আন্দোলনের দুই ভূমিতেই রইল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের দাগ
সৃণ জয়, তবু গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের দাগ একটু রয়েই গেল।
নন্দীগ্রাম এবং সিঙ্গুর জমি আন্দোলনের দুই ধাত্রীভূমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিরোধী নেত্রী থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মসনদে বসিয়েছে। দু’জায়গাতেই এ বারও পঞ্চায়েত স্তরের ভোটে জিতল তাঁর দল। কিন্তু সেই জয়ে বিঁধে রইল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কাঁটা।
আগের পঞ্চায়েত ভোটে দু’জায়গাতেই বামেদের উড়িয়ে দিয়েছিল তৃণমূল। নন্দীগ্রামের দু’টি ব্লকে ১৭টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ১৭টিতেই জিতেছিল তৃণমূল। একটিতে বামেরা প্রথমে জিতলেও পরে তা হাতবদল হয়ে তৃণমূলের দখলে যায়। এ বার? তৃণমূলের সেই একাধিপত্যে চিড় ধরিয়ে তিনটি পঞ্চায়েত ছিনিয়ে নিয়েছেন ‘নির্দল’ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়া দলের বিক্ষুব্ধ প্রার্থীরাই।
সিঙ্গুরের ১৬টি পঞ্চায়েতের মধ্যে গত বার তৃণমূলের দখলে ছিল ১৫টি। একটি ছিল সিপিএমের। এ বার তৃণমূলের দখলে ১২টি পঞ্চায়েত। সিপিএম পেল দু’টিবড়া এবং মির্জাপুর-বাঁকিপুর। একটি (বড়াই-পহলমপুর) ‘টাই’ এবং একটি ত্রিশঙ্কু। শাসক দলের স্থানীয় নেতারা এই ফলাফলের পিছনে দলের কোন্দলকেই দায়ী করছেন।
২০০৭ সালের নন্দীগ্রামে জমি আন্দোলনের সময়ে তৃণমূল পাশে পেয়েছিল কংগ্রেস, এসইউসি-র মতো কয়েকটি দলকে। পরের বছরের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের লড়াইটাও ছিল কার্যত জোট বেঁধেই। এ বার জোট ছিল না। ছিল না নন্দীগ্রাম হাওয়াও। বামেদেরও কার্যত কোনও অস্তিত্ব ছিল না। সুতরাং লড়াইটা প্রথম থেকেই ছিল তৃণমূলের সঙ্গে বিক্ষুব্ধ তৃণমূলের। নন্দীগ্রামের ১৪০টি পঞ্চায়েত আসনের ১০৩টি এসেছে তৃণমূলের দখলে। নির্দল পেয়েছে ২০টি। কংগ্রেস ১৬টি। সিপিএম মাত্র একটি।
আসন কমলেও সিঙ্গুরে জিতল তৃণমূল। ছবি: দীপঙ্কর দে।
সোমবার সকালে নন্দীগ্রাম কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে স্থানীয় বাসিন্দা আনসার মিঞা বলছিলেন, “সামসাবাদ পঞ্চায়েত আমরাই দখল করব মনে হচ্ছে।” দেখা গেল, ওই পঞ্চায়েতের ১৩টি আসনের মধ্যে সাতটিতে জিতল নির্দল। এই নির্দল প্রার্থীদেরই সমর্থন করেছেন আনসার মিঞারা। কংগ্রেস পেল দু’টি আসন, তৃণমূলের ঝুলিতে চারটি। ২০০৮ সালে রাজ্যে পালাবদলের সময়ে সামসাবাদের ১৩টি আসনই ছিল তৃণমূলের দখলে। আজ সেখানেই পিছু হঠতে হল তৃণমূলকে।
কেন বদলে গেল সামদাবাদের ছবিটা?
