প্রত্যাশিতই ছিল। রাজ্যে পালাবদলের পরে প্রথম পঞ্চায়েত ভোটে সিপিএম-কে জেলা থেকে প্রায় উৎখাত করে দিল তৃণমূল। জেলা পরিষদ তো বটেই, অধিকাংশ পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েত দখল এ বার তাদেরই হাতে।
বিধানসভা ভোটের পরেও যেখানে বামেরা দুর্গরক্ষা করতে পেরেছিল, সেই পাণ্ডবেশ্বর-জামুড়িয়াতেও এ বার তারা প্রায় উড়ে গিয়েছে। রানিগঞ্জ, পাণ্ডবেশ্বর ও জামুড়িয়ায় ছ’টি জেলা পরিষদ আসনই পেয়েছে তৃণমূল। যে দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লক পরিবর্তনের ভোটেও সিপিএমকে চার হাজারেরও বেশি লিড’ দিয়েছিল, সেখান থেকেও তারা প্রায় মুছে গিয়েছে। হাতছাড়া হয়েছে দু’টি জেলা পরিষদ আসনই।
অন্য দিকে, গ্রামীণ বর্ধমানে তো বামেদের খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। মঙ্গলকোট ও কেতুগ্রামে যে বিক্ষুব্ধ তৃণমূল প্রার্থীরা ‘নির্দল’ হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা কেউই সুবিধা করতে পারেননি। প্রায় সর্বত্রই তৃণমূল একবগ্গা জিতেছে। রায়না বা বুদবুদ-লাউদোহার কিছু এলাকায় নির্দলেরা ভোট কেটে শাসকদলের যাত্রাভঙ্গ করেছে বটে, কিন্তু তা বড় জোর কয়েকটি আসনেই সীমাবদ্ধ।
দিনের শেষে আসানসোলের তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী মলয় ঘটক বলেন, “যে ফলাফল হয়েছে, তা আমাদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার বহিঃপ্রকাশ। সালানপুর কংগ্রেসের দখল ছিল, সেখানে তারা ধরাশায়ী হয়েছে। বামবিরোধী ভোট ভাগ হওয়ায় সিপিএম কিছুটা সুবিধা পেয়েছে। তবে আমরাও খুব ভাল ফল করেছি।”
সিপিএম গোড়া থেকেই চিৎকার করে আসছিল, শাসকদল সন্ত্রাস চালিয়ে তাদের বহু জায়গায় ভোটে দাঁড়াতে দেয়নি। ভোটের পরে তাদের অভিযোগ ছিল, ঝুড়ি-ঝুড়ি ছাপ্পা ভোট পড়েছে। সোমবার গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে বিপর্যয়ের খবর আসার পরেই দলের জেলা সম্পাদক অমল হালদার সাংবাদিক বৈঠক করে অভিযোগ করেন, “বহু জায়গায় আমাদের এজেন্টদের হয় ঢুকতে দেওয়া হয়নি, নয়তো মারধর করে গণনাকেন্দ্র থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু গণনাকারী সরকারি কর্মচারি সিপিএম বা বামফ্রন্টের প্রতীকে ছাপ মারা ব্যালট তৃণমূলের গুচ্ছে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সিপিএম বা বামফ্রন্টের পাওয়া ব্যালট গোনা হয়েছে তৃণমূলের ভোট হিসেবে।” প্রশাসন অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
প্রচুর আসন আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিনিয়ে নিয়েছিল তৃণমূল। বাকি যে সব জায়গায় ভোট হয়েছে, ফল বলছে, সেখানেও বামেরা সুবিধা করতে পারেনি। রায়না-২ ব্লকে ভোটই হয়নি, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সব আসন জিতেছে তৃণমূল। রায়না-১ ব্লকে প্রথম থেকেই সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠছিল। একাধিক সংঘর্ষও হয়। রায়না-১ পঞ্চায়েত সমিতির ২২টি আসনের মধ্যে সিপিএম পেয়েছে ৮টি। ওই ব্লকেরই ১৪টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ১৩টি তৃণমূল দখল করেছে। রায়না গ্রাম পঞ্চায়েতে ১৩টি আসনের মধ্যে সিপিএম ৬টি, তৃণমূল ৫, কংগ্রেস ১ এবং ‘নির্দল’ হয়ে দাঁড়ানো বিক্ষুব্ধ তৃণমূল একটি আসন পেয়েছে।
রায়নায় জিতলেও সিপিএম নেতাদের সকলের এলাকায় দলের প্রার্থীরা বিশেষ কল্কে পাননি। যেমন বিদায়ী জেলা সভাধিপতি উদয় সরকারের শ্যামসুন্দর পঞ্চায়েতে দল হেরেছে। পরাজয় হয়েছে প্রয়াত নেতা প্রদীপ তা-র সরাইটিকর গ্রাম পঞ্চায়েতেও। তবে তিনটি ভোটে হারের হ্যাট্রিক করা আউশরা (বর্ধমান পুরসভার বিদায়ী প্রধান আইনূল হকের গ্রাম) ও পাশের উদগরা গ্রামে সিপিএম জিতেছে। ভাতারের বড়বেলুন-২ গ্রাম পঞ্চায়েতে ৯টি আসনের মধ্যে সিপিএম ৩, ফরওয়ার্ড ব্লক ৪ এবং আসএসপি ও সিপিআই ১টি করে অর্থাৎ বামফ্রন্টই সব আসন পেয়েছে। সাহেবগঞ্জ-২ গ্রাম পঞ্চায়েতে ১২টি আসনের সাতটি পেয়েছে সিপিএম, বাকি তৃণমূল।
সংখ্যার বিচারে এগিয়ে থাকলেও রায়না পঞ্চায়েতে যে বোর্ড গড়তে পারবেন, অমলবাবুরা অবশ্য এমন আশা করছেন না। কেননা বিক্ষুব্ধদের দলে ফেরার বা কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের সমঝোতা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আদৌ উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। অমলবাবু বরং দাবি করেন, “ওখানে আমরা প্রথমে আটটি আসন পেলেও, পুনর্গণনা করে দু’টি আসনে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে।” তাঁদের অভিযোগ, মেমারি ১ ও ২ ব্লক, বর্ধমান ১ ও ২, রায়না ১ ও ২, আউশগ্রাম ১ ও জামালপুর ব্লকেও গণনায় কারচুপি হয়েছে। প্রশাসনের কর্তারা অবশ্য তেমন কোনও সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু যে রায়নায় সিপিএম দাঁড়াতেই পারছিল না, সেখানে তারা অতগুলি আসন পেল কী করে? তৃণমূলের এক নেতার স্থানীয় কথায়, “প্রার্থী দেওয়া নিয়ে আমাদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চরমে উঠেছিল। ফলে দলেরই বেশ কিছু কর্মী নির্দল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। তার ফলেই সিপিএম রায়না-১ ব্লকে জমি পেয়ে গিয়েছে।” তৃণমূলের অন্যতম পর্যবেক্ষক অলোক দাস বলেন, “ওই ব্লকে কেন সার্বিক সাফল্য মিলল না, তা আমরা খতিয়ে দেখব।” |