শ্রীলঙ্কার সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী রদ করার জন্য প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপক্ষের সরকার তৎপর। এই প্রয়াস ভারতকে উদ্বিগ্ন করিতেছে। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম জয়ললিতা তাঁহার উদ্বেগের কথা প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকেও জানাইয়াছেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁহাকে আশ্বস্ত করিয়াছেন যে, নয়াদিল্লির অবস্থান এই প্রশ্নে অপরিবর্তিত, কিন্তু এই আশ্বাস বিশেষ ভরসা জাগায় না। কেননা শ্রীলঙ্কার উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের তামিলদের স্বায়ত্তশাসন দিবার যে প্রস্তাব ওই ত্রয়োদশ সংশোধনীতে আছে, রাজাপক্ষের সরকার তাহা রদ করিয়া দিলে দ্বীপরাষ্ট্রের তামিলদের ন্যায়বিচার ও মৌলিক নাগরিক অধিকার পাওয়ার সম্ভাবনা নস্যাৎ হইয়া যাইবে।
এলটিটিই-কে নির্মূল করার পরও ভবিষ্যতে তামিলরা যাহাতে কখনও সমানাধিকার দাবির সাহস না দেখান, রাজাপক্ষে সেই লক্ষ্যেই সংবিধান পাল্টাইয়া দিতে উদ্যত। তামিল-অধ্যুষিত প্রদেশগুলি সংযুক্ত করিয়া স্বশাসন মঞ্জুর করার যে বিধান ওই সংশোধনীতে আছে, তাহা রদ করিলে তামিলদের সাংবিধানিক রক্ষাকবচ কাড়িয়া লওয়া যাইবে। অথচ ভারতীয় সেনাবাহিনীকে যখন ১৯৮৭ সালে তামিল গেরিলাদের দমন করিয়া উপদ্রুত প্রদেশগুলিতে শান্তিপ্রতিষ্ঠায় আমন্ত্রণ করা হয়, তখন শ্রীলঙ্কা সংবিধানের এই সংশোধনী দেখাইয়াই শ্রীলঙ্কা সরকার দ্বীপরাষ্ট্রের জাতিসমস্যা মীমাংসায় সদিচ্ছা জানাইয়াছিল। রাজাপক্ষের পূর্বসূরিরাও তামিলদের স্বায়ত্তশাসন মঞ্জুর করিতে প্রস্তুত ছিলেন। বিরোধ ছিল কেবল স্বশাসনের বিস্তৃতি লইয়া। কিন্তু রাজাপক্ষে ও তাঁহার সিংহলি উগ্র জাতীয়তাবাদ তামিল জাতিসত্তার স্বনিয়ন্ত্রণের দাবিকে রাষ্ট্রীয় সংহতি ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদের সমার্থক বলিয়া গণ্য করে। স্বশাসনের অভাবই শিক্ষিত তামিল যুবকদের মনে ‘ইলম’-এর স্বপ্ন জাগাইয়াছিল এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসের পথ অবলম্বনে বাধ্য করিয়াছিল। রাজাপক্ষে তাহা মানিতে নারাজ।
তাই তামিলপ্রধান উত্তরের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিয়া বা উত্তরাঞ্চলে মোতায়েন সৈন্যদের সংখ্যাহ্রাসের কথা ঘোষণা করিয়া রাজাপক্ষে তাঁহার সরকারের যে সহিষ্ণু ও গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি প্রচার করিতে চাহিতেছেন, তাহা সফল হইবে না। তাঁহার এমন একটি আবহ দরকার, যাহাতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের বুঝাইতে পারেন, নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় কমনওয়েল্থ শীর্ষ সম্মেলনের স্থান হিসাবে কলম্বো একটি উপযুক্ত মঞ্চ। গৃহযুদ্ধ সাঙ্গ হওয়ার তিন বছর পরেও তামিলদের প্রতি একই রকম বৈষম্য অনুশীলন করিয়া চলা এবং তাঁহাদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনে উদাসীন তাঁহার সরকার যে রাষ্ট্রপুঞ্জ সহ প্রায় সব মানবাধিকার রক্ষা আন্দোলনের ধিক্কারে নিন্দিত, ইহা অকারণ নয়। এই অবস্থায় কমনওয়েল্থ সম্মেলন আয়োজন করিয়া নিজ ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করায় রাজাপক্ষে বদ্ধপরিকর। কিন্তু তামিলদের প্রাপ্য নাগরিক ও সাংবিধানিক অধিকার হইতে বঞ্চিত করার এই উদ্যোগ তাঁহার গণতান্ত্রিকতার মুখোশ উন্মোচন করিয়া দিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ তাঁহার সরকারের অপরিবর্তিত অবস্থানের কথা বলিলেও রাজাপক্ষে তাহাতে দমিবার পাত্র নহেন। শ্রীলঙ্কা পাছে চিনের কোলে ঢলিয়া পড়ে, সে জন্য দিল্লির পক্ষে বেশি চাপ দেওয়াও কঠিন। রাজাপক্ষে এই সুযোগটিই লইতেছেন। |