রাজ্য সরকার হাইকোর্টের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নির্দেশ মানতে চায় কি না, শুক্রবার সেই প্রশ্ন উঠল। কোনও আলোচনাচক্রে কিংবা রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে নয়, উঠল খাস কলকাতা হাইকোর্টেই। বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের এজলাসে। পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে বাইক-বাহিনী নিষিদ্ধ করতে বুধবার যিনি রাজ্যকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সেই নির্দেশ কতটা মানা হল, তা যাচাইয়ের জন্য এ দিন সরকারের রিপোর্ট তলব করেছিলেন তিনি। কিন্তু সরকার তেমন কিছু জমা না-দেওয়ায় ক্ষুব্ধ বিচারপতি রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল (এজি)-কে ডেকে পাঠিয়ে জবাবদিহি চান। এজি বিমল চট্টোপাধ্যায় সন্তোষজনক জবাব দিতে না-পারায় বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ: হাইকোর্টের কথা কেন মানা হল না, রাজ্যের মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্র-সচিবকে সোমবার হলফনামা দিয়ে তার কারণ দর্শাতে হবে। হলফনামা খতিয়ে দেখে হাইকোর্ট সোমবারই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবে।
এ নিয়ে মামলাটির তিন বার শুনানি হল হাইকোর্টে। কোনও বারই সরকারের ব্যাখ্যা আদালতকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। যার প্রেক্ষিতে এ বার স্বয়ং বিচারপতি প্রশ্ন তুলেছেন, রাজ্য সরকার কি আদৌ হাইকোর্টের নির্দেশ মানতে আগ্রহী? |
এ দিন সকাল সাড়ে দশটায় এজলাস বসতে সরকারি কৌঁসুলি (জিপি) অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় একটি চিঠি বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেন। উপস্থিত সকলে ধরে নেন, এটি আদালতের তলব করা রিপোর্ট ছাড়া অন্য কিছু নয়। বিচারপতি চিঠি পড়তে থাকেন। তার মধ্যে বাদী (প্রদেশ কংগ্রেস) কৌঁসুলি প্রভাত চট্টোপাধ্যায় দাঁড়িয়ে উঠে বলেন, “প্রচারপর্বে আমাদের বহু লোক মার খেয়েছেন। আমাদের বিধায়ক অসিত মিত্র পর্যন্ত মার খেয়েছেন। প্রশাসন কিছু করেনি। বাইক-বাহিনীর দাপট অব্যাহত।”
ততক্ষণে বিচারপতির চিঠি পড়া শেষ। তিনি জিপি-কে প্রশ্ন করেন, “চিঠিটা কী, জানেন?” জিপি জবাব দেন, “আমি পড়ে দেখিনি।”
বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “জানতে চেয়েছিলাম, আমার নির্দেশ পালন হয়েছে কি না। চিঠিতে সে সব কিছু বলা নেই। আমি জানি না, কী হচ্ছে! আপনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের থেকে জেনে এসে আদালতকে বলুন, কেন আমার নির্দেশ মানা হয়নি।” বিচারপতি জানিয়ে দেন, বেলা ১টা ১০ মিনিটে তিনি সরকার পক্ষের বক্তব্য শুনবেন।
তার আগেই, বেলা সাড়ে বারোটায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কৌঁসুলি লক্ষ্মীচাঁদ বিয়ানি এজলাসে এসে অভিযোগ করেন, বাইক-বাহিনী নিয়ে কমিশনের নির্দেশিকা বলবৎ হয়নি। “প্রচারপর্বে কোথায় কত বাহিনী মোতায়েন হবে, কোর্টের নির্দেশে গত ৬ জুলাই মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্র-সচিবের সঙ্গে বৈঠক করে তা ঠিক করা হয়েছিল। সেখানে বাইক-বাহিনী নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তও