ভয়টা কাটল অবশেষে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কামদুনি।
গ্রামের মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন এবং তার পরবর্তী একাধিক ঘটনার জেরে গত প্রায় এক মাস ধরে যেন একটা দমবন্ধ করা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটিয়েছে কামদুনি। দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে মঙ্গলবার দুপুরে টুম্পা, মৌসুমীরা ফিরতেই গোটা গ্রামের পরিবেশ বদলে গেল এক লহমায়। প্রৌঢ় প্রভাত নস্কর চেঁচিয়ে বললেন, “আর ভয় নেই। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি আশ্বাস দিয়েছেন। এ বার বাঁচার মতো বাঁচব।”
দেশের সাংবিধানিক প্রধান তাঁদের সমস্যার সমাধান কতটা করতে পারবেন, তা নিয়ে অবশ্য এই মুহূর্তে ভাবতে রাজি নন কামদুনির মানুষ। রাষ্ট্রপতির আশ্বাসই যে তাঁদের বাড়তি শক্তি জুগিয়েছে, তা স্পষ্ট এলাকার প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্যেও। নমিতা ঘোষ, অনিমা কয়ালের মতো গ্রামবাসীরা এ দিন তাঁর কাছে জানতে চান, “রাষ্ট্রপতি কি দোষীদের শাস্তি দেবেন?” প্রদীপবাবু তাঁদের বোঝালেন, “রাষ্ট্রপতি শাস্তি দেন না। তিনি নিশ্চিত করেন, যাতে সুবিচার মেলে। রাষ্ট্রপতি সেই আশ্বাস দিয়েছেন। বলেছেন প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও তিনি কথা বলবেন।” আর এই আশ্বাসটুকুতেই স্বস্তি পেয়েছে গ্রাম। |
এর আগে কখনও মাওবাদী তকমা লাগিয়ে গ্রেফতারের ভয়, কখনও অপরাধীদের হুমকি, কখনও মোটরবাইক বাহিনীর চোখরাঙানিতে সিঁটিয়ে ছিল কামদুনি। গ্রামের মেয়েকে ধর্ষণ করে খুনের পর থেকে অভিভাবকেরা বাড়ির মেয়েদের হাত ধরে স্কুলে নিয়ে গিয়েছেন, আবার হাত ধরেই বাড়ি ফিরিয়ে এনেছেন। একলা ছাড়তে ভয় পাচ্ছিলেন তাঁরা। এ দিন দিল্লি থেকে ফিরে টুম্পা, মৌসুমীরা যখন কামদুনির স্কুল মাঠে চেঁচিয়ে বললেন, ‘আর আমরা ভয় পাচ্ছি না। রাষ্ট্রপতি নিরাপত্তার পূর্ণ আশ্বাস দিয়েছেন’, তখন সেই ভয়টাই যেন মুখ লুকোলো।
কী ভাবে? কাদা মাঠ পেরিয়ে অম্বেডকর মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র। দোতলার ইটের গাঁথনি পড়েছে। এক তলার ক্লাস ঘরের জানালায় নেভি ব্লু স্কার্ট আর সাদা শার্ট পরা উৎসাহী এক সার কচি মুখ ঠায় দাঁড়িয়ে। টুম্পা, মৌসুমীদের কথা শুনতে স্কুল থেকে বেরিয়েও এসেছে কেউ কেউ। কচি গলায় তাদেরই একজন বলে উঠল, “স্কুল থেকে ফেরার সময় আর তা হলে ভয় করবে না?” টুম্পার কথায়, “নিরাপত্তার দাবিতে, দোষীদের উচিত শাস্তির দাবিতে যখন আন্দোলন শুরু করেছিলাম, তখন একটু ভয় ছিল। এখন সত্যিই আর ভয় নেই। গোটা রাজ্য, গোটা দেশ যে আমাদের পাশে রয়েছে, তা আমরা বুঝে গিয়েছি।”
