|
|
|
|
ঘাসফুলেই আস্থা, বিপন্ন বাম |
মানুষের মন বুঝতে ব্যর্থ, বলছেন সিপিএম নেতৃত্ব |
নিজস্ব সংবাদদাতা • মেদিনীপুর |
নির্বাচনের ফলে দিশাহারা সিপিএম। একদা ‘লালদুর্গ’ পশ্চিম মেদিনীপুরে পঞ্চায়েতে পরাজয়ের ব্যাখ্যাও মিলছে না। সিপিএমের জেলা সম্পাদক দীপক সরকার বলছেন, “জনগণ তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন। আগামী পাঁচ বছর পশ্চিম মেদিনীপুরের পঞ্চায়েত তৃণমূল পরিচালনা করবে। শাসক দলের ইতিবাচক পদক্ষেপকে বামফ্রন্ট সমর্থন করবে।” কেন এই হার? দীপকবাবুর জবাব, “বুথ ভিত্তিক পর্যালোচনা হবে। তখন ব্যাখ্যা মিলবে।” যদিও জেলা সম্পাদকের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সিপিএমের এক নেতা মানছেন, “যাঁরা আমাদের ছেড়ে গিয়েছেন, তাঁদের সকলকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। এই নির্বাচনেও আমরা মানুষের মন বুঝতে পারিনি! এই ফল অপ্রত্যাশিত।” তৃণমূল অবশ্য মানুষের মন বুঝতে পেরেছে। দলের জেলা সভাপতি দীনেন রায় তাই দলের অন্দরে ফলপ্রকাশের আগেই বলেছিলেন, “চিন্তার কিছু নেই। পঞ্চায়েতে দলের জয় শুধুই সময়ের অপেক্ষা।” আর ফল বেরোনোর পর তাঁর মন্তব্য, “মানুষের উপর আমাদের বিশ্বাস ছিল। মানুষ দু’হাত ভরে আমাদের ভোট দিয়েছেন।” দায়িত্ব কি আরও বেড়ে গেল না? তৃণমূলের জেলা সভাপতি বলছেন, “অবশ্যই বাড়ল। আমাদের ভাল ভাবে কাজ করতে হবে। মানুষ আমাদের নজরে রাখবেন।” |
|
জয়োল্লাস। মেদিনীপুরের পঞ্চুরচকে আবির খেলায় মেতেছেন তৃণমূল সমর্থকরা। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল। |
পাশের জেলা পূর্ব মেদিনীপুরে ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনেই পরিবর্তনের হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যায় সিপিএম। পশ্চিমের ‘লালদুর্গে’ তখন ফাটল ধরেছিল সামান্যই। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে অবশ্য এখানে পালাবদলের ঝোড়ো পাওয়া আছড়ে পড়ে। এ বার পঞ্চায়েতে পরিবর্তনের সেই বৃত্তটাই সম্পূর্ণ হল। খড়কুটোর মতো উড়ে গেল সিপিএম। লালগড়ের জেলায় এই নির্বাচনটা শাসক-বিরোধী দু’দলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এরপর লোকসভা নির্বাচন। তৃণমূলের লক্ষ্য ছিল, লোকসভার আগে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত দখল করে পশ্চিমে পরিবর্তন পরিপূর্ণ করা। আর সিপিএমের লক্ষ্য ছিল, বিভিন্ন এলাকায় সংগঠনের নড়ে যাওয়া ভীত ফের মজবুত করা। যাতে লোকসভা ভোটের আগে দল কিছুটা ভাল জায়গায় থাকে। তবে লক্ষ্যপূরণে সিপিএমকে টেক্কা দিল তৃণমূলই। অথচ, ফল যে এমন হতে যাচ্ছে, তার পূর্বাভাস ছিল না প্রধান বিরোধী দলের কাছে। নির্বাচনের পর দলীয় স্তরে প্রাথমিক যে পর্যালোচনা হয়েছিল, তাতে উঠে এসেছিল, ঝাড়গ্রাম মহকুমায় বামফ্রন্টের ফল তুলনায় ভাল হবে। তারপর খড়্গপুর মহকুমায়। কিন্তু, ভোটের ফল বলছে, পুরো জেলায় সিপিএমকে দূরবীন দিয়ে খোঁজার মতো অবস্থা। একের পর এক নক্ষত্রের পতন হয়েছে। প্রাক্তন মন্ত্রী তথা রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের নির্বাচনী এলাকায় ঘাসফুলের জয়জয়কার। ১৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১৩টি তৃণমূলের দখলে। ২টি বামেদের। ১টিতে টাই হয়েছে। অথচ, পাঁচ বছর আগে ১৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতই ছিল বামেদের দখলে। মাত্র ১টিতে ক্ষমতায় ছিল তৃণমূল। আরেক প্রাক্তন মন্ত্রী তথা বিধায়ক সুশান্ত ঘোষের নির্বাচনী এলাকা গড়বেতায় অবশ্য ভোটের আগেই হেরে বসেছিল