বিধানসভা ভোটে তা-ও কিছু জায়গা বাকি ছিল। এ বার পঞ্চায়েত ভোটে গোটা জঙ্গলমহলই ছেয়ে গেল ঘাসফুলে।
তৃণমূল শুধু তার প্রধান প্রতিপক্ষ বামফ্রন্টকেই হারায়নি, সেই সঙ্গে মাওবাদী-প্রভাবিত কয়েকটি ‘পকেটে’ বহুকালের পুরনো রাজনৈতিক শক্তি ঝাড়খণ্ডীদেরও হারিয়ে দিয়েছে।
যেমন সিজুয়া গ্রাম পঞ্চায়েত। লালগড় আন্দোলনের ধাত্রীভূমি সিজুয়া গ্রাম পঞ্চায়েত বড় ব্যবধানে দখল করেছে তৃণমূল। গত তিরিশ বছরে এ-ই প্রথম ঝাড়খণ্ডীদের হাতছাড়া হল সিজুয়া। ১৯৮৩ থেকে সিজুয়া গ্রাম পঞ্চায়েতে টানা জিতে এসেছে ঝাড়খণ্ডীরা। এ বার সিজুয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ১০টি আসনের মধ্যে আটটিই জিতেছে তৃণমূল, ঝাড়খণ্ড অনুশীলন পার্টি জিতেছে দু’টিতে।
অথচ তৃণমূল-বিরোধী ভোট যাতে ভাগ না-হয়, সে জন্য সিজুয়ায় নিজেদের প্রার্থী দেয়নি সিপিএম, তলেতলে তারা সমর্থন করেছিল ঝাড়খণ্ডীদের। কিন্তু সোমবার ফল বেরোনোর পরে সিপিএমের লালগড় লোকাল কমিটির এক সদস্যের কথায়, “আমাদের চালটা খাটল না, কোনও হিসেবই মিলল না।”
গোটা জঙ্গলমহলেই সিপিএমের হিসেব এ বার উল্টে গিয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলায় তো সিপিএম-কে তৃণমূল কার্যত দাঁড়াতেই দেয়নি, পুরুলিয়ায় পর্যন্ত একক আধিপত্য বিস্তার করেছে শাসকদল। অথচ, পুরুলিয়ায় তৃণমূল ও কংগ্রেসের ভোট কাটাকাটিতে তাঁরা ফায়দা তুলবেন, এমনকী জেলা দখলের মতো পরিস্থিতিতেও চলে যেতে পারেন বলে সিপিএমের কোনও কোনও নেতা আশা করেছিলেন। |
এই ফলকে জঙ্গলমহলের সিপিএম নেতৃত্ব সরাসরি ‘বিপযর্য়’ বলে স্বীকার করে নিচ্ছেন। পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা বাঁকুড়ার জেলা সম্পাদক অমিয় পাত্রের কথায়, “আমাদের ফল খুবই খারাপ হয়েছে। বিশেষ করে, জঙ্গলমহলে এক সময়কার মাওবাদী প্রভাবিত এলাকাগুলিতে তৃণমূল অনেক ভাল ফল করেছে। আমাদের এই বিপর্যয় অপ্রত্যাশিত।”
কিন্তু কেন এমনটা হল? অমিয়বাবুর ব্যাখ্যা, “জুনিয়র কনস্টেবল, এনভিএফ, হোমগার্ডের চাকরিতে বহু যুবককে নিয়োগ ও দু’টাকা কেজি দরে চাল বিলি করাটা সরকার তথা শাসকদলের পক্ষে গিয়েছে।”
পুরুলিয়ায় সিপিএমের জেলা সম্পাদক মণীন্দ্র গোপ-ও বলেন, “জঙ্গলমহলের কিছু কিছু এলাকায় পুলিশের চাকরির বিষয়টি ভোটের ফলে প্রভাব ফেলেছে।” শাসক দল ভোট কিনেছে, সন্ত্রাস করেছে, এই অভিযোগও তিনি করেন। তবে পশ্চিম মেদিনীপুরে দলের জেলা সম্পাদক দীপক সরকার বলেন, “ফল কেন এত খারাপ হল, সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়। এলাকা ধরে ধরে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে।”
গত বিধানসভা নির্বাচনে জঙ্গলমহলে দলের খারাপ ফলের জন্য তৃণমূলের সঙ্গে মাওবাদীদের ‘অশুভ আঁতাঁত’-কে দায়ী করে সিপিএম।
কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাকরণে আসার ছ’মাসের মধ্যেই ঝাড়গ্রামের কাছে যৌথবাহিনীর হাতে নিহত হন মাওবাদীদের শীর্ষনেতা কিষেণজি। ফলে, মাওবাদী-তৃণমূল আঁতাঁতের অভিযোগ অন্তত এই পঞ্চায়েত ভোটে ধোঁপে টিকবে না, সেটা সিপিএম নেতৃত্ব বিলক্ষণ জানেন। তাঁরা সে পথে হাঁটেনওনি। এ বারের পঞ্চায়েত ভোটে জঙ্গলমহলে তৃণমূলেরই আধিপত্য থাকবে, সিপিএম নেতৃত্বের তা নিয়ে সংশয় ছিল না। কিন্তু এমন ভরাডুবির জন্যও প্রস্তুত ছিলেন না তাঁরা।