জয়ী নির্দল প্রার্থী শেখ সামসুদ্দিনের কথায়, “পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল নেতারা কাজ করেননি। সীমাহীন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।” পাশ থেকে পারভেজ রহমান যোগ করলেন, “সরকারি যোজনার সুযোগ-সুবিধা ওরা হস্তগত করেছে। প্রতিবাদ করলেই বলেছে ‘সিপিএম’।”
সামসাবাদকে অবশ্য বেশি গুরুত্ব দিতে নারাজ তৃণমূল নেতারা। সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী যেমন বললেন, “সামসাবাদ খুবই ছোট একটা ঘটনা। ওখানে যাঁরা জিতেছেন, তাঁরা তো আমাদেরই লোক। নিশ্চয়ই কিছু ক্ষোভ-বিক্ষোভ রয়েছে। আমরা তা প্রশমন করতে পারিনি।”
নন্দীগ্রাম কলেজের সামনে তখন তৃণমূল সমর্থকদের ভিড়। চলছে প্রার্থীদের সবুজ আবির মাখানো। ভিড় থেকে আবির-মাখা একটা হাত এগিয়ে এল। হাতের মালিক শম্ভুচন্দ্র ভুঁইয়া। নন্দীগ্রাম সদরে তৃণমূলের একটি বুথ কমিটির সভাপতি। বললেন, “প্রার্থী বাছাই নিয়ে নন্দীগ্রামে সর্বত্রই মন কষাকষি ছিল। কোথাও বিক্ষুব্ধদের বোঝানো গিয়েছে, কোথাও যায়নি।” দুর্নীতির অভিযোগ শম্ভুবাবুও স্বীকার করে নিয়েছেন। সামসাবাদে যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রধান অভিযোগ সেই শেখ খুশনবির (এ বার সামসাবাদ থেকে পঞ্চায়েত সমিতির আসনে দাঁড়িয়ে হেরে গিয়েছেন) সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, “আমাদের এলাকাতেও তৃণমূলের প্রতীকে লড়া কোনও নেতা এতটা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে হয়তো আমরাও বিক্ষুব্ধ হয়ে যেতাম।”
নন্দীগ্রাম কলেজের সামনে নির্দল হিসেবে জয়ী বিক্ষুব্ধেরা গোলাপি আবির ওড়াচ্ছিলেন। গোলাপি কেন? এক জন বললেন, “সবুজ তো তৃণমূল নিয়েছে। তাই।” পাশ থেকে আর এক জনের ফিসফিস, “গোলাপিও বলতে পারেন, আবার ফিকে লালও বলতে পারেন। নন্দীগ্রামের আনাচ-কানাচে যে সিপিএম সমর্থকরা রয়ে গিয়েছেন, তাঁদের ভোট ছাড়া কি তৃণমূলকে হারানো সম্ভব হতো!”
নন্দীগ্রামের মতোই ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলকে হাত উপুড় করে ভোট দিয়েছিলেন সিঙ্গুরের মানুষও। প্রচার-পর্বে সেখানকার জমি-আন্দোলনের অন্যতম নেতা তথা রাজ্যের কৃষি প্রতিমন্ত্রী বেচারাম মান্না দাবি করেছিলেন, গত বারে পঞ্চায়েতের ১৫-১ হিসেবটা বদলে গিয়ে ১৬-০ ফলে বামেরা হারবে। পাঁচটি পঞ্চায়েত বিরোধীশূন্য হবে।
কিন্তু সোমবার দেখা গেল ছবিটা মেলেনি।
নন্দীগ্রামে জয়ী নির্দল সমর্থককে ঘিরে সমর্থকরা। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।
বড়া এবং মির্জাপুর-বাঁকিপুর পঞ্চায়েত দখল করার পরে সিপিএমের সিঙ্গুর জোনাল কমিটির সম্পাদক পাঁচকড়ি দাস বলেন, “আমরা তো আগের চেয়ে এ বার ভাল ফল করলাম। মানুষ ক্রমেই নিজেদের ভুল বুঝতে পারছেন।” সিপিএমের এই দাবি উড়িয়ে দিলেও সিঙ্গুরের তৃণমূল নেতাদের একাংশ মেনে নিচ্ছেন, দলীয় বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এবং বেচারাম মান্না গোষ্ঠীর লড়াই মানুষ ভাল ভাবে নেননি। এ বারে ভোটের টিকিট বিলি এবং প্রচারেও সেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ছায়া দেখা গিয়েছে। বেচারামবাবু অবশ্য দু’টি পঞ্চায়েত হাতছাড়া হওয়াকে গুরুত্ব না দিয়ে বলেন, “ও সব বিষয় আগেই মিটে গিয়েছিল। মানুষ সব বিচার করেই আমাদের উপর আস্থা রেখেছেন।”
টাটাদের প্রকল্প এলাকাকে ঘিরে থাকা তিনটি পঞ্চায়েতে (বেড়াবেড়ি, গোপালনগর ও কেজিডি) রমরমা তৃণমূলেরই। এর মধ্যে গোপালনগর এই প্রথম হাতছাড়া হল বামেদের। ওই তিন এলাকার গ্রামবাসীরা এ দিনও জানিয়েছেন, জমি ফেরতের ব্যাপারে তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের উপরে আস্থা রাখছেন।
সকাল থেকেই সিঙ্গুরের মহামায়া উচ্চ বিদ্যালয়ের গণনাকেন্দ্রের কাছে ভিড় বেড়েছে। উড়েছে সবুজ আবির। আনন্দে মেতেছেন সমর্থকেরা। তবু সব পঞ্চায়েতে না জেতার আফসোসটা যাচ্ছে না দলীয় নেতাদের।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.