পাঁচ বছর আগে এমনই এক দিন বুঝিয়ে দিয়েছিল পরিস্থিতি পাল্টাতে চলেছে। সেই ঝোড়ো হাওয়াই ২০১১ সালে ঝড় হয়ে এসে রাজ্য তোলপাড় করে বামফ্রন্ট তথা সিপিএম সরকারকে উপড়ে দিয়েছিল। আর তার দু’বছর পরে এই পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফল বুঝিয়ে দিল অন্তত গ্রামবাংলার মানুষ এখনও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিই আস্থা ধরে রেখেছেন।
বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার জঙ্গলমহল তো বটেই, জেলার অন্য এলাকা থেকেও সিপিএমের হাত থেকে এ বার গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষমতা কেড়ে নিল তৃণমূল। অন্তত সোমবার রাত পর্যন্ত প্রাপ্ত গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরের ফলাফলে তেমনটাই দেখা গেল। এখনও বাকি রয়েছে পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদগুলির ফলপ্রকাশ।
নজিরবিহীন ভাবে এ বারেই দুই জেলায় পঞ্চায়েতে ‘সার্বিক ঐক্য’ হয়েছিল বামদলগুলির মধ্যে। কিন্তু তাতেও বুঝি গড় রক্ষা হল না। গ্রাম পঞ্চায়েতের ফলাফলে স্পষ্ট পুরুলিয়া জেলার ২০টি ব্লকের দখলে থাকা পঞ্চায়েতগুলিতে ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যর্থ বামেরা। তার হাতেগরম উদাহরণ কাশীপুর ব্লক। এখানে ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১২টিতে একক ভাবে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল। একই চিত্র রঘুনাথপুর ১ ব্লকে। এখানেও ছ’টির মধ্যে পাঁচটিতে ক্ষমতা দখল করেছে তৃণমূল। শাসক দল তৃণমূলের পুরুলিয়া প্রতি আস্থা রাখেন। রাজ্যে উন্নয়নের জোয়ার দেখে তাঁর ফের আস্থা রাখলেন।” |
চলছে গণনা। বাইরে উৎসুক মুখ। বিষ্ণুপুরে সোমবার। ছবি: শুভ্র মিত্র। |
রাজ্যের অন্য এলাকায় থেকে ব্যতিক্রম ভাবে এখানে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ বামেরা করেনি। জেলার ১৭০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৯৪৪টি আসনের মধ্যে মাত্র দু’টি বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জিতেছিল তৃণমূল ও ফব প্রার্থী। গভীর রাত পর্যন্ত ভোটদান চলে। ভোট পড়েছিল ৮৭.২০ শতাংশ। রাত পর্যন্ত পাওয়া ফলে স্পষ্ট রায় গিয়েছে শাসক দলের পক্ষেই।
পুরুলিয়ার এক মাত্র রঘুনাথপুর ২ ব্লকে তুলনামূলক ভাবে কিছুটা মুখ রক্ষা হয়েছে সিপিএমের। বাকি হুড়া, পুরুলিয়া ১ ও ২ ব্লক, মানবাজার, সাঁতুড়ি, নিতুড়িয়া, ঝালদা ১-এর মতো সিপিএমের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকায় গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করে রাত পর্যন্ত জানা গিয়েছে পঞ্চায়েত সমিতিও দখলের পথে তৃণমূল। সিপিএমের প্রাক্তন জেলা সম্পাদক নকুল মাহাতোর খাসতালুক বলে পরিচিত পুঞ্চা ব্লকে তৃণমূলের সাফল্য এসেছে।
রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, রঘুনাথপুর ২ ব্লকে সিপিএম ভালো ফল করছে তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর বদান্যতায়। এখানে দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধেই নির্দল হয়ে দাঁড়িয়েছিল তৃণমূল বিক্ষুব্ধরা। পাশাপাশি সিপিএমের মতোই ধরাশায়ী হয়েছে কংগ্রেসও। বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের সঙ্গে জোট করে পাড়া বিধানসভা দখল করেছিল কংগ্রেস। ওই এলাকার দু’টি পঞ্চায়েত সমিতি পাড়া ও রঘুনাথপুর ২ ব্লকে একক ভাবে পঞ্চায়েত দখল করা দূরঅস্ৎ, ২১৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতের আসনের মধ্যে মাত্র ১৪টি আসন পেয়েছে কংগ্রেস। একই চিত্র কাশীপুরেও। গ্রাম পঞ্চায়েতগুলির ১৩৮টি আসনের মধ্যে তারা মাত্র একটি আসন পেয়েছে। একই ভাবে রঘুনাথপুর ১ ব্লকের নতুনডি এলাকাতেও শিল্পায়নের ইস্যু ফ্যাক্টর হয়নি তৃণমূলের জয়ে। এই গ্রাম পঞ্চায়েতে ক্ষমতা হারিয়েছে সিপিএম। ১২টি আসনের মধ্যে ১০টিতেই বড় ব্যাবধানে জিতেছে শাসকদল। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা সাংসদ বাসুদেব আচারিয়ার দাবি, “এই ফল প্রত্যাশিত ছিল না। কেন এই ফল হল, তা আমরা দলীয় ভাবে পর্যালোচনা করব।”
ধাক্কা লেগেছে সিপিএমের বাঁকুড়ার ঘাঁটিতেও। পাঁচ বছর আগে বামফ্রন্ট বাঁকুড়ার ১৯০টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ১৩৮টি পেয়েছিল। এ বার তারা নেমে গেল ২৯টিতে। তৃণমূল পেয়ে গেল ১৩৪টি পঞ্চায়েত। সিপিএমের জেলা সম্পাদক অমিয় পাত্রের খাসতালুক তালড্যাংরা তো বটেই চরম দুর্দিনেও বামেদের পাশে থাকা জেলার জঙ্গলমহলের মানুষও কার্যত মুখ ফেরালেন বামেদের থেকে। সিপিএমের জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর এক সদস্য মন্তব্য করেন, “বামফ্রন্টের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু নিজে ছাতনা ও বড়জোড়ায় কর্মিসভায় মানুষের কাছে গিয়ে অতীতের কাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলে গিয়েছিলেন। কিন্তু মানুশ যে এখনও আমাদের ক্ষমা করছেন না, তা প্রমাণ হল। আমাদের আরও নরম হয়ে মানুষের কাছে যেতে হবে।”
সিপিএমের খাসতালুক তালড্যাংরায় ন’টি পঞ্চায়েতই হাতছাড়া হল। যেখানে জেলায় গতবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে ২০৯ জন বাম প্রার্থী বিনা লড়াইয়ে জয়লাভ করেছিল, সেখানে এ বার সেই পাত্রসায়র, কোতুলপুর, জয়পুরে গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিতে একটিও প্রার্থী দিতে পারেনি বামেরা। জেলা পরিষদ স্তরে প্রার্থী দিতে পারলেও এই তিনটি ব্লকেই জিতেছে তৃণমূলের জেলা পরিষদের প্রার্থীরা। লড়াই করেও সারেঙ্গা পঞ্চায়েত সমিতিতে ব্যর্থ সিপিএম। সেখানে ১৮টি আসনের মধ্যে একটি মাত্র আসন পেল বামেরা। বাকি সবকটি আসনই পেল তৃণমূল। হাতছাড়া হল ইন্দাস পঞ্চায়েত সমিতিও। এই হারের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সিপিএমের জেলা সম্পাদক অমিয় পাত্রের বক্তব্য, “সন্ত্রাস একটা বড় কারণ এই ফলাফলের।” তৃণমূল টাকা ঢেলে ভোট করিয়েছে বলেও তাঁর অভিযোগ। তবে তৃণমূলের জেলা কো চেয়ারম্যান অরূপ চক্রবর্তীরা পাল্টা দাবি, “মানুষের মনে এখন শুধুই তৃণমূল। সিপিএম টাকা ছড়িয়েও তা কিনতে পারবে না।” |