পঞ্চায়েত নির্বাচনের মধ্যেই এ বার রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নিয়ে সরব হল শাসক দল। ভোটের প্রচারে গিয়ে শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন, সিপিএমের দুই শীর্ষ নেতার নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কী ভাবে ১৬ কোটি টাকা এল এবং কেনই বা পরে দলের নামে অ্যাকাউন্ট করে টাকা হস্তান্তর করা হল এই গোটা ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দরকার। তৃণমূলের রাজ্যসভার মুখ্য সচেতক ডেরেক ও’ব্রায়েন আরও এক ধাপ এগিয়ে দাবি করেছেন, বিমান বসু, নিরুপম সেন ছাড়াও সিপিএমের আরও যে যে নেতার দেশে-বিদেশে বা সুইস ব্যাঙ্কে টাকা আছে, সে সবেরও তদন্ত হওয়া উচিত!
সিপিএমের তরফে আগেই জানানো হয়েছিল, বিমানবাবু ও নিরুপমবাবুর ওই অ্যাকাউন্ট আদতে দলেরই। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী-সহ তৃণমূল নেতৃত্বের তদন্তের দাবির জবাবে সিপিএম নেতৃত্ব জানিয়ে দিয়েছেন, অ্যাকাউন্ট ও টাকা লেনদেনের সব রেকর্ডই আছে। তবু প্রয়োজনে তদন্তের মুখোমুখি হতে তাঁদের কোনও আপত্তি নেই।
কলকাতায় স্টেট ব্যাঙ্কের একটি শাখায় সিপিএমের দুই পলিটব্যুরো সদস্য বিমানবাবু ও নিরুপমবাবুর নামে একটি কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ছিল। দুই নেতার নামে সেই অ্যাকাউন্টে কী ভাবে ১৬ কোটি টাকা এল, এক এক দিনে কেন সেখানে ১৫-১৬ লক্ষ টাকার নগদে লেনদেন হয়েছিল, এ সব তথ্যই খতিয়ে দেখতে চেয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে রাজ্য সরকারের আর্থিক অপরাধ সংক্রান্ত বিভাগ। ব্যাঙ্ক এবং আয়কর দফতরের কাছে এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পাঠানোর পরে আলিমুদ্দিনও সিপিএমের রাজ্য কমিটির নামে অ্যাকাউন্ট খুলে নিয়েছে। গোটা বিষয়টিতে বেনিয়ম ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ করে আবার স্টেট ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের কাছে তদন্তের দাবি জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের নেত্রী দোলা সেন। পঞ্চায়েত ভোটের সময় বিরোধী দলকে বিব্রত করার এমন একটি হাতিয়ার স্বভাবতই হাতছাড়া করতে চাইছেন না তৃণমূল নেতৃত্ব।
বর্ধমানের (যা প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপমবাবুরই জেলা) রায়নায় প্রচারে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেছেন, “বিধানসভা ভোটের আগে সম্পত্তির হিসেব জমা দিতে হয়েছিল। নিরুপমবাবু নিজেকে সমাজসেবী বলে দাবি করেন। দেখা গিয়েছিল, তাঁর ব্যাঙ্কে ৩৬ লক্ষ টাকা রয়েছে। কিন্তু এখন ১৬ কোটি টাকা তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এল কী করে? আগে দেখতাম, এরা সিঁদ কেটে চুরি করে! এখন তো দেখছি, এরা পুকুর চুরি করছে!” মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন, কোটি কোটি টাকা দলের নামে নয়, কেন ব্যক্তিগত নামে জমা পড়েছে? কেন বিমানবাবুর প্যান কার্ড নেই? মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “সব বিস্তারিত তদন্ত হওয়া দরকার। আমি মুখ্যমন্ত্রী নয়, তৃণমূলের নেত্রী ও সাধারণ মানুষ হিসেবে তদন্ত দাবি করছি। চিটিং ফান্ড তো করেছেই! ’৮১ থেকে ২০১১-এর মে পর্যন্ত করেকম্মে খেয়েছে! যে করল পকেটমারি, সে-ই চিৎকার করছে ‘পকেটমার, পকেটমার’!”
মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগের জবাবে নিরুপমবাবু এ দিন বলেছেন, “ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কালো টাকা তো নেই! যা আছে, সবই সাদা এবং তার প্রতিটি লেনদেনের হিসাবও আছে। তবু ওঁরা চাইলে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে তদন্ত করতে পারেন!” নিরুপমবাবু ফের বলেছেন, রাজ্য দলের তরফে তাঁদের অ্যাকাউন্টের অডিটেড স্টেটমেন্ট সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির দেওয়া আয়কর হিসাবের মধ্যেই ধরা থাকে। ওই হিসাবের মধ্যে কলকাতায় তাঁদের অ্যাকাউন্টের দেওয়া তথ্য আছে কি না, মিলিয়ে দেখলেই সব বোঝা যাবে।
মমতার আরও বক্তব্য, “আমাদের তো সব কাজেই পার্টির নামে অ্যাকাউন্ট। ১৫ বছর বয়স হয়ে গেল আমাদের দলের, ১৫ কোটি টাকাও হয়নি! দলীয় মুখপত্রের অ্যাকাউন্ট নিয়ে বড়জোর ৭-৮ কোটি আছে। আমার নিজের অ্যাকাউন্টে তো কোনও টাকাই নেই!” আর বিমানবাবু-নিরুপমবাবুদের বিঁধে কলকাতায় ডেরেক বলেছেন, “চোর ধরা পড়েছে হাতে-নাতে! ৩৪ বছরে কম কামিয়েছে? আরও কোন কোন নেতার দেশে-বিদেশে, সুইস ব্যাঙ্কে কত হাজার ডলার আছে, তার তদন্ত চাই।” মুখ্যমন্ত্রী বর্ধমানে যে কথা বলেছেন, সেই সুরেই ডেরেকও দাবি করেছেন, “নির্বাচন কমিশন নিরুপম সেনের সম্পত্তির তথ্য গোপন নিয়ে তদন্ত করুক। জেলে যেতে হলে জেলে যাবেন! ওই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের টাকা ব্যবহার করে দেশের যেখানে যত সম্পত্তি ওরা কিনেছে, সেগুলি নিয়েও তদন্ত হোক।” সিপিএমের প্রয়াত রাজ্য সম্পাদক
প্রমোদ দাশগুপ্তের নামে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের বেলেঘাটা শাখায় এখনও বেশ কিছু টাকা আছে বলে অভিযোগ করে তারও তদন্ত দাবি করেছেন ডেরেক।
নিরুপমবাবু এবং বিমানবাবু জানিয়েছেন, গোড়ায় যখন ওই কারেন্ট অ্যাকাউন্ট (যে যৌথ অ্যাকাউন্ট নিয়ে প্রশ্ন) খোলা হয়েছিল, প্রথা মেনে দলের প্যাডে চিঠি দিয়েই তাঁদের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। আবার দলের রাজ্য কমিটির অ্যাকাউন্ট করার সময়েও একই পদ্ধতি মানা হয়েছে। তাঁদের ব্যাখ্যা, ওই অ্যাকাউন্টের টাকা কোনও নেতার যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় এবং সেখানে ‘গোপন’ করার কোনও সুযোগও যে নেই, সে সবেরই রেকর্ড আছে। এরই পাশাপাশি, হুগলির হরিপালে এ দিনই প্রচারে গিয়ে অ্যাকাউন্ট-প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেছেন, “বিমান বসু, নিরুপম সেনের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট দেখতে গেছেন আপনি? বিমানবাবু আলিমুদ্দিনে আমাদের পার্টি অফিসে থাকেন। নিরুপমবাবু আপনাদের হুগলি জেলার সব ব্লকেই এসেছেন। আপনারা তাঁকে চেনেন। আমাদের হিসাব কেন্দ্রীয় কমিটি রাখে। যার অফিস দিল্লিতে। পশ্চিমবঙ্গের টাকা, কলকাতার টাকা সব হিসেব-নিকেশ দিল্লিতেই হয়। এটা বলে কিছু করতে পারবেন না আপনি। শাক দিয়ে আর মাছ ঢাকতে যাবেন না!”
প্রধান বিরোধী দলের অ্যাকাউন্ট নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য অবশ্য বলেছেন, “আমাদের দলে এ রকম হয় না। এটা ওঁদের দলের ব্যাপার। ওঁদের দলই সিদ্ধান্ত নেবে, যে পদ্ধতি ওঁরা কায়েম করেছিলেন, সেটা সঠিক কি না। দল ওঁদের আদৌ অনুমতি দিয়েছিল কি না, ওঁরাই বলতে পারবেন।” নিরুপমবাবুরা বলেই দিয়েছেন, দলীয় ব্যবস্থা মেনেই যা হওয়ার হয়েছে। তবে তাঁরা যা-ই বলুন, তৃণমূল যে বিষয়টি সহজে ছেড়ে দেবে না, এ দিনের ঘটনাপ্রবাহেই তার ইঙ্গিত স্পষ্ট।
|
তৃণমূলের পঞ্চবাণ
|
• দলের সর্বক্ষণের দুই কর্মীর অ্যাকাউন্টে ১৬ কোটি এল কোথা থেকে? আলিমুদ্দিনের ঠিকানা কেন ব্যবহার হল?
• বিমানবাবুর প্যান কার্ড নেই। তবু তাঁর অ্যাকাউন্টে ১৬ কোটি থাকে কী করে?
• দুই নেতার নামে থাকা অ্যাকাউন্ট দলের নামে বদলে দেওয়া হল কেন?
• ওই অ্যাকাউন্টের দুই ধারকের অন্যতম হিসেবে অন্তত ৮ কোটির মালিক নিরুপমবাবু। এই হিসেব নির্বাচন কমিশনকে দেননি কেন?
• দেশে-বিদেশে, এমনকী সুইস ব্যাঙ্কেও সিপিএম নেতাদের অ্যাকাউন্ট থাকতে পারে। তদন্ত দরকার। |
|