রাজ্যের শাসক পক্ষ দিয়েছে মাওবাদী তকমা। জুটেছে প্রচ্ছন্ন চোখরাঙানি থেকে শুরু করে মিডিয়ার গ্যাস খেয়ে রুপোলি পর্দার প্রতিবাদী মুখ ‘ম্যায় আজাদ হু’ হয়ে ওঠার মতো প্রকাশ্য কটাক্ষও। কামদুনি তবু রাইসিনা হিলের দরজায়।
রাষ্ট্রের শীর্ষ সাংবিধানিক প্রধানের কাছে কাল বিচার চাইবে কামদুনি। চাইবে সিবিআই তদন্ত। দোষীদের শাস্তি। ধর্ষিত ও খুন হওয়া কলেজ ছাত্রীটির ভাই রাষ্ট্রপতিকে শোনাতে চান, কী বীভৎস নৃশংসতায় পা থেকে বুক পর্যন্ত চিরে ফেলা হয়েছিল তাঁর দিদিকে। বাকিদের আসা আগে ঠিক হলেও ভাইটি আসার সিদ্ধান্ত নেন শেষ মুহূর্তে। কাল দেখা হবে তো! উত্তেজনা তাঁর চেখেমুখে। উত্তেজনা ও অজানা আশঙ্কা ষ্পষ্ট দলের বাকিদের মুখেও।
সাধারণ কাজেকর্মে খুব বেশি হলে বনগাঁ-শিয়ালদহ পর্যন্ত যাঁদের দৌড়, সেই কামদুনির বাসিন্দারা আজ সকালে পৌঁছেছেন রাজধানীতে। দু’-তিন জন বাদে সকলেই প্রথম বার পা রাখলেন দিল্লিতে। কাল বেলা বারোটায় প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে তুলে দেবেন তাঁদের ১১ দফা দাবির স্মারকলিপি। সঙ্গে উপহার গীতা, পৈতে, ফল। দেশের প্রথম ব্যক্তির সামনে উপস্থিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে কী ভাবছেন সেই বাবা যিনি তাঁর একমাত্র মেয়েকে হারিয়েছেন? কিংবা এক দাদা যিনি হারিয়েছেন তাঁর ছোট বোনকে? আর ওই ভাই, দিদিকে আনতে গিয়ে বৃষ্টির জন্য যিনি স্রেফ মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন এক বাড়ির উঠোনে! আর ওই সময়টুকুর ফাঁকেই দুষ্কৃতীরা পাঁচিলের আড়ালে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিল তাঁর দিদিকে। কিংবা পাড়ার মেয়ের জন্য, বন্ধুর হত্যাকারীদের চরম শাস্তির দাবি জানাতে গিয়ে যাঁদের কপালে জুটেছে মাওবাদী তকমা! |
প্রতিবাদের মুখ হওয়ায় প্রতেকেই কম-বেশি ভীত। আছে শাসক দলের অদৃশ্য চোখ রাঙানিও। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার স্পর্ধা যে তৃণমূল নেতৃত্ব ভাল চোখে নিচ্ছে না, তা দফায় দফায় বুঝিয়ে দিচ্ছেন শাসক দলের নেতা নেত্রীরা। অমিতাভ বচ্চনের ম্যায় আজাদ হু সিনেমায় সাধাসিধে একটা মানুষ প্রতিবাদের মুখ হতে গিয়ে শেষমেষ ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ ববি হাকিম গত কাল বলেছেন, “আমি আল্লার কাছে প্রার্থনা করছি, আমার ওই ছোট দু’টো বোনের যেন মিডিয়ার গ্যাস খেয়ে সে রকম অবস্থা না হয়!” তবে এ সবে থমকে যেতে রাজি নন বলেই দিল্লিতে এসেছেন মৌসুমি ও টুম্পা কয়ালরা। মৌসুমির কথায়, “মনুষ্যত্বের তাড়নায় এই আন্দোলনে সামিল হয়েছি। ওই মেয়েটির শেষ চেহারা চোখে ভাসে। রাতে ঘুমাতে পারি না। এর পর মুখ না খুললে বিবেকের কাছে কী জবাব দেব?” মৌসুমির শ্বশুরবাড়ি তা-ও কামদুনিতে। কিন্তু একদা সহপাঠী টুম্পার বিয়ে হয়েছে নিউটাউনের কাছে। যে ভাবে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন, তাতে কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে টুম্পার বাবা, মা-সহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন। তবু লড়াই থেকে পিছু হটবেন না, বলছেন টুম্পা।
রাতে ট্রেনের খাবার দাঁতেও কাটেননি অধিকাংশ গ্রামবাসী। আঠারো ঘণ্টার ট্রেনযাত্রা। পুরো রাত জেগেই কাটিয়েছেন প্রায় প্রত্যেকে। টেনশনে। রাষ্ট্রপতিকে কী বলবেন তাঁরা, তিনি আদৌও শুনবেন তো? কিংবা যে সুবিচারের আশায় এত কষ্ট করে আসা তা শেষ পর্যন্ত মিলবে তো! যে অপরাধীরা গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই ফিরে এসে প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছে, তারা আদৌও শাস্তি পাবে তো! আশা- নিরাশায় দুলছে কামদুনির প্রতিবাদী মুখগুলিও।