যেমন, পশ্চিম মেদিনীপুরে বিনপুর-১ ব্লকের ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ১০টিই জিতেছে তৃণমূল। এর মধ্যে লালগড় গ্রাম পঞ্চায়েত আছে, সিপিএমের দাপুটে নেতা অনুজ-ডালিম পাণ্ডেদের ঘাঁটি ধরমপুর গ্রাম পঞ্চায়েতও আছে। বিনপুর-২ ব্লকেও ১০টির মধ্যে ১০টি, গোপীবল্লভপুর-২ ব্লকের সাতটির মধ্যে সাতটি, ঝাড়গ্রাম ব্লকের ১৩টির মধ্যে ১২টি, সাঁকরাইল ব্লকের ১০টির মধ্যে ন’টি, নয়াগ্রাম ব্লকের ১২টির মধ্যে ১১টি, গোপীবল্লভপুর-১ ব্লকের সাতটির মধ্যে চারটি গ্রাম পঞ্চায়েত জিতে নিয়েছে তৃণমূল।
পুরুলিয়া জেলায় মাওবাদীদের আঁতুড়ঘর বলে পরিচিত বলরামপুর ব্লকের সাতটি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে পাঁচটিতেই জয়ী হয়েছে তৃণমূল। জেলার অন্য মাওবাদী-প্রভাবিত এলাকার মধ্যে বান্দোয়ানের আটটি গ্রাম পঞ্চায়েতের চারটি, বরাবাজারের ১০টির মধ্যে ন’টি এবং মানবাজারের সাতটি গ্রাম পঞ্চায়েতের ছ’টি তৃণমূল দখল করেছে। সিপিএমের জেলা সম্পাদক মণীন্দ্র গোপের বাড়ি বরাবাজার গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়। ওই গ্রাম পঞ্চায়েতও জিতেছে তৃণমূল।
একই ভাবে বাঁকুড়া জেলায় সিপিএমের জেলা সম্পাদক অমিয় পাত্রের বাড়ি যেখানে, সেই তালড্যাংরা গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করেছে তৃণমূল। মাওবাদী-প্রভাবিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত তালড্যাংরা ব্লকের ন’টি গ্রাম পঞ্চায়েতের আটটিতেই তৃণমূল জিতেছে, একটির ফল অমীমাংসিত। রানিবাঁধ ব্লকের আটটি ও খাতড়া ব্লকের সাতটি গ্রাম পঞ্চায়েতের সবগুলিতেই তৃণমূল জয়ী হয়েছে। রাইপুর ব্লকের ১০টির মধ্যে আটটি, সারেঙ্গা ব্লকের ছ’টির মধ্যে পাঁচটিতে জিতেছে তৃণমূল।
এই বিপুল জয় সম্পর্কে তৃণমূল নেতৃত্বের কী বক্তব্য? গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ এলাকায় দলীয় সংগঠন তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। এই পঞ্চায়েত ভোটে তারই সুফল পাওয়া গেল বলে ধারণা স্থানীয় তৃণমূলের একাংশের।
মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি শুভেন্দুও এ বার জঙ্গলমহলের বহু জায়গায় নির্বাচনী প্রচারে গিয়েছিলেন। জঙ্গলমহলের মানুষ শান্তি ও উন্নয়নের পক্ষে ভোট দিয়েছেন, দাবি করে এ দিন শুভেন্দু বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতায় আসার ছ’মাস পর থেকে ওই তল্লাটে কোনও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেনি। অন্য দিকে ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড কিংবা ওড়িশায় কী ঘটছে, মানুষ জানছেন।”
সিপিএমের নিচুতলার কর্মীরাও অবশ্য এই ব্যাখ্যার সঙ্গে কিছুটা একমত। সিপিএমের লালগড় লোকাল কমিটির সদস্য তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, মানুষ সরকারের পক্ষে, উন্নয়নের পক্ষে এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দিয়েছে। মানুষ স্থিতাবস্থা চেয়েছেন।” |