মনোনয়ন জমা করেই ঘর ছাড়তে হয়েছিল। কর্মী-সমর্থকদের মোবাইলে ফোন করেই উৎসাহ জুগিয়েছেন। ভোটের প্রচারে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ানো দূরের কথা, দেওয়াল লিখনও তেমন করতে পারেননি। বড় অংশের বুথে কোনও এজেন্টও দিতে পারেননি। গোটা ব্লকে বিরোধীদের তিনিই ছিলেন একমাত্র প্রার্থী। বীরভূমে নানুর ব্লকের সেই একমাত্র প্রার্থী, সিপিএমের মহম্মদ শফিকুল আলম সবাইকে চমকে দিলেন। জেলা পরিষদের আসনটিতে ১৯০৫টি ভোটের ব্যবধানে তৃণমূলপ্রার্থী সুব্রত ভট্টাচার্যকে হারালেন শফিকুল।
জয়ের পরে উচ্ছ্বসিত সিপিএমের নানুর জোনাল সম্পাদক হাসিবুর রহমান বলেন, “তৃণমূলের হুমকির জেরে আমরা প্রথম দিকে ভেবেছিলাম, ওই প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নেব। কিন্তু এখন দেখছি মানুষ আমাদের পক্ষেই রায় দিয়েছেন। সর্বত্র আমাদের প্রার্থী থাকলে, নানুরে আমরাই জয়ী হতাম।” |
জেতার পরে কর্মী সমর্থকদের মাঝে সিপিএম প্রার্থী মহম্মদ শফিকুল আলম। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।
|
পাশের লাভপুর ব্লকে মানুষকে এ বার ভোট দিতে বেরতে হয়নি। তৃণমূল সব ক’টি আসনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে। আর নানুর ব্লকেও ১১টির মধ্যে ৯টি পঞ্চায়েত তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করে ফেলেছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই তৃণমূলের দখলে এসেছে জেলা পরিষদের আরও দু’টি আসনও। ভোট হয়েছে কেবল নানুর পঞ্চায়েত সমিতির ৩টি আসনে এবং দু’টি পঞ্চায়েতে। তাও থুপসড়া পঞ্চায়েতের ২১টির মধ্যে ১৬টি আসনে এবং চণ্ডীদাস-নানুর পঞ্চায়েতের ১৬টি আসনের একটিতে। সেখানেও লড়াইয়ে কোনও বামপ্রার্থীই ছিলেন না। তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের অনুগামীদের বিরুদ্ধে লড়াই হয়েছিল দলেরই নানুর বিধায়ক গদাধর হাজরার অনুগামীদের। ফলে ওই দু’টি পঞ্চায়েত বাদে নানুরে একমাত্র দাসকল গ্রাম-কড়েয়া ১, বড়াসাওতা, কীর্ণাহার ১ ও ২ পঞ্চায়েতের মানুষই ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাও একমাত্র জেলা পরিষদের আসনেই।
সিপিএমের নানুর জোনাল সদস্য শফিকুলের বাড়ি কীর্ণাহারের নুরপুর গ্রামে। ১৯৮৮ সাল থেকেই বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। দু’ বার কীর্ণাহার ২ পঞ্চায়েতের সদস্যও হয়েছেন। মনোনয়ন দাখিলের পর থেকে কখনও থেকেছেন দলের সিউড়ি কার্যালয়ে। কখনও দুবরাজপুরে শ্বশুরবাড়িতে। ভোটের মাত্র কয়েক দিন আগেই এলাকায় ফিরতে পেরেছিলেন। তাঁর স্ত্রী নইমা বিবির অভিযোগ, শুধু স্বামীকেই নয়, তৃণমূলের হুমকির চোটে তাঁকেও বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকতে হয়েছে। জেতার পরে শফিকুল বলছেন, “মানুষ যেখানে যেখানে অবাধে ভোট দিতে পেরেছেন, সেখানেই আমাদের জয় সুনিশ্চিত হয়েছে। যেখানে এজেন্ট দিতে পারিনি, সেখানে তৃণমূল ছাপ্পা ভোট দিয়েছে। তা না হলে আরও বড় ব্যবধানে জিততাম।”
এ দিকে যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন খোদ তৃণমূলের প্রার্থী, প্রায় সেই ঘটনায় ঘটতে দেখা গেল। জেলার রাজনৈতিক মহলের দাবি, ভোট দিতে না পারা নিয়ে এলাকাবাসীর ক্ষোভ তৃণমূলের হারের অন্যতম কারণ। ভোটের দিন সুব্রতবাবু বলেছিলেন, “নানুরে কোথাও ভোট হল না। এই বিষয়টি আমার বিরুদ্ধে যেতে পারে।” তবে সবুজ-নানুরে সিপিএম প্রার্থীর এই জয়ের নেপথ্যে অন্যতম বড় ফ্যাক্টর কিন্তু তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলও। জেলা পরিষদের অন্য দু’টি আসন, গদাধর-গোষ্ঠীর (নানুরের অধিকাংশ পঞ্চায়েতই এই গোষ্ঠীর দখলে এসেছে) হাতে আগেই চলে এলেও তৃতীয়টিতে তাঁরা কোনও প্রার্থী দিতে পারেননি। সেখানে তৃণমূলের প্রতীকে লড়া দলের জেলা সম্পাদক সুব্রত ভট্টাচার্য ছিলেন আদতে অনুব্রতরই প্রার্থী। তৃণমূলেরই একটি সূত্রের দাবি, তাঁকে হারাতে এলাকায় ‘নেগেটিভ পোলিং’ করেছে গদাধর-গোষ্ঠী। ওই গোষ্ঠীরই এক নেতার দাবি, সুব্রত ভট্টাচার্য জিতলে নানুরে গদাধর-গোষ্ঠীর দখলে আসা পঞ্চায়েতগুলিতে কার্যত অনুব্রত-গোষ্ঠীই ছড়ি ঘোরাত। ফলে ওই আসনটিতে সিপিএমের প্রার্থীকে সমর্থন করা ছাড়া তাঁদের কোনও উপায় ছিল না।
এ দিন নানুরের ফল শুনে অনুব্রত বলেন, “কী কারণে এমন হল, এখনই বলতে পারছি না। পরে পর্যালোচনা করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তিনি স্পষ্ট করে না বললেও ভোটের ঠিক পরের দিনই এলাকায় অনুব্রত-গোষ্ঠীর দাপুটে নেতা অভিজিৎ সিংহ (রানা) অভিযোগ করেছিলেন, “গদাধর-গোষ্ঠী সিপিএমের হয়ে বিভিন্ন বুথে ছাপ্পা ভোট করেছে।” এ দিন অবশ্য গদাধর হাজরার অনুগামী বলে পরিচিত দলের নানুর ব্লক কার্যকরী সভাপতি অশোক ঘোষ ‘নেগেটিভ-পোলিং’ হওয়ার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ, “ফলাফল দেখে মনে হচ্ছে, এমনটা কেউ কেউ করে থাকতে পারেন। তবে এটা হওয়া উচিত ছিল না।” |