কী বলবে ভোটের ফল? কোন এলাকায় কোন নেতার কতটা দাপট, বিরোধীরা জমি ফিরে পেল কি না,
এই সব। কিন্তু গ্রামের রাস্তা, আলো, পানীয় জল? সে সব বিষয়ে কিছু জানা গেল কি?
স্বাতী ভট্টাচার্য ও সোমেশ ভট্টাচার্য |
প্রায় সাড়ে চারশো কোটি টাকা খরচ করে শেষ হল পঞ্চায়েত ভোট। ওই টাকায় এক লক্ষ গৃহহীনের বাড়ি তৈরি হতে পারত। প্রায় সাড়ে ন’লক্ষ বৃদ্ধবৃদ্ধা ভাতা পেতে পারতেন এক বছর ধরে। একশো দিনের কাজের প্রকল্পে প্রায় সওয়া তিন কোটি শ্রমদিবস তৈরি করা যেত।
মনে হতে পারে, এ কেমন হিসেব? গণতান্ত্রিক দেশ, ভোট তো হবেই। খরচের কথা ভেবে ভোট থামালে চলে না।
ঠিক কথা। কিন্তু কী বলবে ভোটের ফল? কোন এলাকায় কোন নেতার কতটা দাপট। বিরোধীরা জমি ফিরে পেল কি না। বিক্ষুব্ধ নির্দলরা কতটা বেকায়দায় ফেলতে পারল বড় দলকে। লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস-তৃণমূল গাঁটছড়ার সম্ভাবনা কত জোরালো।
কিন্তু গ্রামের রাস্তা, আলো, পানীয় জল আরও ভাল হয়েছে, কি মন্দ হয়েছে আগের চাইতেও, সে বিষয়ে কিছু জানা যায় কি? বোঝার কি কোনও উপায় আছে, নদীর বাঁধ বন্যার আশঙ্কা কমাচ্ছে কি না, টম্যাটো কিংবা আলু খেতেই না-পচে কারখানায় সস বা চিপ্স হচ্ছে কি না, শিশু শিক্ষা কেন্দ্রগুলির উন্নতি হল কি না? যে কথাগুলো গ্রামের লোকের কাছে সবচেয়ে জরুরি, তার জেলাওয়াড়ি, রাজ্যওয়াড়ি খতিয়ান কোথাও নেই। ভোটের প্রচারে আসে না। তা মিডিয়ার ভোট-সংবাদেও আসে না। গ্রাম সংসদ, গ্রাম সভার বৈঠক নামেমাত্র হয়, হলেও সেখানে অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করা হয় না বললেই চলে। |
কাজের কথা। ২০০৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত |
অথচ কীসে কত টাকা খরচ হল, তার উপরেই তো ভোট দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল। গ্রামের জন্য বরাদ্দ টাকা গ্রামের মানুষের কতটা কাজে লাগল, আদৌ তাদের জন্য খরচ হল কি না, সেই প্রশ্নই তো পঞ্চায়েত ভোটের প্রধান প্রশ্ন। তার উত্তর না জেনেই ভোটের লাইনে যদি দাঁড়াতে হয়, তা কি গণতান্ত্রিক নির্বাচন বলা চলে?
কেবল গ্রামের মানুষই নয়, কোথায় কত টাকা যাচ্ছে তা জানেন না পণ্ডিতরাও। সে দিন চতুর্থ রাজ্য অর্থ কমিশনের এক বৈঠকে দেখা গেল, গ্রামে রাস্তা বা বিদ্যু্তের জন্য কোথায় কত প্রকল্প রয়েছে, কেন্দ্র বা রাজ্য কে কত টাকা বরাদ্দ করছে, কে খরচ করছে, কাকে হিসেব পাঠাচ্ছে, তার খেই পাচ্ছেন না অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা। এক একটা বিষয়ে একশোটারও বেশি প্রকল্প রয়েছে। অনেকগুলিরই হিসেব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
অগত্যা হাতের কাছে যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে, তা দিয়েই দেখার একটা চেষ্টা করার দরকার। আনন্দবাজার পত্রিকার জেলা সংস্করণগুলিতে ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরা হয়েছিল জেলা পরিষদের কাজ। প্রতিটি জেলা পরিষদের ‘খরচের খতিয়ান’ বলছে, প্রধান প্রকল্পগুলিতে কত খরচ হয়েছে, কতগুলি খাতে গোটা বছরে এক টাকাও খরচ হয়নি। সূত্র পঞ্চায়েত দফতরের ওয়েবসাইট। সেই সঙ্গে, জেলা পরিষদগুলি তাদের নিয়মিত কার্যাবলি করেছে কি না (বৈঠক, রিপোর্ট পেশ, তথ্য সংগ্রহ), তা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে জেলা পরিষদের ‘রিপোর্ট কার্ড।’ তার তথ্যসূত্র জেলা পরিষদ সচিবালয় (সম্পূর্ণ রিপোর্ট পাওয়া যাবে: 30panchayet-vote.html)।
কেন জেলা পরিষদ? এ বার ভোট-যুদ্ধে জেলা পরিষদ দখল করাই পাখির চোখ, তা একান্তে স্বীকার করেছে সব ক’টি প্রধান দল। আর একটি কারণ প্রশাসনিক। গ্রাম পঞ্চায়েত উন্নয়নের বরাদ্দের সর্বাধিক ভাগ পায় ঠিকই, তবু প্রায়ই বলা হয় যে, অদক্ষ কর্মী, অনভিজ্ঞ প্রধান, সময়মত টাকা না পাওয়া, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পরিকাঠামোগত নানা সমস্যায় তারা টাকা খরচ করে উঠতে পারে না। কিন্তু জেলা পরিষদের সভাধিপতির মর্যাদা ক্যাবিনেট মন্ত্রীর সমান। যথেষ্ট অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মী নিয়ে তাঁর কার্যালয়। তিনি কাজ করতে পারবেন না কেন?
