দিন বদল
বাইকবাহিনীর দাপটে মনে পড়ে শান্ত সাইকেল মিছিল
ফস্সলের সরু রাস্তা। ত্রিশ-চল্লিশটি সাইকেল। দুই সারিতে। কারও সাইকেলে লাগানো পতাকা। মুখে স্লোগান। মিছিলটি চলে যাওয়ার পরেই জনজীবন সঙ্গে সঙ্গেই স্বাভাবিক।
এখন রাস্তা সেই একই রকম। লোকসংখ্যা অনেক বেড়েছে। তার মধ্যেই গমগমে শব্দ। কুড়ি-বাইশটি মোটরবাইক। সেই পতাকা লাগানো, সেই স্লোগান দেওয়া। কিন্তু তা চলে যাওয়ার পরে জনজীবন স্বাভাবিক হতে সময় লাগে।
কেন? রাজ্য মন্ত্রিসভায় জেলার এক মাত্র মুখ তৃণমূলের সুব্রত সাহার কথায়, “এখন বাইক মানেই বাইক বাহিনী। বাহিনী মানেই যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব! সাইকেল মিছিলে আগের সেই সৌম্য শান্ত অথচ স্লোগানে দৃপ্ত সাইকেল মিছিল নেই।’’
কোথায় পার্থক্য হচ্ছে? মানুষের মনোভাব হল, আসলে মোটরবাই আর সাইকেলের মধ্যে মূল ফারাকটা হল শব্দ। সাইকেল মিছিল চলে যেত যেন কিছুটা শান্ত ভাবেই। তখনকার মতো জায়গাটুকু ছেড়ে দিলেই চলত। বাইক মিছিল কিন্তু কেবল তখনকার মতো জায়গা ছাড়ার দাবি নিয়েই শেষ হয়ে যায় না। বরাবরের মতো একটা স্থান করে নিতে চায় শহরের রাস্তায় উপস্থিত মানুষের মনে।
গজধরপাড়ায় তৃণমূলের বাইক বাহিনীর দাপট। গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।
কংগ্রেসের বিধায়ক প্রাক্তন মন্ত্রী মনোজ চক্রবর্তীর ধারণা শব্দ বন্ধেই দু’টি মিছিলের গুণগত তফাত লক্ষ্য করা যায়। তিনি বলেন, “আমরা বলি সাইকেল মিছিল। তার মধ্যে একটা শান্ত, সৌম্য ভাব ভেসে ওঠে। কিন্তু বাইক মিছিল বললেই বাহিনী কথাটি উঠে আসে। ক্ষমতা, দম্ভ, দাপট, গর্জন, হুমকি, দেখে নেওয়ার আস্ফালন!”
কেমন সেই আস্ফালন, দাপট? শহরের মানুষ মনে করিয়ে দেন, সাইকেল জীবনের স্বাভাবিক অঙ্গ। মাস্টারমশায় থেকে দুধওলা, সকলেই সাইকেল চালান। তার মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকত্ব নেই। কিন্তু বাইক তা নয়। মফস্সলে প্রচুর মোটরবাইক চলে। অনেক সময়ে মাস্টারমশায়রাও বাইক চালান। কিন্তু তবু বাইক প্রধানত যৌবনের দাপটের কথাই মনে করিয়ে দেয়। তার শব্দ, তার ধোঁয়া, তার উপস্থিতির মধ্যে ওই দাপট আর আস্ফালনের একটা সম্বন্ধ রয়েছে। মন্ত্রী সুব্রতবাবু বলেন, “আগে প্রতিটি বাড়িতে সাইকেল থাকত। এখন সাইকেলের জায়গা নিয়েছে মোটর বাইক। গতির যুগে শিক্ষকরাও সাইকেল ছেড়ে বাইক ধরেছেন। আগে বটতলায় একটি রেডিও রেখে সবাই মিলে অনুরোধের আসর শুনেছি, নাটক শুনেছি, পল্লিমঙ্গল শুনেছি। এখন কেবল শুনিই না, ঘরে টিভির পর্দায় দেখিও। জীবন যুদ্ধের পরিবর্তনের সঙ্গে এসেছে দ্রুত গতির বাইক ও বাইক মিছিল। এসেছে যুদ্ধ ভাব-বাহিনী।’’
