প্রকাশ্য সভায় যাঁদের হুমকি দিয়েছিলেন জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল, সেই নির্দলেরাই কাঁটা হয়ে দাঁড়ালেন শাসক দলের। বীরভূমের পাড়ুই থানা এলাকার কসবা গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূলকে সমানে সমানে টক্কর দিয়ে অর্ধেক আসন ছিনিয়ে নিলেন দলেরই বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর প্রার্থীরা। মোট ১২ টি আসনের মধ্যে অনুব্রত-গোষ্ঠী পেয়েছে ৬টি, বিক্ষুব্ধ-গোষ্ঠীও ৬টি।
বস্তুত, এই পঞ্চায়েতের দখল পাওয়াটা ছিল জেলা তৃণমূল সভাপতির কাছে ‘মর্যাদার লড়াই’। সেই লড়াইয়ে উত্তীর্ণ হতে পারলেন না অনুব্রত মণ্ডল। শুধু কসবা নয়, যে ব্লকের বাসিন্দা অনুব্রত, সেই বোলপুর-শ্রীনিকেতনের ফলের দিকে তাকালে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। এই ব্লকের মোট ৯টি পঞ্চায়েতের মধ্যে দু’টিতে জয়ী হয়েছেন নির্দলেরা (সকলেই বিক্ষুব্ধ তৃণমূল)। কসবায় দু’পক্ষের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে (এখানে নৈতিক জয় তাঁদেরই বলে দাবি করেছেন নির্দলেরা)। বাকি ৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতের দখল অবশ্য গিয়েছে শাসক দলের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ঝুলিতেই। বীরভূমের সামগ্রিক ফলের নিরিখে যা তৃণমূলের কাছে বিশেষ আশাব্যাঞ্জক নয়। |
নিজের পুড়ে যাওয়া বাড়ির সামনে জয়ী নির্দল প্রার্থী রবিলাল সরেন। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
|
চতুর্থ দফার ভোটের কয়েক ঘণ্টা আগে কসবার নির্দল প্রার্থী হৃদয় ঘোষের বৃদ্ধ বাবা সাগর ঘোষকে গুলি করে খুনের ঘটনাকে ঘিরে ইতিমধ্যেই রাজ্য রাজনীতি তোলপাড় হয়েছে। ওই ঘটনায় অনুব্রতর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন হৃদয়বাবুর স্ত্রী। কসবার সভায় নির্দল প্রার্থীদের হুমকি দেওয়ার ঘটনাতেও অনুব্রতর বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। হৃদয় ঘোষ অবশ্য পরাস্ত হয়েছেন জেলা সভাপতির অনুগামী প্রার্থীর কাছে। যদিও এই পরাজয়টা অস্বাভাবিক নয়। কারণ, কসবার যে কন্দর্পপুর সংসদ থেকে হৃদয়বাবু লড়েছেন, সেখানে প্রকৃত নির্দল প্রার্থী ছিলেন অনিল কোঁড়া। যাঁর বাড়িতেও জেলা তৃণমূল সভাপতির হুমকির পরে পরেই হামলা হয়েছিল এবং ভয়ে ঘরছাড়া ছিলেন। হদয়বাবু আসলে প্রচার করেছেন অনিলবাবুর হয়েই। এই সংসদে অনুব্রত-অনুগামী গৌরাঙ্গ দাস পেয়েছেন ৩২১টি ভোট। আর অনিলবাবু পেয়েছেন ২৪৯টি। হৃদয়বাবুর ঝুলিতে মাত্র ৯টি ভোট।
