লাল, তেরঙা পতাকা, নানা রঙের পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুনে ছয়লাপ চারদিক। দেখে মনে হতে পারে ভোট নয়, যেন উত্সবের আয়োজন। উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট মহকুমার সীমান্তবর্তী গ্রাম তথা এলাকাগুলিতে চোখে পড়েছে এমনই ছবি।
প্রার্থীদের অনেকেই জয়ী হওয়ার আশায় জোরকদমে প্রচারে নেমেছেন। প্রচারের খরচ সামলাতে কাউকে গরু-ছাগল বিক্রি করতে হয়েছে। কেউ জমি বন্ধক রেখেছেন। যদিও আয়োজন দেখে মনে অনেকেরই মনে প্রশ্ন, উন্নয়নের জন্য টাকা মেলে না। অথচ এ সবের বেলায় এত টাকার জোগান কোথা থেকে আসে? এলাকায় ঘুরতে ঘুরতেই কানাঘুষোয় ভেসে এল উত্তর। সীমান্তবর্তী এলাকায় যার রমরমা সবচেয়ে বেশি সেই গরু পাচারের টাকাই নাকি এই আয়োজনের পিছনে। ভোটের এই আয়োজন দেখে অনেককেই বলতে শোনা গিয়েছে, এই টাকায় গ্রামে দুটো নলকূপ অনায়াসে বসে যেত। কাদামাটির রাস্তায় ইট তো পাতা যেত। হাসনাবাদের ভবানীপুর-২ পঞ্চায়েতের মডেল বাজারের বাসিন্দা এক বৃদ্ধের সরস মন্তব্য, “মানুষের উন্নতিতে এমন পাগল হতে তো বছরের অন্য সময় দেখা মেলে না কারও। এখন বিড়ি চেয়ে খেলেও একবার জিতে যাওয়ার পরে বাবুরা আর আমাদের খবর রাখে না। তাই উন্নয়ন বলুন আর উন্নতি, কিছুই হয় না।” |
এভাবেই জল আনতে যেতে হয় সাহেবখালিতে। |
ভবানীপুর-১ ও ২, সেহেরা-রাধানগর, কালিনগরএই চারটি পঞ্চায়েতের বাসিন্দাদের চাহিদার মধ্যে অন্যতম প্রধান আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জল। দাবি শহরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য নদীর উপরে সেতুর, হাসপাতালে চিকিত্সক। বলাবাহুল্য মেলেনি কিছুই। বিধ্বংসী আয়লার পরে কেটে গিয়েছে চার-চারটে বছর। অথচ সুন্দরবন লাগোয়া সামসেরনগরের অধিকাংশ পরিবার আজও জঙ্গলের ধার ঘেঁষে বয়ে চলা কুড়েখালি খালে মাছ ধরেই বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করেন। ১০০ দিনের কাজের সুযোগ তেমন ভাবে পৌঁছয়নি তাঁদের কাছে।
স্বরূপনগরের সীমান্তবর্তী গ্রাম কালিদহরপোতা। গ্রাম থেকে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া বড়জোর দুই কিলোমিটার। ব্লকের ৯৬টি গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া এই গ্রামে অনেকেরই ঘর নেই। আশ্রয় বলতে গাছের তলা। ইন্দিরা আবাস যোজনা বা নিজ ভূমি নিজ গৃহ প্রকল্প কি তা জানা নেই তাঁদের। তাঁদের কাছে ওই সব সুবিধা পৌঁছে দিতে উদ্যোগী হয়নি পঞ্চায়েতও। তবে গ্রামে বিদ্যুত্ রয়েছে। রয়েছে প্রাথমিক স্কুল। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই গ্রামের অনেকের কাছেই গরম ভাতের গন্ধ যেন পরম পাওয়া। গ্রামের আলেয়া বিবি, মর্জিনা বিবি, সুফিয়া বিবিরা জানালেন, “গ্রামের অনেকের আজও শামুক-গুগলি খেয়ে দিন কাটে।”
বসিরহাট ১ ও ২ ব্লকের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জল। বাদুড়িয়া, হাড়োয়ার বহু গ্রামেই ঢুকতে গেলে এক হাঁটু কাদা ভাঙতে হয়। মেছোভেড়িতে ঘেরা মিনাখাঁয় কাঁচা টাকা উড়লেও অনুন্নয়নের ছোঁয়া সর্বত্র। পানীয় জলের অভাবে আজও নৌকায় করে অন্যত্র জল আনতে যেতে হয় হিঙ্গলগঞ্জের সাহেবখালির বাসিন্দাদের। বিদ্যুত্, ইটের রাস্তা আজও সন্দেশখালির বহু এলাকার মানুষের কাছে অধরা থেকে গিয়েছে।
উন্নয়নের ছোঁয়া না পাওয়া এই সব এলাকার মানুষের ক্ষোভ সব রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধেই। অনেকেরই বক্তব্য, সিপিএমের পঞ্চায়েত থেকে অনেক পঞ্চায়েতই তৃণমূলের হয়েছে। কিন্তু গ্রামের রাস্তা থেকে পানীয় জল, বিদ্যুত্ কোনওটাই জোটেনি। |
পাকা রাস্তার দাবি উঠলেও, আজও তা মেলেনি। |
যদিও উন্নয়নের প্রশ্নে কি সিপিএম, কি তৃণমূল, কি কংগ্রেস প্রত্যেকেই একে অন্যকে দুষেছেন। রাজ্য পঞ্চায়েত সেলের আহ্বায়ক ও তৃণমূল নেতা নারায়ণ গোস্বামী বলেন, “কংগ্রেস, সিপিএম যে আখেরে একটাই দল এবং প্রতিশ্রুতি ছাড়া ওরা যে আর কিছুই দিতে পারেনি তা দেখেই মানুষ তৃণমূলকে বেছেছেন।” কংগ্রেসের প্রদেশ সহ-সভাপতি অসিত মজুমদারের বক্তব্য, “মানুষ তৃণমূলকে বেছেছিল ঠিকই। কিন্তু এই আড়াই বছরে তারা তার ফল টের পেয়েছে। দেশ থেকে পঞ্চায়েত কী ভাবে পরিচালনা করতে হয় তা কংগ্রেস জানে। আর সে জন্য ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন রাজীব গাঁধী।” আর সিপিএমের জেলা কমিটির সম্পাদক গৌতম দেবের দাবি, “মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আর যাই হোক মানুষকে দীর্ঘ সময় ভুল বোঝানো যায় না। রাজ্যে গ্রামের যেটুকু উন্নতি হয়েছে তা বাম আমলেই। তৃণমূলকে শিক্ষা দিতে মানুষ আমাদের পিছনে আছে।”
উন্নতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির এমন তরজায় নিজেদের প্রাপ্তিটুকু পেতে সুন্দরবন ও সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ কাকে বেছে নেন আগামী ২৯ জুলাইয়ের পরেই তা জানা যাবে।
|