প্রতিবাদের স্বরকে রাইসিনা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া ছাড়াও যাতায়াত থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি। দলের সঙ্গে এসেছেন স্থানীয় প্রদেশ কংগ্রেসের নেতা শক্তি মৈত্র। ফলে গোটা সফরের পিছনে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে রাজনীতি করারও অভিযোগ এনেছে তৃণমূল নেতৃত্ব।
আর কামদুনির অভিযোগ, সিআইডি-র দেওয়া চার্জশিটে মূল অভিযুক্তের নাম নেই। শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে মূল অভিযুক্তকে আড়াল করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এমনকী, ধৃতরা জেল থেকে ফিরে এসে তাঁদের দেখে নেবে বলে হুমকি দিয়ে রেখেছে। তবুও জীবন পণ করেও এই লড়াইয়ের শেষ দেখে ছাড়তে চান কামদুনির মানুষ। ২৪ জন প্রতিনিধির অন্যতম স্থানীয় স্কুলশিক্ষক প্রদীপ মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের শক্তি রাজ্যের সাধারণ মানুষ। যাঁরা দল নির্বিশেষে ওই নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদে নেমেছেন।” গত কাল শিয়ালদহে রাজধানী ছাড়ার পর থেকেই বি-৩ কামরায় থাকা প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করে যান বহু সাধারণ যাত্রী। ওই লড়াইয়ের মুখ মৌসুমি ও টুম্পা কয়ালকে নৈতিক ভাবে সমর্থনও জানান তাঁরা। শুধু বাঙালি নন, কলকাতার বাসিন্দা কিন্তু অন্য প্রদেশের মানুষেরাও অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন পথে। প্রদীপবাবুর কথায়, “দিল্লিতে মাস কমিউকেশন পড়া এক বাঙালি তরুণী যেমন আমাদের সঙ্গে কথা বলে গেলেন, তেমনই বেলেঘাটার এক বাসিন্দা কিন্তু আদতে রাজস্থানি আমাদের আন্দোলনে যে কোনও ধরনের সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।” আজ সকালে নয়াদিল্লির ১৩ নম্বর স্টেশনে ট্রেন থেকে নামার পরেও বহু সহযাত্রী এগিয়ে এসে কথা বলে গিয়েছেন। জানিয়েছেন এই প্রতিবাদে সামিল রয়েছেন তাঁরাও।
প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে কাল সিবিআই তদন্তের দাবি ছাড়াও, দোষীদের যাতে ফাঁসি হয়, সেই দাবিও জানাবেন মৃতার পরিবার। এ ছাড়া গ্রামে পাকা সড়ক, বিদ্যুৎ ও পানীয় জল ও একটি কলেজ নির্মাণের দাবি জানাতে চায় প্রতিনিধি দলটি। কিন্তু সব ছাপিয়ে যে আশঙ্কাটা বড় হয়ে উঠেছে, রাষ্ট্রপতি কি আদৌও সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন? রাষ্ট্রপতি ভবন সূত্রে বলা হয়েছে, যে কোনও অভিযোগ রাষ্ট্রপতির কাছে জমা পড়লে সেই অভিযোগের ভিত্তিতে তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সিবিআই যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর আওতাধীন, তাই এই ধরনের বিষয় সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়েই পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফলে শেষ পর্যন্ত ঝুলিতে কতটা সাফল্য আসবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
মৃতার বাবা বা ছোট ভাই কিন্তু এ সব আইনি মারপ্যাঁচ বুঝতে রাজি নন। বাবার কথায়, “আমি নিরক্ষর। রাজমিস্ত্রির কাজ করে ছেলে-মেয়েকে পড়িয়েছি। কোনও দিন মেয়ের গায়ে হাত দেইনি। সেই মেয়েকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছে। দোষীদের শাস্তির দাবিতে আমায় যা করতে হয় তা আমি করব।” সঙ্গে হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে সদ্ তাঁদের কারও যে শেষ দেখা হয়নি! |