হৃদয়বাবুর কথায়, “আমি তো নিজের জন্য ভোটে দাঁড়াইনি। ওই গ্রামের ছেলে অনিলের জন্য দাঁড়িয়েছিলাম। ও আক্রান্ত হয়েছে। মনোনয়নের পর থেকে গ্রাম ছাড়া ছিল। এলাকায় আমরা থাকতে পারলে জোর দিয়ে বলতে পারি ১২টি আসনই আমাদের দখলে থাকত।”
হৃদয়বাবুর নিজের বাড়ি যেখানে, সেই বাঁধনবগ্রামে (৫ নম্বর সংসদ) অবশ্য নির্দল (বিক্ষুব্ধ তৃণমূল) প্রার্থী শঙ্করী দাস ২৯ ভোটে হারিয়েছেন অনুব্রত- অনুগামী শিখা দাসকে। নিজের হার নিয়ে তাই বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই হৃদয়বাবুর। বরং অনিল কোঁড়া জিতলে আরও খুশি হতেন বলে জানিয়েছেন। ফল জানার পরে হৃদয়বাবুর প্রতিক্রিয়া, “আমরা পঞ্চায়তে ৬টি আসন পেয়েছি। এটাই আমাদের নৈতিক জয়। তবে, তৃণমূলের সন্ত্রাস, অর্থবল আর পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের হেনস্থার জেরে আমরা প্রচার করতে পারিনি। মানুষের পাশে গিয়ে ভোট চাইতে পারিনি। বহু মানুষ আতঙ্কে ভোট দিতে পারেননি। আমার বাবাকে খুন হতে হয়েছে।” তাঁর সংযোজন, “আমার গ্রামেও নির্দল জিতেছে। এটাই তো সম্মানের!”
সরকারি পরিসংখ্যান অবশ্য বলবে, কসবা পঞ্চায়েতে তৃণমূল ৭টি আসনে এবং নির্দলেরা ৫টি আসনে জয়ী হয়েছেন। পরিসংখ্যান যেটা বলবে না, সেটা হল, ওই পঞ্চায়েতের ৯ নম্বর সংসদে তৃণমূলের টিকিটে যিনি লড়েছেন, সেই পার্বতী বাগদি আসলে অনুব্রত-বিরোধী গোষ্ঠীরই লোক। এবং তিনি ৮৭ ভোটে হারিয়ে দিয়েছেন জেলা সভাপতির ঘনিষ্ঠ নির্দল প্রার্থী লক্ষ্মী বাগদিকে।
একই ভাবে জেলা তৃণমূল সভাপতির উস্কানিমূলক বক্তব্যের পর প্রথম আক্রান্ত হয়েছিলেন যে নির্দল প্রার্থী, কসবা গ্রাম পঞ্চায়তের ১০ নম্বর সংসদ গোপালনগর থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সেই রবিলাল সরেন ২৫২ ভোটে হারিয়েছেন শাসক দলের প্রার্থী লক্ষ্মণ মুর্মুকে। গত ১৭ জুলাই জেলা সভাপতির ওই জনসভার কয়েক ঘণ্টা পরেই গোপালনগরে রবিলালবাবুর বাড়িতে হামলা হয়েছিল। ওই রাতের পর থেকে কার্যত আত্মগোপন করে থাকা রবিলালবাবু বাড়ি ফিরলেন জয়ের খবর পাওয়ার পরে। বললেন, “এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম! এ বার সসম্মানে গ্রামে থাকতে পারব সন্ত্রাস, আতঙ্ককে পিছনে ফেলে। মানুষ আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমাকে জিতিয়েছেন। প্রায় ১২ দিন পর বাড়ি ফিরলাম। স্ত্রী, সন্তানদের মুখে হাসি ফিরল।”
আর বাঁধনবগ্রামের বাড়ির উঠোনে বসে নিহত সাগরবাবুর স্ত্রী সরস্বতী ঘোষ বললেন, “এই ভোট ভোট করেই তো নিরীহ বুড়ো মানুষটাকে খুন হতে হল। এ বার কি রক্ত ঝরা বন্ধ হবে?” পড়ন্ত বিকেলে হাহাকারের মতো শোনাল সরস্বতীদেবীর আকুতি। |