নির্বাচনে জিতে একটি মোটরবাইক নিয়ে এলাকায় ঘুরে বেড়ানোর সময়ে ‘বাইক চেপে দাপিয়ে’ বেড়ানোর ‘অভিযোগ’ শুনতে হয়েছিল প্রয়াত আতাহার রহমানকেও। ১৯৭৭ সালে প্রথম বিধায়ক নির্বাচিত হলেন জন্মভিটে থেকে ৩টি থানা এলাকা টপকে পদ্মাপাড়ের জলঙ্গি বিধানসভা থেকে। ভোটে জয়লাভের সঙ্গেই কমিউনিস্ট নেতার উপরি পাওনা হল একটি মোটরবাইক। কিন্তু কানের কাছে উদ্ধত গর্জন তুলে, নাকের কাছে কালো ধোঁয়া উগরে দিয়ে নিমেষে উধাও হয়ে যাওয়া বাইক ভয় মিশ্রিত বিস্ময়ই কেবল উদ্রেক করেছে, আমজনতার সমীহ আদায় করতে পারেনি। সাইকেল তুলনায় নিরীহ, শান্ত, কেজো আবার প্রিয়ও।
মনোজবাবু যেমন বলেন, “আগে চিকিৎসক রোগীর বাড়ি যেতেন সাইকেল চেপে, শিক্ষক স্কুল কলেজে যেতেন সাইকেল চেপে। তাঁদের দেখে বিপরীত দিক থেকে আসা অন্য কোনও আরোহী সাইকেল থেকে নেমে শ্রদ্ধা জানাতেন, সমীহ করতেন।” কিন্তু রাস্তায় উল্টো দিক থেকে আসা মাস্টারমশায়কে দেখে মোটরবাইক যে তৎক্ষণাৎ থামানোই সম্ভব নয়। মনোজবাবুর কথায়, “সেই মানসিকতাও উধাও।” তিনি বলেন, “২০০৫ সালে সাংসদ অধীর চৌধুরীর নেতৃত্বে মুর্শিদাবাদের কয়েক হাজার চাষি বহরমপুর থেকে কলকাতা পর্যন্ত সাইকেল মিছিল করেছেন। যৌবনের কথা বাদ দিলে সাম্প্রতিক সময়ে সাইকেল মিছিল সেই শেষ।”
সাইকেল মিছিলের স্মৃতি রয়েছে প্রাক্তন মন্ত্রী সিপিএমের আনিসুর রহমানেরও। তিনি বলেন, “১৯৭২ সাল। ক্ষমতায় এল সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মন্ত্রিসভা। দমবন্ধ অবস্থা। ফলে গ্রামে গ্রামে রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি দমবন্ধ অবস্থা কাটাতে আমরা ২৫-৩০ জন দলীয় কর্মী সাইকেল নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলাম। দিনরাত গোটা ডোমকল থানা এলাকায় সাইকেল মিছিল ও সেই সঙ্গে পথসভা করে বাড়ি ফিরলাম ৪ দিন পরে। মানুষের কী শ্রদ্ধা! সমীহ!” তিনি বলেন, “এখন তো রাজনীতির নামে বাইক মিছিলের নামে যা হচ্ছে তা আসলে মস্তান মিছিল। তার সঙ্গে আদর্শ বা নীতির কোনও সর্ম্পক নেই। রয়েছে কেবল দাপট।”
রাজনৈতিক তর্কাতর্কির মধ্যে নেই সাধারণ মানুষ। তাঁরা কেবল বাইক মিছিল দেখলেই সভয়ে সরে দাঁড়ান। জনজীবন স্বাভাবিক হতে সময় লাগে।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.