বরাদ্দ টাকা খরচ করতে না-পারা প্রশাসনিক ব্যর্থতার একটি বড় দিক। গত আর্থিক বর্ষে ১৭টি জেলা পরিষদ গড়ে বরাদ্দের ৭২ শতাংশ খরচ করতে পেরেছে। ৯টি জেলা ৩০ শতাংশেরও বেশি টাকা সারা বছর ফেলে রাখছে, এক একটি জেলায় যা কমবেশি ১০০ থেকে ১২০ কোটি। আরও উদ্বেগের ব্যাপার হল, গরিব জেলাগুলিতেই খরচের হার কম। কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, পুরুলিয়ার মতো জেলা, যেখানে দারিদ্র তীব্র, পরিকাঠামো বেহাল, সেখানে কেন বছরের পর বছর বরাদ্দ টাকা জেলা পরিষদেই পড়ে থাকছে? মহাকরণে দলবদলের পর বিরোধী জেলা পরিষদ সমস্যায় পড়ছে। এই আপত্তি পুরোপুরি মেনে নেওয়া যাচ্ছে না, কারণ সর্বাধিক টাকা খরচ করেছে বীরভূম (৮৪%), তার পর হুগলি, হাওড়া, বর্ধমান। এই জেলাগুলো বাম আমলেও ভাল টাকা খরচ করত, এখনও করছে। তাই দেখা জরুরি, পিছিয়ে-পড়া জেলাগুলোয় রাজনৈতিক বিরোধিতার চেয়ে প্রশাসনিক দুর্বলতার ধারাবাহিকতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ কি না।
জেলা পরিষদের হিসেবের দিকে তাকালে আন্দাজ করা যায়, প্রকল্পের টাকা লুট করার ইচ্ছেকে ছাপিয়ে যাচ্ছে কিছু না করতে দেওয়ার ইচ্ছে। পিছিয়ে-পড়া এলাকার উন্নয়নের জন্য যে বিপুল টাকা আসছে দরিদ্র জেলাগুলিতে, বি আর জি এফ-এর সেই টাকার প্রায় অর্ধেক খরচ করেনি বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর। উত্তর ২৪ পরগনা খরচ করেছে মাত্র ২২ শতাংশ। অথচ এই টাকায় রাস্তা-জল-বিদ্যুৎ প্রভৃতি যে কোনও কাজ করা চলে। পুরুলিয়ায় ১৪৪টি রাস্তা তৈরির জন্য ২৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। বার বার টেন্ডার ডাকার পর মাত্র ৬০টি রাস্তা তৈরি শুরু করা গিয়েছে। নদিয়া প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার রাস্তা তৈরি করেছে দু’বছরে ১১৯ কিমি।
মানুষের জন্য মানুষের সরকার, গণতন্ত্রের এই গোড়ার ধারণাকে মূর্ত করতে চেয়েছিল পঞ্চায়েত। আজ তার কাজ যেন নিষ্প্রাণ নিয়মরক্ষা। প্রকল্পের লক্ষ্যই যেন সব, মানুষের অভাব-বিপন্নতা বড় কথা নয়। না হলে বর্ধমানে, যেখানে গত বছরটা জুড়ে চাষিরা ন্যায্যমূল্যে ধান বিক্রি করতে না-পারার জন্য আন্দোলন করলেন, সেখানে কী করে জেলা পরিষদে পড়ে থাকল ধান কেনার সাড়ে ছয় কোটি টাকা? মুর্শিদাবাদে বি আর জি এফ-এর অর্ধেকের বেশি টাকা পড়ে, রয়েছে নিজস্ব তহবিলের ৪৫ লক্ষ টাকা। অথচ একশোরও বেশি গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। সেচ পাম্পে বিদ্যুতের অভাবে মার খাচ্ছে বোরো চাষ। উত্তর দিনাজপুরের ৯৮টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৩৫টি পানীয় জলের অভাবে জেরবার। বারবার পঞ্চায়েত অফিসে ধর্না দিচ্ছেন ইসলামপুরের নানা গ্রামের বাসিন্দারা। অথচ ‘রুরাল ওয়াটার সাপ্লাই’ প্রকল্পে পড়ে রয়েছে ৬৮ লক্ষ টাকা।
