প্রবন্ধ ২...
গৃহযুদ্ধ একমাত্র পথ নয়, অন্য উপায়ও আছে
শ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন শেষ। এখন ফল-শ্রুতির পর্ব। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছিলেন ‘ভাগ্যচক্রের পরিবর্তন’, তাতে কেউ হারবে, কেউ জিতবে, শাসক সম্প্রদায়ের পুরনো ব্যক্তিবর্গের সদস্যদেরও হয়তো পরিবর্তন হবে। কিন্তু কোন বাংলাকে পিছনে রেখে যাবে এই নির্বাচনমালা? হিংসা প্রতিহিংসার ছাপ সমাজের কত গভীরে পৌঁছবে? তিক্ততা এবং প্রতিশোধস্পৃহার রেশ কত বছর থাকবে? উত্তর আমরা জানি না। কিন্তু প্রশ্নগুলো তোলা দরকার।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই হিংসার প্রয়োজন হচ্ছে গণতন্ত্রকে সফল করার জন্য। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এক সময় এক একটা নির্বাচন স্তর পেরিয়ে বলতেন, এটা কোয়ার্টার ফাইনাল, এটা সেমিফাইনাল, এর পর ফাইনালে জিতব। বিধানসভা নির্বাচন হয়ে গেল। কিন্তু ফাইনাল খেলা হল না। পঞ্চায়েত, পুরসভা, লোকসভা, ফের বিধানসভা ভোট আসবে। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে বৈধতা অর্জনের আবশ্যিকতার শেষ নেই, বাঘের পিঠে চড়ার মতো শাসককে বার বার এই ভোটাচারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। বিরোধী দলগুলিকেও। লোকলস্কর লাগবে, অস্ত্র মজুত করতে হবে, প্রচার পরিকল্পনা ফাঁদতে হবে, গণমাধ্যম দখল করতে হবে, টাকাপয়সা লাগবে, রাজনৈতিক যন্ত্রকে বার বার ব্যবহার করতে হবে শাসক হওয়ার জন্য।
গণতন্ত্রের অনুশীলন। পঞ্চায়েত ভোট, নদিয়া। ২২ জুলাই, ২০১৩। ছবি: সুমন বল্লভ
এর সঙ্গে যুক্ত আছে আরও দুটো দিক। প্রথম হল, প্রশাসনিকতার এই ব্যাপক প্রসারের যুগে বিপুল পরিমাণ অর্থ এবং অন্যান্য সামগ্রীর উপর জনপ্রতিনিধিদের দখল এসেছে। গণতন্ত্রের প্রধান রূপে যেখানে প্রতিনিধি বাছাই করা অথবা নির্বাচিত করা, সেখানে ভোট হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রশাসন-কাঠামোর প্রতিটি স্তরে জনসম্পদ এবং জনবিত্তকে নিয়ন্ত্রণ করার চাবিকাঠি। অর্থ ছাড়া প্রশাসন সম্প্রসারণ হয় না। আর প্রশাসন সম্প্রসারণের জন্য প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের সম্প্রসারণ চাই। গ্রামে, মফস্সলে, শহরাঞ্চলে, সর্বত্র এই জনপ্রতিনিধিরা প্রশাসনিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণের অন্যতম দখলদার। আমলাদের সঙ্গে যুগলবন্দিতে এই ভাবে প্রশাসন চলে। এই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোও ক্রমশ প্রশাসনিকযন্ত্রে পরিণত হয়। হিংসা ছাড়া অন্য আর কী উপায় আছে, এই ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কুক্ষিগত করার? এর অর্থ এই নয় যে, এই পথে জনকল্যাণ হয় না। কিন্তু, জনকল্যাণ, প্রশাসনিকযন্ত্রে আত্মস্থ প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা এবং এই ধরনের সরকারি পোশাকে আর নিয়মে বাঁধা গ্রামীণ আত্মশাসন ব্যবস্থা এই তিনটের কোনওটার কোনওটাকে ছাড়া চলে না। হিংসা ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প পথ গণতন্ত্র রাখেনি। পশ্চিমবঙ্গে এই প্রক্রিয়া দীর্ঘ কাল ধরে বামফ্রন্ট শাসনে চলেছে। আজও এর ইতি টানার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
দ্বিতীয় দিক হল, এই হিংসা এবং হিংসার ক্রমপ্রসারমাণ ছায়া এত সর্বাত্মক যে, গণতন্ত্রে হিংসার ভূমিকার উপর নজর পড়তে বাধ্য। সমাজের যে অংশ এই হিংসালীলায় এত দিন হয়তো ছিল না, তারও কোনও রেহাই নেই। গণতন্ত্রের প্রসারে মহিলা, শিশু, উচ্চবর্ণ, বর্ণহীন, আদিবাসী, মধ্যবিত্ত ভদ্রজন সবাইকে শামিল হতে হবে। হিংসালীলায় কোনও না কোনও ভাবে যুক্ত হতে হবে। এরই এক চরম নাম হল গৃহযুদ্ধ। সর্বগ্রাসী গৃহযুদ্ধ।

সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধে শত্রুসংহার করে জয়লাভ করা হয়তো শাসকদের লক্ষ্য হতে পারে, কিন্তু মহাভারতের গৃহযুদ্ধ অবসানের পরও জয়ী পক্ষকে বলতে হয়েছিল, এ কোন বধ্যভূমিতে শান্তি ফিরে এল? বামফ্রন্ট সরকারের শাসনকালীন শান্তিও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কিন্তু অন্য এক পথও আছে শান্তি ফেরানোর, গৃহযুদ্ধে ইতি টানার। সে পথ হল আলোচনার পথ। সংলাপের পথ। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নতুন শাসনের সূচনাকালে তাঁর প্রতিশ্রুতি দেখিয়েছিলেন। তাঁর বেশ কিছু অভিনব উদ্যোগ নানা বাধায় স্থায়ী হয়নি। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের বাধ্যবাধকতায় সংলাপের পথ থেকে শাসকরা সরে গিয়েছেন। এতে সবার ক্ষতি।
এটা ঠিক যে, বিরোধীরা সংলাপী সংস্কৃতিতে সাড়া দেননি। কিন্তু, সংলাপের পথে অটল থাকলে, তাতে শাসকদের বৈধতা বাড়ত বই কমত না। জয়প্রকাশ নারায়ণ বলেছিলেন, জনপ্রতিনিধিত্ব সর্বস্ব গণতন্ত্রের ব্যবস্থা অসার। গণতন্ত্র এবং আত্মশাসনের প্রত্যক্ষ রূপের প্রবর্তন চাই। নানা উপায়ে, নানা পথে। সেই প্রত্যক্ষ এবং আশু গণতন্ত্রের সন্ধান এই গৃহযুদ্ধের কালে জরুরি।
যাঁরা দল চালান, তাঁরা হাসবেন, বলবেন এই প্রস্তাব অবাস্তব। সে তর্কের শেষ নেই। কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে যে হিংসালীলা আমরা দেখলাম, তার প্রেক্ষিতে নতুন করে ভাবনা শুরু করায় ক্ষতি কী? সমাজ এবং গণরাজনীতির চেয়ে দল বড় বলে মনে করার এবং দলের আদলে সমাজ গড়ার যে অহমিকা, তার পরিণাম তো পশ্চিমবঙ্গে আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এই পথে সমাজের উপর প্রশাসনিকতার নিগড় আরও কত শক্ত হচ্ছে, তার একটা দৃষ্টান্ত দিই। নির্বাচন হয়ে দাঁড়িয়েছে গণতন্ত্রের মাপকাঠি। ভোট হবে কী করে? তার জন্য স্থির করতে হবে কত পুলিশ চাই, কত সৈন্য চাই, কত ইস্কুল চাই রক্ষী-শিবির স্থাপন করার জন্য, কত ভোট কর্মী চাই, কত অর্থ চাই, কত দিন ধরে ভোট করা চাই, কত গাড়ি চাই, আরও কত কিছু স্থির করা চাই। এর ওপর নির্ভর করে আমরা গণতান্ত্রিক কি না। আনুষ্ঠানিক পরিভাষায় বলা চলে, এ হল নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের পরিকাঠামোগত দিক বা লজিস্টিক্স। নির্বাচনের আগে প্রচারমাধ্যম, নির্বাচন কমিশন, বিরোধী দল, সরকার পক্ষ, বিচার প্রতিষ্ঠান সবাই এই চর্চায় ব্যস্ত থেকেছেন। পুজোর চেয়ে আচারের প্রাধান্য পুজোর উদ্দেশ্যকে ছাপিয়ে গিয়েছে। এ এক প্রহসনে দাঁড়িয়েছে আমাদের গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোগত বাধ্যবাধকতা। পাঁচ দফার বদলে কেন সতেরো দফায় ভোট নয়, তা হলে তো ভোটাধিকার আরও নিশ্চিত হত! এও বলা যেতে পারে, এক জেলায় এক দিনেই বা ভোট কেন, দু’দিনে বা চার দিনে হোক! হিংসা থেকে যায় আচারের এই প্রাধান্যের মধ্যে।
কেন্দ্রীয় বাহিনী এসে কি গণতন্ত্র আরও নিশ্চিত হল? আরও শিশু, নারী, পুরুষ, লাঠি খেলে, গুলিতে মরলে, তেলের কড়াইয়ে ঝাঁপ দিলে কি আমরা বলতাম, গণতান্ত্রিক আচার আরও সততার সঙ্গে পালিত হল? এ সব নিয়ে বিশ্লেষকদের নীরবতা লক্ষণীয়।
পশ্চিমবঙ্গে গৃহযুদ্ধের এই যে কখনও তীব্র এবং কখনও ধিকি ধিকি জ্বলা এর মাঝে জনসাধারণ যে ভাবে বাঁচার, সে ভাবেই বাঁচছেন। শুধু ৭০-৭৫ শতাংশ ভোট পড়েছে প্রায় সর্বত্র, তা-ই নয়, এত সবের মধ্যেও ধীরে ধীরে গ্রামবাংলার রাজনৈতিক মানসে পরিবর্তন আসছে। হয়তো, এই হিংসাই হল তার সামাজিক মূল্য।