সিপিএম। গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৬২টি আসনের মধ্যে একটিতেও তাদের প্রার্থী ছিল না। জেলা পরিষদে ৩ জন এবং পঞ্চায়েত সমিতিতে ৩ জন প্রার্থী ছিল। গড়বেতায় তাই শাসক দলেরই রমরমা। গড়বেতা- ১ এর ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে সবক’টি, গড়বেতা- ২ এর ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে সবক’টি, গড়বেতা-৩ ব্লকের ৮টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে সবক’টিই তৃণমূলের দখলে। একই ভাবে একদা ‘লালদুর্গ’ বলে পরিচিত কেশপুরেও সিপিএমের পায়ের তলায় মাটি নেই। কেশপুরে গ্রাম পঞ্চায়েতের ২৩০টি আসনের মধ্যে সিপিএমের প্রার্থী ছিল মাত্র ২টি আসনে। পঞ্চায়েত সমিতির ১টি এবং জেলা পরিষদের ৩টি আসনে। তবে নির্দল প্রার্থী থাকায় ভোট হয়েছে গ্রাম পঞ্চায়েতের ২৯টি আসনে, পঞ্চায়েত সমিতির ১০টি আসনে। এরমধ্যে গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূল পেয়েছে ২২টি আসন। এবং পঞ্চায়েত সমিতিতে ৮টি আসন। বিদায়ী সভাধিপতি অন্তরা ভট্টাচার্যের পিংলাতেও সিপিএমকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পিংলার ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১০টিই দখল করেছে তৃণমূল।
মোহনপুর ব্লকের পাঁচটি পঞ্চায়েত আসনই এবার বামেদের হাতছাড়া হল। এবার মোহনপুরের ৫টি পঞ্চায়েতের মধ্যে শিয়ালসাই পঞ্চায়েতের মাত্র একটি আসনে জিতেছে বামেরা। দাঁতন ১ ব্লকের তৃণমূল গতবারের শুধুমাত্র তররুই পঞ্চায়েত তৃণমূলের দখলে ছিল। এবার ৯টি পঞ্চায়েতবিশিষ্ট দাঁতন ১ ব্লকের ৮টি পঞ্চায়েত নিজেদের দখলে নিল তৃণমূল। দাসপুর ১ ব্লকের ১০টি পঞায়েতেই তৃণমূল জিতেছে। তবে ওই ব্লকের বাসুদেবপুর পঞ্চায়েতের উপপ্রধান কাজল সামন্ত ও পাঁচবেড়িয়া পঞ্চায়েতের উপপ্রধান সদানন্দ সামন্ত হেরে গিয়েছেন। এর পিছনে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকেই দায়ী করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। দাসপুর ২ ব্লকের মোট ১৪ টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ২০০৮ সালে তৃণমূল ১১টি ও বামেরা ৩টি পঞ্চায়েতে জিতেছিল। তবে তৃণমূল এবারে ৯টি পঞ্চায়েত দখল করেছে। রানিচক, খেপুত, খুকুড়দহ পঞ্চায়েত তৃণমূলের হাতচাড়া হয়েছে। নিশ্চিন্দিপুর ও চাঁইপাট পঞ্চায়েত ত্রিশঙ্কু হয়েছে। সোমবার সকাল থেকে সিপিএম-তৃণমূল, দু’দলের জেলা অফিসেই ব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। নেতা-কর্মীরা খাতা-পেন নিয়ে বসে পড়েছিলেন। মেদিনীপুরের ফেডারেশন হলে অস্থায়ী কার্যালয়ে সাতসকালে চলে আসেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেন রায়, কার্যকরী সভাপতি প্রদ্যোত্ ঘোষেরা। গণনা কেন্দ্র থেকে একের পর এক খবর আসতে থাকে। বেলা যত বেড়েছে, ভীড়ও তত বেড়েছে। দুপুরে ফেডারেশন হলের সামনে আবির খেলাও হয়। আনন্দে মাতেন দলের কর্মী- সমর্থকেরা। অন্য ছবি চোখে পড়েছে সিপিএমের জেলা কার্যালয়ে। সকালেই এখানে চলে আসেন দলের জেলা সম্পাদক দীপক সরকার। শুরুর দিকে নেতা- কর্মীদের মধ্যে ফলাফল জানার আগ্রহও ছিল। তবে বেলা যত গড়িয়েছে, সেই আগ্রহ তত কমেছে। নেতা-কর্মীরা বুঝেছেন, এ বার আর পঞ্চায়েতের ক্ষমতা দখল করা সম্ভব নয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিশ্রুতির উপরই আস্থা রাখছেন জেলাবাসী। জেলার বিভিন্ন গণনা কেন্দ্রগুলোর সামনে সিপিএম যে তাঁবু তৈরি করেছিল, দুপুর থেকে সেখানেও দলের কর্মী- সমর্থকদের সংখ্যা কমতে থাকে। জেতার আশা যে নেই, তাঁরা জানতে। তবে এত খারাপ ফল আশা করেননি। |
|
|
|
|
|