বালি মাফিয়াদের লাগাম পরাতে বামেদের করা আইন বাতিল করে আরও কড়া আইন আনতে চাইছে তৃণমূলের সরকার। মূল লক্ষ্য, রাজস্ব বাড়ানো। বৈধ ভাবে বালি তোলার নিয়মকানুনও আগের চেয়ে কড়া হবে।
মহাকরণ সূত্রের খবর, বিধানসভার আগামী অধিবেশনে ওই বিল আনা হতে পারে। কী ভাবে নদীখাত, সেতু, পাড়ের বসতের পরোয়া না করে দেদার বালি চুরি হচ্ছে, তা নিয়ে সেচ দফতরের রিপোর্ট পাওয়ার পরে নড়েচড়ে বসেছে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরও। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রকে গোটা বিষয়টি দেখার নির্দেশ দিয়েছেন। চলতি মাসের শেষ দিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব দফতরের মন্ত্রী ও প্রধান সচিবদের নিয়ে বৈঠক ডাকতে চলেছেন মুখ্যসচিব।
বুধবার রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “২০০২ সালের ওয়েস্ট বেঙ্গল মাইনর মিনারেল আইন করেছিল বাম সরকার। কিন্তু সেটা খুবই দুর্বল। তা দিয়ে বালি মাফিয়াদের দমন করা কার্যত অসম্ভব।” বর্ধমান, হাওড়া, হুগলি, বীরভূম, উত্তর ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদ এবং মালদহ জেলায় দীর্ঘদিন ধরেই বালি চুরির রমরমা চলছে। কখনও-সখনও ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক গলে পার পেয়ে যায় বালি মাফিয়ারা। খুব জোর নামমাত্রা জরিমানা ধার্য হয়। সরকারের রাজস্বের ক্ষতি হয় কোটি কোটি টাকা।
সেচমন্ত্রী বলেন, “আমরা বালি তোলার বিরুদ্ধে নই। কিন্তু নিয়ম মেনে বালি তোলা হোক। নইলে নদীর পাড় ভেঙে যাচ্ছে, বাঁধে ফাটল ধরছে, সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নতুন আইনে অবৈধ কারবারিদের জেল ও জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হবে।” তাতে শুধু বালি থেকেই রাজ্যে বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ঠিক কী থাকছে নতুন আইনে?
প্রস্তাবিত আইনে বলা হচ্ছে, প্রতিটি জেলায় বালি মাফিয়া রুখতে জেলাশাসকেরা একটি সমন্বয় কমিটি গড়বেন। তাতে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর, সেচ দফতর, পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তারা থাকবেন। বালি তোলায় কোনও বেনিয়ম হচ্ছে কি না, তা ওই কমিটি দেখবে। বেআইনি বালি তোলা আটকানো, প্রয়োজনে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করার পূর্ণ ক্ষমতাও থাকবে তাদের হাতে। যাঁরা বৈধ ভাবে বালি তুলতে চান, তাঁদের মোটা টাকা জমা রেখে সেচ দফতর থেকে অনুমতি নিতে হবে। এখনকার আইনে তেমন কোনও ব্যবস্থা নেই।
রাজ্য প্রশাসনের ব্যাখ্যা, বড় ট্রাকে বালি নিয়ে যাওয়ার সময়ে এলাকার রাস্তা, বাঁধ, কালভার্ট, সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বালি ব্যবসায়ীদের জমা রাখা টাকায় সেগুলির মেরামতি হবে। চুক্তির মেয়াদ শেষে খরচখরচা বাদ দিয়ে জমা টাকা ফেরত দেওয়া হবে। তবে কোনও অবস্থাতেই আর বাঁধের উপর দিয়ে বালির ট্রাক যেতে পারবে না। বাঁধ এড়িয়ে নদীর পার দিয়ে অন্য রাস্তায় যেতে হবে। সেই রাস্তা তৈরি ও মেরামতি করতে হবে বালি খাদানের মালিকদেরই। এর অন্যথা হলে কারবারির লাইসেন্স বাতিল করার ব্যবস্থা থাকবে নতুন আইনে।
বৈধ ভাবে বালি তোলার ক্ষেত্রেও বর্তমানে যে পদ্ধতিতে যত টাকা আদায় হয়, তা নিয়ে আপত্তি আছে সেচ দফতরের। এখন নদীর চরে বালি তুলতে দিয়ে বছরে একর পিছু মোটে ৫৪ টাকা আয় হয় রাজ্য সরকারের। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর ওই টাকা আদায় করে সেচ দফতরকে দেয়। সেই সুযোগে ভূমি দফতরের কিছু আধিকারিক মাইলের পর মাইল বালি চুরির রাস্তাও করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বার পুরোটাই নিজেদের হাতে নিতে চাইছেন সেচকর্তারা। নদীচরের লিজের টাকাও বাড়ানোর কথা ভাবা হচ্ছে। প্রতিটি বালি খাদানের কাছে চেকপোস্টও তৈরি করতে চাইছে সেচ দফতর। তারাই বালির লরিকে চালান দেবে।
সেচমন্ত্রী অবশ্য দাবি করেন, চালু আইনের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যথাসাধ্য করছেন তাঁরা। যেমন রাজ্যে অন্তত ২৪৮টি বেআইনি বালি খাদান চলছে বলে খবর। ইতিমধ্যেই ৩০টি এমন খাদান বন্ধ করা হয়েছে। সেচকর্তাদের একাংশের মতে, নতুন আইন হলে কাগজে-কলমে সুবিধা হবে ঠিকই। কিন্তু তা বলবৎ করতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সদিচ্ছাই বেশি জরুরি।
|