বহু নতুন লোক রাজনৈতিক প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবে। নারীদের অংশগ্রহণ বহু গুণে বাড়বে। সমাজের যে সব অংশ রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদার হয়নি, তারা আজ তাদের অধিকারের দাবি জানাচ্ছে। এক দিকে এতে হিংসা বাড়ছে, নানা উপদল সৃষ্টি হচ্ছে, একচ্ছত্র দলীয় আধিপত্যের অবসানের পর, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, বাংলায় আর সভ্যতাভব্যতা বলে কিছু রইল না। কাপালিকদের হাতে আমাদের ঐতিহ্য গেল। অন্য দিকে, এই যুদ্ধের মাঝে কৃষক সক্রিয়তা শেষ হয়ে যায়নি। নইলে লজিস্টিক্সের দৌরাত্ম্যে জনরাজনীতির অবসান ঘটত।

পশ্চিমবঙ্গের এই ‘বিহারায়ন’ প্রক্রিয়ার উল্লেখ কিছুটা অসংগত শোনালেও তার কিছু কাম্য দিক আছে। নাক-উঁচু বাঙালি গত চল্লিশ বছর ধরে বলেছে, আমরা শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে, আমরা সভ্য, পশ্চিমবঙ্গ বিহার নয়। জাত্যভিমানের অবসান আগেই ঘটা উচিত ছিল। যা-ই হোক, আর্থ-সামাজিক প্রক্রিয়াতেই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে আজ নতুন নতুন স্তর উপরে উঠে আসছে। সামাজিক ন্যায়ের দাবি আরও জোরালো হবে আশু ভবিষ্যতে।
কিন্তু মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরা কি একে স্বাগত জানাবেন? গণমাধ্যমে আলোচনার গতিপ্রকৃতি দেখে সন্দেহ জাগে। লক্ষ লক্ষ নতুন স্কুল শিক্ষক হবেন, জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠবে, নতুন নতুন কাগজ বেরোবে, সহস্র সহস্র তরুণী-কিশোরী লেখাপড়া চালিয়ে যাবে, জেলায় জেলায় নানা লোক সম্মান পাবে, এতে বুদ্ধিজীবীবর্গ খুশি নন, কেননা এতে বুদ্ধির ঔজ্জ্বল্য নেই, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই।
পশ্চিমবঙ্গে যে সামাজিক মন্থন চলেছে, তার গণতান্ত্রিক বাতাবরণ এক জটিল প্রক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে তাতে সন্দেহ নেই। বুদ্ধিজীবীদের নৈরাশ্যের কারণও বোঝা যায়। ক্ষুদ্র অর্থনীতির কাঠামোয় রাজনীতি করাই সম্পদ সঞ্চয়ের অন্যতম প্রধান পথ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। গণরাজনীতির সঙ্গে সামাজিক পুঁজি আহরণের মণিকাঞ্চনযোগে আমরা যেমন সামাজিক পরিবর্তন দেখব, তেমনই প্রত্যক্ষ করব এক ধরনের উৎসহীন ভবঘুরেবৃত্তি, লুণ্ঠন যার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ প্রক্রিয়ার অন্যতম উপাদান হবে হিংসা।
কঠোর গণক্ষমতা সৃষ্টি ব্যতিরেকে এই বিপর্যয় সামলানোর অন্য পথ নেই। সরকারকে শক্ত হতে হলে যেমন এক দিকে জনকল্যাণ ব্যবস্থা এবং নানা উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে শক্ত হাতে চালাতে হবে, তেমনই সমাজ পুনর্গঠন লক্ষ্যে তাকে আলাপচারী হতে হবে। সে পথেই হিংসাশ্রয়ী গণতন্ত্রের পথ থেকে সরে আত্মনিয়ন্ত্রণের পথে যাওয়া সম্ভব। বর্তমান গৃহযুদ্ধাত্মক বাস্তবতার মধ্যে সেই সম্ভাবনা রয়েছে। কোনও কল্পিত পথের বা ভবিষ্যতের কথা ভেবে লাভ নেই।
কঠোর গণক্ষমতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের দ্বৈত প্রয়োজনের প্রতি বুদ্ধিজীবীরা যদি মনোনিবেশ করেন, সমাজের উপকার হবে। তবে তা সম্ভব দলীয় পৃষ্ঠপোষকতা, আনুকূল্য এবং বছরের পর বছর সরকারি এবং বেসরকারি নানা সম্মান লাভের যে লোভ, তাকে প্রত্যাখ্যান করেই।

ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর অধিকর্তা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.