রাজ্য জোড়া পরিবর্তনের তিন বছর আগেই পরিবর্তনের পথিকৃৎ ছিল পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা। এই দুই জেলায় পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে শাসনপাট চালিয়েছে তৃণমূল। এ বারের ভোটে পরীক্ষা ছিল শাসক তৃণমূলের। আর সেই পরীক্ষায় প্রতিষ্ঠান-বিরোধী প্রবণতাকে উড়িয়ে সসম্মানেই উত্তীর্ণ শাসক দল। কাঁটা বলতে এখানে-ওখানে সামান্য ধাক্কা, যা ধর্তব্যের মধ্যেই আনছে না শাসকপক্ষ।
যেমন পূর্ব মেদিনীপুর। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সূত্রে এই জেলাই ছিল পরিবর্তনের আঁতুড়ঘর। ২০০৮ সালে এই জেলা থেকেই তৃণমূলের জয়যাত্রার সূচনা। পরিসংখ্যান বলছে, এ বারের ভোটে জেলার ২২৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১৫৭টিতেই জিতেছে তৃণমূল। বামেদের দখলে মাত্র ৪৩টি। এক-আধটা বাদে প্রায় সবক’টি পঞ্চায়েত সমিতিও তৃণমূলের দখলেই আসতে চলেছে। সোজা হিসেবে এই অঙ্কে তৃণমূলের উদ্বেগের কিছু নেই। কিন্তু ব্লক ভিত্তিক পঞ্চায়েতের হিসেব করতে বসলে অন্য সমীকরণ ধরা পড়ছে।
২০০৮ সালে বিরোধীশূন্য ভাবে সুতাহাটা পঞ্চায়েত সমিতির দখল নিয়েছিল তৃণমূল। এ বার এই পঞ্চায়েত সমিতি ১১-৫ ব্যবধানে ছিনিয়ে নিয়েছে বামেরা। ব্লকের ৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৩টিতেই সিপিএম জিতেছে। একটি কংগ্রেস। তৃণমূল দখলে ২টি। মহিষাদলেও তৃণমূল গতবারের মতো এ বার আর নিরঙ্কুশ নয়। এই ব্লকের দু’টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে জয়ী হয়েছে বামেরা। |
হলদিয়া ঘেঁষা সুতাহাটা-মহিষাদলে তৃণমূলের তুলনামূলক খারাপ ফলের কারণ হিসেবে মূলত দু’টি বিষয় উঠে এসেছে। প্রথমত, তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং দ্বিতীয়ত হলদিয়া শিল্পাঞ্চলে শাসকদলের গা-জোয়ারি। সিপিএমের জোনাল সম্পাদক সুদর্শন মান্নার কথায়, “শিল্পে নৈরাজ্য চলছে। শিল্পনগরী ঘেঁষা সুতাহাটার মানুষ তা মানতে পারেননি। তাই আমাদের ভোট দিয়ে উন্নয়নের পক্ষেই সওয়াল করেছেন।” দলের এমন ফলে হতাশ সুতাহাটা ব্লকে তৃণমূলের তরফে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা তুষার মণ্ডল। তাঁর কথায়, “দলের একাংশের ব্যক্তিস্বার্থের জন্যই এমন হার।” গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে তৃণমূলের মুখ পুড়েছে খাস নন্দীগ্রামেও। দু’টি ব্লকের ১৪টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৩টির দখল নিয়েছেন নির্দল প্রার্থীরা।
পূর্ব মেদিনীপুরে মোট ব্লক ২৫টি। তার মধ্যে শুভেন্দুর নিজের লোকসভা কেন্দ্র তমলুকের মধ্যে যে সব ব্লক পড়ে, তার বেশ কয়েকটিতে ভোটের ফল তৃণমূলের অস্বস্তি বাড়াচ্ছে। যেমন, নন্দকুমার ব্লকে মোট ১২টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে তৃণমূল পেয়েছে ৭টি, বামেরা জিতেছে ৫টিতে। ২০০৮ সালে এই ব্লকে বামেদের দখলে ছিল মাত্র একটি গ্রাম পঞ্চায়েত। কোলাঘাট ব্লকে ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে বামফ্রন্টের দখলে এসেছে ৫টি, তৃণমূলের ৬টি, কংগ্রেস ১টি এবং ১টি ত্রিশঙ্কু। এই ব্লকে গত নির্বাচনে বামেরা ২টি এবং কংগ্রেস ১টি পঞ্চায়েতের দখল নিয়েছিল। যে তমলুক ব্লকে বিরোধীদের কার্যত অস্তিত্বই ছিল না, সেখানেও এ বার ২টি গ্রাম পঞ্চায়েতের দখল নিয়েছে বামেরা।
শাসক তৃণমূলের কাছে কি এই ফল কিছুটা উদ্বেগের?
নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সেনাপতি তথা তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর কথায়, “প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা সব সময়ই থাকে। এই প্রথম আমরা শাসক হিসেবে ভোট চাইলাম। তা ছাড়া, গত নির্বাচনে কংগ্রেস-এসইউসির সঙ্গে তলায় তলায় জোট ছিল। এ বার আমরা একা লড়েছি। সেই হিসেবে আমাদের ফল রীতিমতো ভাল হয়েছে। কিছু পঞ্চায়েত হাতছাড়া হয়েছে ঠিকই, আবার কিছু পঞ্চায়েত আমরা বিরোধীদের থেকে দখলও করেছি। সার্বিক ভাবে জেলার ফল ভালই হয়েছে।” কিন্তু সুতাহাটা, নন্দকুমার, কোলাঘাটে বামেদের এত ভাল ফল আশা করেছিলেন? যুব তৃণমূলের রাজ্য সভাপতির যুক্তি , “বিরোধীরাই তো সন্ত্রাস সন্ত্রাস বলে চেঁচাচ্ছিল! ওদের ভাল ফল প্রমাণ করছে এই জেলায় সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি রয়েছে।”
বামেরা অবশ্য ফলপ্রকাশের দিনও সন্ত্রাসের প্রসঙ্গই টেনেছে। সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নিরঞ্জন সিহির মতে, “সন্ত্রাস কম হলে আমাদের ফল আরও ভাল হত।” আশার আলো দেখছেন সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠ। তাঁর বক্তব্য, “এই ফলে প্রমাণ হল, আমাদের উপরে মানুষের আস্থা একেবারে চলে যায়নি।”
পূর্ব মেদিনীপুরের মতোই দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলাতেও ছিল শাসক তৃণমূলের দুর্গরক্ষার লড়াই। গ্রাম পঞ্চায়েতের ফলাফলে সেই সবুজ দুর্গ কিন্তু যথেষ্ট স্বস্তিতে রাখল না তৃণমূলকে। আসন বেড়েছে বামেদের। পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের সম্পূর্ণ ফল প্রকাশ এখনও বাকি।
এই জেলায় ২০০৮ সালে ৩১২টি পঞ্চায়েতের মধ্যে বামেরা পেয়েছিল ৬৯টি। এ বার ৩১০টি পঞ্চায়েতের মধ্যে তারা পেয়েছে ৯৯টি। অর্থাৎ, বেশ কিছু আসন হারিয়েছে তৃণমূল। তৃতীয় শক্তি হিসেবে বিজেপির উত্থান চোখে পড়েছে। জয়নগরে এসইউসির দুর্গে থাবা বসিয়েছে তারা। জয়নগর ১ ও ২ ব্লকের ১২টি আসনে জয়ী বিজেপি। দক্ষিণ শহরতলির বিষ্ণুপুর ১ ব্লকের বেশ কিছু আসনেও জয়ী তারা। ডায়মন্ড হারবার-সহ কয়েকটি বিধাসভা এলাকায় তৃণমূলের ঘাঁটিতে থাবা বসিয়েছে সিপিএম। জয়নগর, কুলতলি, রায়দিঘি, ডায়মন্ড হারবার এলাকায় এসইউসি, তৃণমূলও বামফ্রন্টের কাছে ধরশায়ী। এ বারে নির্বাচনে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় খাতা খুলেছে সিদ্দিকুল্লার ইউডিএফও। ৫টি আসন পেয়েছে তারা। |
উল্টো দিকে, গত বিধানসভা ভোটে ভাঙড়, ক্যানিং ও বাসন্তী বিধানসভা এলাকার পঞ্চায়েতগুলি বামফ্রন্টের দখলে থাকলেও এ বার তা শাসক দলের দখলে চলে গিয়েছে। ভাঙড়-২ ও ক্যানিং-২ ব্লকের অধিকাংশ পঞ্চায়েতে শাসক দল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে। ক্যানিং পূর্ব বিধানসভার বিধায়ক রেজ্জাক মোল্লার বাড়ির বাকড়ি বুথে ৮ ভোটে জয়ী হয়েছে তৃণমূল। রেজ্জাক মোল্লার কথায়, “গণনার সময়ে কোনও এজেন্ট থাকতে পারেনি। ওরা শাসানি দিয়ে ভাগিয়ে দিয়েছিল।”
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সিপিএমের সম্পাদক সুজন চক্রবর্তী বলেন, “যে সব এলাকায় ভোট হয়েছে, সেখানে মানুষ বামফ্রন্টকেই ভোট দিয়েছেন। সাধারণ মানুষ অধিকাংশ জায়গায় ভোট দিতে পারেননি। অবাধ নির্বাচন হলে শাসকদলকে দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হতো।”
সিপিএমের জেলা সম্পাদকের ব্যাখ্যা মানতে নারাজ জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান তথা কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “তৃণমূল পরিচালিত জেলা পরিষদ ও পঞ্চায়েতের উন্নয়নমূলক কাজের নিরিখেই মানুষ আমাদের পুনর্নির্বাচিত করেছেন। তা এই ফলাফলেই প্রমাণিত।” পাশাপাশি, বিজেপি এবং এসইউসি তাঁদের কিছু ভোট কেটেছে বলেও মেনে নিয়েছেন তিনি। সন্ত্রাসের অভিযোগ অবশ্য মানেননি শোভনবাবু।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় ২০০৮ সালে গ্রাম পঞ্চায়েতে বামেদের কার্যত দুরমুশ করেছিল তৃণমূল। এ বার সেই চিত্র বদলেছে কিছু ক্ষেত্রে। গতবার ১৩৪টি আসনে জয়ী হয়েছিল বাম বিরোধীরা। এ বার ৯৯টিতে একক ভাবে জয়ী হয়েছে তৃণমূল। ৩৯টি পঞ্চায়েত অবশ্য এখনও ত্রিশঙ্কু।
|
সহ প্রতিবেদন: অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য |