|
|
|
|
একাত্মতায় রাইসিনা মিশে গেল কামদুনিতে
অনমিত্র সেনগুপ্ত • নয়াদিল্লি |
তীব্র উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগকে সঙ্গী করেই দিল্লি পাড়ি দিয়েছিল কামদুনির দলটি। খোদ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ বলে কথা। তাঁর সামনে কী ভাবে কথা বলা হবে, তা নিয়ে আগে থেকে আলোচনাও সেরে রেখেছিল ২৪ জনের দলটি। কিন্তু প্রাথমিক পরিচয়পর্ব মিটতেই প্রোটোকল ভেঙে বেরিয়ে এলেন খোদ প্রণব মুখোপাধ্যায়ই। কথা বললেন জনে জনে। বিহ্বল প্রতিনিধিরা প্রণববাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। অনেকেই চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। মৃত মেয়েটিকে দেখে যে ভাবে শিউরে উঠেছিল গোটা কামদুনি, ওই ছাত্রীর পরিবারের মুখে সে কথা শুনে আজ শিউরে ওঠেন প্রণববাবুও।
একাত্মতায় রাইসিনা যেন মিশে যায় কামদুনির সঙ্গে।
সিআইডির তদন্তে ভরসা রাখতে না পেরে সিবিআই তদন্তের দাবিতে সরব হয়েছিল গোটা কামদুনি। রাজ্য সরকার না চাইলে কিংবা আদালত নির্দেশ না দিলে সিবিআই তদন্ত হওয়া সম্ভব নয়, এটা বুঝে দেশের শীর্ষ নাগরিকের শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন গ্রামের বাসিন্দারা। আজ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে সেই আর্জিই জানান মৃত ছাত্রীর পরিবারের সদস্য ও গ্রামবাসীরা। প্রায় আধ ঘণ্টার ওই সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি আশ্বাস দেন, সাংবিধানিক পরিধির মধ্যে থেকেই তিনি বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানাবেন। কামদুনি আন্দোলনের দুই প্রতিবাদী মুখ, টুম্পা ও মৌসুমি কয়াল পরে বলেন, “প্রণববাবু যে ভাবে আশ্বাস দিয়েছেন তাতে আমরা সন্তুষ্ট।” |
|
রাষ্ট্রপতির কাছে মৌসুমী-টুম্পারা। |
প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর
এই প্রথম রাজ্য থেকে কোনও প্রতিনিধিদল এল রাষ্ট্রপতি ভবনে। তাঁদের প্রথমে রাষ্ট্রপতি ভবন ঘুরিয়ে দেখানোর পরিকল্পনা থাকলেও পরে তা বাতিল করা হয়। তবে দলের
এক সদস্য বলেন, “প্রণববাবু না খাইয়ে ছাড়েননি।”
কামদুনির গ্রামবাসীরা এ দিন মোট এগারো দফা দাবি জানান। তার মধ্যে রয়েছে, পাকা সড়ক নির্মাণ, রাস্তায় বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা, এলাকায় একটি থানা গঠন। মৃত ছাত্রীর দাদা বলেন, “যে জমিতে বোনের উপরে অত্যাচার চালানো হয়েছিল সেই জমির মালিক বেশ কয়েক কাঠা জমি দিতে রাজি হয়েছে। আমরা চাই বোনের নামে ওই জমিতে একটি মহিলাদের কলেজ নির্মাণ করা হোক। রাষ্ট্রপতি সব দাবি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন।”
কামদুনি নিয়ে আন্দোলনে সরব হওয়ায় ইতিমধ্যেই কারণ দর্শানোর নোটিস পেয়েছেন এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রদীপ মুখোপাধ্যায়। এ দিন তিনিও ছিলেন প্রতিনিধিদলে। তাঁর ভূমিকা যে শাসকদল ভাল ভাবে নিচ্ছে না, তা ফের বুঝিয়ে দিয়েছেন রাজ্য প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য। গত কালই শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে পাশে বসিয়ে তিনি হুমকি দেন, এর জন্য প্রদীপবাবুকে শাস্তির মুখে পড়তে হবে। আজ সব কিছু রাষ্ট্রপতিকে খুলে বলেন প্রদীপবাবু। তাঁর দাবি, রাষ্ট্রপতি তাঁর নিরাপত্তার বিষয়টিও খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন। এ দিন প্রদীপবাবু রাষ্ট্রপতিকে ফুল, গীতা আর পৈতে উপহার দেন। প্রত্যুত্তরে প্রণববাবু বলেছেন, “এই উপহার অমূল্য সম্পদ।” |
|
কামদুনির বাড়িতে বসে টিভি-তে মৌসুমীদের দেখছেন পাড়ার মহিলারা। |