এ দিন সকাল থেকেই কামদুনি অপেক্ষায় ছিল টুম্পা-মৌসুমীদের ফেরার। কামদুনির ঘোষপাড়ার (যেখানে নিহত কলেজ ছাত্রীর বাড়ি) আগে বড় কালভার্ট লাগোয়া বাঁশের মাচা। টুম্পাদের নিয়ে গাড়ি গ্রামে এসে পৌছনোর আগেই মাচার সামনে ভিড় জমান অনেকে। মুখে নানা জল্পনা। রাষ্ট্রপতি তাঁদের সব দাবির কথা শুনেছেন তো? আদৌ কি মিটবে তাঁদের দাবি? নাকি একই রকম থাকবে অবস্থা? মৌসুমীদের গ্রামে ঢুকতে দেখে একে একে সকলেই জড়ো হন স্কুল মাঠে। টুম্পাদের সঙ্গী সুকান্ত কয়ালের কাছে তাঁরা জানতে চাইলেন, গ্রামে পাকাপাকি ভাবে পুলিশ পিকেট থাকবে কি? সুকান্ত তাঁদের জানালেন, যা যা হলে গ্রামের মানুষ নিরাপদে থাকবে, গ্রামের উন্নতি হবে, তা সবই হবে। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় তেমন আশ্বাসই দিয়েছেন।
বাঁশের মাচার কোনাকুনি স্কুল মাঠ। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের (আইআরবি) জওয়ানেরা এ দিন কামদুনিতে পৌঁছে গিয়েছে। মাঠের পাশে রাস্তার ধারে জওয়ানদের বড় গাড়ি। গুটিকয়েক জওয়ান গাড়ির জানালা দিয়ে উৎসাহী মুখ বাড়ান টুম্পা-মৌসুমীদের দেখতে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রধারী এক জওয়ানকে বলতে শোনা গেল, “সরকার চাইলে ভোটের পরেও আমাদের এখানে রেখে দিতে পারে।”
এ দিন শিয়ালদহ স্টেশনে ৯-এ প্ল্যাটফর্মে বেলা ১০টা ২৩-এ রাজধানী এক্সপ্রেসের বি-১ কামরা থেকে টুম্পারা নামতেই সুটিয়া প্রতিবাদী মঞ্চের সদস্যরা এক দফা সম্বর্ধনা দিয়েছেন। হাতে ধরিয়েছেন রজনীগন্ধার তোড়া। তাঁদের জানিয়েছেন, খোরজুনা, গাইঘাটা, রানিতলা, গেদে-র প্রতিবাদী মানুষরা কামদুনির সঙ্গে রয়েছেন। স্টেশনে তাঁদের অভিনন্দন জানিয়েছেন ট্রেন থেকে নামা অন্য যাত্রীদের অনেকেই।
তবে এ দিনও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কামদুনির বাসিন্দাদের দিল্লি নিয়ে যাওয়ার জন্য কংগ্রেসকে কটাক্ষ করেছেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুরের অগ্রগামী ফুটবল মাঠে তিনি বলেন, “এখন দিল্লি থেকে কলকাতা যাঁরা নাটক করে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের জিজ্ঞেস করছি, নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, মরিচঝাঁপি, এই জেলায় সাগিনা বিবির মেয়ের ধর্ষণের সময় কোথায় ছিলেন?” তিনি জানান, কামদুনির ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব বিচারের জন্য আদালতকে অনুরোধও করা হয়েছে।
কামদুনির বিষয়টি নিয়ে এ দিন মুখ্যমন্ত্রীকে কটাক্ষ করেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। তিনি বলেন, “আমি অপেক্ষা করছি, কবে মুখ্যমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকেও মাওবাদী বলেন! উনি যাঁদের মাওবাদী বলে চিহ্নিত করেছেন, রাষ্ট্রপতি তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই উনি শিগগিরই রাষ্ট্রপতিকেও মাওবাদী বলবেন!”
|