ১৯ জনের রেজিস্ট্রেশন বাতিল। |
ধারা |
(জামিন অযোগ্য) ৩২৩/৩২৫
/৩২৬, ধারালো অস্ত্রের আঘাত।
৩০৭, খুনের চেষ্টা। ৩৩৩, সরকারি
কর্মীকে ইচ্ছাকৃত আঘাত। (জামিনযোগ্য) ১৪৭/১৪৮/১৪৯, সশস্ত্র জমায়েত।
৩৫৩, সরকারি কাজে বাধা।
৫০৬, ভয় দেখানো। |
কলেজের অভিযোগে
(জামিন অযোগ্য) ৩৫৪, ৩৭৯ শ্লীলতাহানি, চুরি। ৪৪৭
/৪৪৮ অনধিকার প্রবেশ।
৩২৩, ৩২৫ আঘাত।
৫০৬ কটূক্তি, হুমকি। তৃণমূল
নেতার স্ত্রীর অভিযোগে
(জামিন অযোগ্য) ৩৫৪।
৩৪১ জোর করে আটকে রাখা।
৩২৩, এবং ৫০৬। |
পুলিশের দাবি, শুধু
জিডি হওয়ায় কোনও নির্দিষ্ট
ধারায় মামলা রুজু করা হয়নি। |
ফল |
ধৃতদের দু’দিন জেল-হাজত। |
কোনও গ্রেফতার হয়নি। |
কোনও গ্রেফতার হয়নি। |
|