নিজস্ব তহবিল খরচ দেখলেই জেলা পরিষদের উদ্যোগের একটা ছবি মেলে। এ টাকা যেমন ইচ্ছে খরচ করা যায়। অথচ গড়ে প্রায় অর্ধেক টাকা পড়ে থাকছে বছরজুড়ে। জঙ্গলমহলের জেলা বাঁকুড়া-পুরুলিয়াতেও মাত্র ১৭ শতাংশ খরচ হয়েছে, পশ্চিম মেদিনীপুরে ৩৯ শতাংশ। নদিয়া, উত্তর দিনাজপুরের অবস্থাও তথৈবচ।
পঞ্চায়েতের যে কোনও আলোচনায় দুর্নীতির অজস্র অভিযোগ। কিন্তু দুর্নীতি আটকাতে কী করেছেন বিরোধীরা? কাজে গতি আনতেই বা কী করেছেন? ভিজিল্যান্স অ্যান্ড মনিটরিং কমিটির সভাপতি বিরোধী সদস্য। বছরে অন্তত চারটি বৈঠক হওয়ার কথা। আটটি জেলায় দেখা যাচ্ছে, একটা কি দুটো মিটিং হয়েছে। জেলা সংসদে পরিকল্পনা পেশ করার কথা, তার বৈঠকও হয়নি বেশ কিছু জেলায়। জল, বিদ্যুৎ, পূর্ত প্রভৃতি বিষয়ে স্থায়ী কমিটিগুলোর মাসে একটা বৈঠকও হয় না। জেলা পরিষদের অধীনে কত রাস্তা রয়েছে তার তালিকা নেই বাঁকুড়া, উত্তর ২৪ পরগনা, বীরভূম-সহ অনেক জেলায়। কত রাস্তা সারানো দরকার, নেই তার তথ্যও। ‘স্বমূল্যায়ন’-এর ফর্ম ভরে পঞ্চায়েত দফতরকে পাঠানোর কথা জেলা পরিষদগুলির, যেখানে তারা নিজেদের এলাকার সমস্যা ও তার কারণ বিষয়ে পর্যালোচনা করবে। দু’-একটি জেলা ছাড়া কেউ তা পাঠাচ্ছে না।
কী করলে ছবিটা বদলাতে পারে? অনেকে বলছেন, মহাকরণে তৃণমূল আর জেলা পরিষদ, গ্রাম পঞ্চায়েতে বামফ্রন্ট, সমস্যা হচ্ছিল এ জন্যই, জেলাতেও ‘পরিবর্তন’ এলে উন্নয়নে গতি আসবে। কার্যত তা কতটা সম্ভব, বিরোধী জেলা পরিষদে উন্নয়ন আটকেই থাকবে কি না, সেটা একটা প্রশ্ন। কিন্তু মূল প্রশ্ন আরও গভীরে।
বিরোধীদের যোগদানকে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার কার্যকারিতা, স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতার শর্ত হিসেবে দেখেছিলেন পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠানের রূপকাররা। গ্রাম উন্নয়ন সমিতি থেকে জেলা পরিষদ, সর্বত্র বিরোধীদেরই উন্নয়নের চালক শক্তি বলে দেখা হয়েছে। ধরে নেওয়া হয়েছে, পঞ্চায়েতের উপর নজরদারি, উন্নয়নের পরিকল্পনা তৈরি, পঞ্চায়েত ও গ্রামবাসীর মধ্যে সংযোগ বিরোধীরাই করবেন। গ্রামে গিয়ে কথা বললেও বোঝা যায়, যে কোনও সরকারি প্রকল্প গ্রামে রূপায়ণে যে ঝুঁকি, প্রধান তা বিরোধী সদস্যদের সঙ্গে রেখে ভাগ করে নিতে চান।
আজ একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিরোধীদের বাদ দিয়ে কাজ করতে পারে না পঞ্চায়েত। আর বিরোধীদের নিয়ে কাজ করতে পারে না রাজনীতি। তাই রাজনীতিকে বার বার আটকে দিতে হচ্ছে পঞ্চায়েতের কাজ। পাঁচ বছর অন্তর ভোটের ভাগ বদলে যাবে, গরিবের প্রাপ্তির ভাগ বদলাবে না, সেই ভেবেই গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে অপচয় মনে হয়। |