হয়। ৭ জুলাই সব জেলা প্রশাসনকে নির্দেশটি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ তা মানা হয়নি।” বলেন বিয়ানি। বিচারপতির উদ্দেশে তাঁর বক্তব্য, “গত বুধবার আপনার কাছে এসে আমরা এ সব জানিয়েছিলাম। আপনি রাজ্যকে বলে দিয়েছিলেন নির্দেশটি সুনিশ্চিত করতে। কিন্তু এ দিন যে চিঠি আপনার সামনে দেওয়া হয়েছে, তাতে বাইক-বাহিনী নিষিদ্ধের প্রসঙ্গই নেই। এটা অন্য চিঠি।” কমিশনের কৌঁসুলি দাবি করেন, ভোটে কোথায় কত বাহিনী মোতায়েন হবে, ওই চিঠিতে তা-ই বলা রয়েছে।
ইতিমধ্যে জিপি ফের ঢুকেছেন এজলাসে। তাঁকে বিচারপতি বলেন, “আপনি আমার ১০ জুলাইয়ের (বুধবারের) নির্দেশটি ভাল করে পড়ুন।”
নির্দেশের প্রতিলিপি বিচারপতি জিপি’র হাতে দেন। জিপি পড়তে থাকেন। পড়া শেষ হয়।
বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়: এ বার বলুন, আমার নির্দেশ পালন করা হল না কেন? সে প্রশ্নের জবাব দিন।
জিপি: সংবাদমাধ্যম নানা মনগড়া কথা লিখছে। আজেবাজে কথা লিখছে...
জিপি’কে মাঝপথে থামিয়ে দেন বিচারপতি। মন্তব্য করেন, “আপনি মূল বিষয়টি থেকে অন্য দিকে সরে যাচ্ছেন। আদালতকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন।” সরকারি কৌঁসুলিকে বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমার নির্দেশ পালিত হল না কেন, সেটাই শুধু জানতে চাইছি। সেটা আপনি পরিষ্কার করে বলুন। দু’টো পর্যন্ত সময় দিচ্ছি। মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্র-সচিবকে ডেকে পাঠান।” |
কে কী করেছে বা বলেছে, তা জানতে চাই না। আমি ১০ জুলাই যে নির্দেশ দিয়েছিলাম, তা মানা হল না কেন, শুধু সেটাই বলুন। আমি সরকারকে বলেছিলাম বাইক-বাহিনী বন্ধের নির্দেশ সুনিশ্চিত করতে। তা মানা হয়েছে, না হয়নি?
বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় |
|
জিপি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। একটু পরে বিচারপতি বলেন, “ঠিক আছে। দু’টোর সময়ে অ্যাডভোকেট জেনারেল’কে আমার এজলাসে হাজির থাকতে বলুন।”
দু’টোয় ফের শুনানি শুরু হলে এজি বিমলবাবু আদালতের কাছে দাবি করেন, “কমিশন বাইক-বাহিনী নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও অভিযোগ রাজ্য সরকারের কাছে পেশ করেনি।”
শুনে বিচারপতি বলেন, “কে কী করেছে বা বলেছে, তা জানতে চাই না। আমি ১০ জুলাই যে নির্দেশ দিয়েছিলাম, তা মানা হল না কেন, শুধু সেটাই বলুন। আমি সরকারকে বলেছিলাম বাইক-বাহিনী বন্ধের নির্দেশ সুনিশ্চিত করতে। তা মানা হয়েছে, না হয়নি?”
অ্যাডভোকেট জেনারেল চুপ করে থাকেন। বিচারপতি তখন এজি’কে বলেন, “সোমবার মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্র-সচিবকে হলফনামা দিয়ে জানাতে বলুন, কেন আমার নির্দেশ তাঁরা
পালন করেননি।” কিছুক্ষণ থেমে বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “রাজ্য সরকার যদি আমার নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চে যায়, তা হলে অন্য কথা। নচেৎ এটি কার্যকর করতেই হবে।”
আর নির্দেশ মানা না-হলে সোমবার হাইকোর্ট যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে বলেও এ দিন জানিয়ে দিয়েছেন বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়।
|