কামদুনির কয়ালপাড়ায় বেশির ভাগ বাড়িতেই টিভি নেই। সকাল থেকেই তাই ভিড় বিশ্বজিৎ কয়ালের বাড়িতে। ছোট্ট ঘরে একটাই টিভি। যে ক’টা চেয়ার পাতা যায়, তাতেই ঠাসাঠাসি করে বসেছেন মহিলারা। চোখ টিভির পর্দায়। বিশ্বজিৎ ছাড়াও তাঁর স্ত্রী মৌসুমী ও বাড়ির বড় বউমা সরমা গিয়েছেন রাষ্ট্রপতির কাছে দরবার করতে। এই প্রথম এত দূর যাত্রা দু’বউয়ের। তাই মাঝে-মাঝে ফোন আসছে। ‘‘চিন্তা কোরো না। বিচার নিয়েই ফিরব।’’ রাষ্ট্রপতি কী বিধান দিতে পারেন তা নিয়ে জল্পনাও চলল বাইরের জটলায়। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বেরিয়ে নিহত ছাত্রীর ভাই যখন জানালেন, ‘‘উনি সিবিআই তদন্তের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে বলবেন।’’ তখন যেন জয়ের আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন সবাই। মিতা কয়াল বললেন, ‘‘দিল্লি যখন যেতে পেরেছি, সুবিচার নিয়ে ফিরবই।’’ কিন্তু আপনি তো কামদুনিতেই রয়েছেন? মিতাদেবীর জবাব, ‘‘আরে মনটা তো দিল্লিতেই পড়ে আছে।’’
নিহত ছাত্রীর মাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল কোলা গ্রামে, বাপের বাড়িতে। বয়স কুড়িও পেরোয়নি মৃতার খুড়তুতো ভাইয়ের। বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে ছাত্রটি বলে, ‘‘দিদি মারা যাওয়ার পরে দোষীদের শাস্তির জন্য এত দূর দৌড়তে হবে ভাবিনি। ক’টা মানুষ পারবে দিল্লি ছুটতে? সবাই ছিল বলেই পেরেছি। আনসারদের ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত ছাড়ছি না।’’
শুধু কামদুনি নয়। ধর্ষণের ঘটনায় সুবিচার না পেয়ে এ বার দিল্লির দ্বারস্থ হয়েছেন খোরজুনা ও রানিতলার বাসিন্দারাও। কামদুনির মতো এখানেও রাজ্য পুলিশ বা সিআইডি-র উপর ভরসা রাখতে না পেরে সিবিআই তদন্তের দাবিতে দিল্লি পৌঁছেছেন আটপৌরে মানুষগুলি। দুই প্রতিনিধিদলেরই বক্তব্য, ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে তাদের পরিবারের মেয়েকে। অথচ পুলিশ ধর্ষণের অভিযোগ নিতে চাইছে না। দুই পরিবারই অভিযোগের আঙুল তুলেছে জেলা পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীরের উদ্দেশে। তাঁদের বক্তব্য, অভিযোগে যাতে ‘ধর্ষণ’ কথাটি না লেখা হয় তার জন্য নির্যাতিতার পরিবারের উপর চাপ দিয়েছেন ওই পুলিশ সুপার। খোরজুনার মৃত গৃহবধূর দাদার অভিযোগ, “তদন্ত শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এসপি দাবি করেন, আমার বোনের সঙ্গে ধৃত যুবকের অবৈধ সম্পর্কের জেরেই হত্যা করা হয়েছে বোনকে। এমনকী, আমার বোনের স্বামীকে থানায় দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রেখে চাপ দিয়ে একটি কাগজে ওই সব কথা লিখিয়েও নেন সুপার।” প্রসঙ্গত এর বিরুদ্ধে মানবাধিকার কমিশন ও জাতীয় মহিলা কমিশনেরও দ্বারস্থ হতে চলেছে ওই দুই পরিবার। কাল দুপুরে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার আগে সকাল দশটা নাগাদ রাহুল গাঁধীর সঙ্গেও ১০ জনপথে গিয়ে দেখা করার কথা রয়েছে তাঁদের। পাশাপাশি সময় পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল শিন্দেরও।
তবে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের তরফে এ নিয়ে কটাক্ষ-আক্রমণ চলছেই। এর আগে টুম্পা-মৌসুমীদের কটাক্ষ করেছেন রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ ববি হাকিম। আজ তাঁর আক্রমণের নিশানায় ছিলেন কেন্দ্রীয় রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী। কারণ, মুর্শিদাবাদের এই সাংসদের সহায়তাতেই কামদুনি আজ তার আর্তি জানিয়েছে রাইসিনা হিলে। ফিরহাদের কথায়, “কামদুনির গ্রামবাসীরা রাষ্ট্রপতির কাছে যেতেই পারেন। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি বা রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিবের কাছেও যেতে পারেন। প্রশ্ন হল, গ্রামবাসীদের রাষ্ট্রপতিদের কাছে নিয়ে গেলেন কে? ওই মন্ত্রীর নিজের বিরুদ্ধেই এত অভিযোগ রয়েছে, তার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে কে যাবে?”
|
—নিজস্ব চিত্র সহ প্রতিবেদন: অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য |
পুরনো খবর: রাষ্ট্রপতির কাছে আজ বিচার চাইবে কামদুনি |
|
|
|
|
|